করোনায় নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

প্রণোদনা বা ঋণ দিয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বাঁচান

মো. শাহ্‌ নেওয়াজ মজুমদার
  প্রকাশিত : ২৮ এপ্রিল ২০২১, ১২:১০
অ- অ+

করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে কঠিন সংকটে দিন কাটছে বেসরকারি ও নন এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। প্রতিষ্ঠানের আয় অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মাসিক বেতন ও অন্যান্য ফি আদায় করেই তাদের বেতন-ভাতা হতো।

গত বছরের ১৭ থেকে বন্ধ আছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এতে সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বড় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কারণ সরকার তাদের বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধ করছেন। যত সমস্যা নিজস্ব আয়ে চলা বেসরকারি ও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন (কেজি স্কুল) স্কুলের অধিকাংশ আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া আছে আধা এমপিও, বেসরকারি ও প্রাইভেট স্কুল সাত হাজার। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন ধরনের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে পৌনে ১০ হাজার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৯৬টি, বেসরকারি নন এমপিও স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা আছে। আরও আছে শতাধিক ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ছে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। বেসরকারি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে পড়ছে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, এর মধ্যে আবার পুরোপুরি বেসরকারি কলেজে পড়ছে ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থী।

প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত টিউশন ফির আয় থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহের পর শিক্ষক-কর্মচারীদের যৎসামান্য বেতন দেওয়া হয়। এর বাইরে এসব শিক্ষক প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু আয় করেন এবং সব মিলিয়ে কোনো রকমে জীবিকা নির্বাহ করেন। করোনার করণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি অনেকাংশে আদায় বন্ধ, প্রাইভেট পড়ানোও বন্ধ। আবার অধিকাংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের উৎস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা তাদের বাচ্চাদের স্কুলের বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না, প্রাইভেট পড়ানো দূরের কথা।

এতে শিক্ষক-কর্মকর্তারা অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়ে অনেকেই জীবিকা পরিবর্তন করছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিক্ষকদের দুর্দশার চিত্র কিছুটা উঠে আসছে। জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষক সমাজের অনেকে পেটের দায়ে কৃষিকাজ করছেন, ভ্যান চলাচ্ছেন, ইজিবাইক চালাচ্ছেন, ফল ও সব্জি বিক্রি করছেন, ভেটেরিনারি ওষুধ বিক্রি করছেন, রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন। শহর ছেড়ে অনেকে চলে গেছেন গ্রামে। কী করে সংসার চালাবেন এই চিন্তায় দিন দিন মুষড়ে পড়ছেন বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও পলিটেকনিকের শিক্ষক-কর্মকর্তারা। অর্থ-বিত্ত না থাকলেও শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা আছে। এ কারণে লজ্জায় তারা হাত পাততে পারেন না।

দেশে ৬০ হাজারের বেশি কিণ্ডারগার্টেন স্কুল ছিল। এই স্কুলগুলোয় ৬ লাখের মতো শিক্ষক ও কয়েক লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল। মার্চ ২০২০ থেকে স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করতে না পেরে স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ভবনের বাড়ি ভাড়া ও বিভিন্ন বিল পরিশোধ করতে না পেরে ইতিমধ্যে অনেক স্কুল বিক্রি বা বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে এসব স্কুলের কর্মচারীরা পেশা হারান ও নতুন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন।

অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তারা করোনা মহামারির প্রথম থেকেই অনলাইনে তাদের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের সাথে যুক্ত রাখার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তারা ফেইসবুক, জুম, ব্লাইন্ডেড লার্নিং সিস্টেম (BLC) অনেকে নিজস্ব সফটওয়্যারের মাধ্যমে। তার পরেও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অবহেলিত ও দুর্দশাগ্রস্ত ।

দেশের সব ব্যবস্থা সচল রাখতে সরকারি-বেসরকারি দুটোরই প্রয়োজন আছে, কিন্তু দেশ ও জনগণের ক্রান্তিলগ্নে সরকারের কাছে সবাই নাগরিক। এখানে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থার মধ্যে বিভাজন না রেখে সমন্বয়ের মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। কেননা সরকার জনগণের অভিভাবক। এই ক্রান্তিলগ্নে জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা যে সংকটের জায়গায় এসেছে, তার আশু সমাধান দেখা জরুরি হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে- ১, শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জীবন জীবিকা রক্ষা । ২, শিক্ষা কার্যক্রমে গতি সৃষ্টি করা।

সাময়িক ও অসাময়িক দুটো দিকই মাথায় রাখতে হবে। সাময়িকভাবে বেসরকারি ও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা জরুরি। একজন শ্রমিক ও ভিখারি হাত পেতে কিছু নিতে পারে, কিন্তু একজন শিক্ষক নিজেকে লুকিয়ে রাখেন, কাউকে বুঝতে দেন না যে তার হাঁড়িতে খাবার নেই, ধার করতে গেলে লজ্জায় মুখ লুকাতে হয়, বাসা ভাড়া না দিতে পারলে লজ্জায় হেঁট হয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হয়।

তাদের দেখার জন্য প্রথমে দেয়া যেতে পারে আর্থিক প্রণোদনা। দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো মাসিক বেতনের সমপরিমাণ অর্থ বিনা সুদে ঋণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে নানা ধরনের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সব থেকে বড় লাভজনক বিনিয়োগ ক্ষেত্র শিক্ষা এর বাইরে থেকে গেছে। শুধু করোনাকালীন প্রণোদনাই নয়, শিক্ষকদের উন্নয়নে নিতে হবে দুর্দশা লাগবের টেকসই উদ্যোগ। সরকারেরে উচিত এখই উদ্যোগ নেয়া, না হলে মেধাবীরা আর শিক্ষকতায় আসবেন না, পুরনোরা বের হয়ে অন্য পেশায় যোগ দেবেন। এর প্রভাব পড়বে আমাদের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। সরকার ও অভিভাবকরা যদি এখন এগিয়ে না আসেন তাহলে শিক্ষক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাঁচবে না, আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না বাঁচলে শিক্ষার গোটা ব্যবস্থাই হুমকির মুখে পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। অনেক মেধাবী শিক্ষক বেকার হয়ে যাবেন।

এই করোনা মহামারি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, অনেক দুর্বলতা ও বৈষম্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য ও দুর্বলতাগুলো আমরা বুঝতে পেরেছি। এ শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যেন যত দুর্যোগই আসুক না কেন আমাদের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের আর যেন এমন দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে না হয়। দেশ গড়তে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবদান কোনো অংশে কম নয়।

আমরা চাই শিক্ষা আর শিক্ষক যেন সমাজে অবহেলিত না হয়। শিক্ষক-কর্মকর্তা শ্রেণিকে অবহেলার দিকে ঠেলে দিয়ে জাতীয় চেতনা ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আপৎকালীন সমস্যা সমাধানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয় আনা দরকার। আমাদের মানতে হবে, শ্রম আর শিক্ষা সভ্যতার দুটি ডানা, একটি ছাড়া অন্যটি চলতে পারে না। আশা করি অচিরেই শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মর্যাদা সমুন্নত হবে। আমরা আরো মনে করি, শিক্ষক বাঁচলে শিক্ষা বাঁচবে, শিক্ষা বাঁচলে সমাজ বাঁচবে।

লেখক: লেখক ও কলামিস্ট

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নির্বাচনে নৌকা প্রতীক থাকবে না: রাশেদ প্রধান
২২৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে খেলাফত মজলিস 
মিটফোর্ডে মাথা থ্যাঁতলে হত্যা: তিন আসামির দায় স্বীকার
জেডআরএফের উদ্যোগে ডেঙ্গু ও করোনা প্রতিরোধে জনসচেতনামূলক প্রচারপত্র বিতরণ 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা