যে কারণে প্রশংসা পেতে পারেন বগুড়ার ডিসি

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ২৩ জুন ২০২১, ০৮:১৬| আপডেট : ২৩ জুন ২০২১, ১২:০০
অ- অ+

করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণে সংশ্লিষ্ট ১০টি ব্যাংককে চিঠি দিয়েছিলেন বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক। জেলা এসএমই ঋণ বিতরণ মনিটরিং কমিটির প্রধান হিসেবেই চিঠিগুলো পাঠিয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ব্যাংকগুলোর এসএমই ঋণ বিতরণের ধীরগতির বিষয়টি উল্লেখ করা হয় চিঠিতে। সেই সঙ্গে, সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোকে ঋণ বিতরণের গতি বাড়ানোর বিষয়ে নির্দেশনা দিতে তিনি অনুরোধ করেন।

প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকের এই তৎপরতা প্রশংসার দাবি রাখে বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ছোট ও মাঝারি শ্রেণির উদ্যোক্তাদের কল্যাণে তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা ইতিবাচক। যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা হয়েছে। অথচ বিস্ময়কর হচ্ছে, ডিসির এই চিঠি নিয়ে উল্টো আপত্তি তুলছে ব্যাংকগুলো। যদিও শিল্প মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটিগুলোকে ঋণ বিতরণ তদারকির পাশাপাশি কোনো সমস্যা পেলে তা সমাধানের বিষয়েও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

করোনা মহামারির ধাক্কা বড় শিল্পের পাশাপাশি লেগেছে মাঝারি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পেও। ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের এই ক্ষতি পোষাতে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই প্রণোদনার আওতায় ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই ঋণ সঠিক এবং সহজভাবে ক্ষতিগ্রস্তরা পাচ্ছেন কিনা তা খতিয়ে দেখতে গত বছরের জুনে জেলা পর্যায়ে নজরদারি কমিটি করে দেয় সরকার। কমিটির প্রধান করা হয়েছে জেলা প্রশাসকদের। সদস্য সচিব করা হয়েছে বিসিকের শিল্প সহায়ক কেন্দ্রের উপমহাব্যবস্থাপক বা ব্যবস্থাপক বা উপব্যবস্থাপককে।

কমিটির কাজের ক্ষমতার বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আদেশে, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও কুটির এবং মাঝারি শিল্পের ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তারা যেন স্বচ্ছতার সাথে ঝামেলা ছাড়া ব্যাংক থেকে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ পান সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এছাড়া ঋণ গ্রহীতা নির্বাচন, ঋণ বিতরণ, তদারকি ও আদায়ের বিষয়টি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবে কমিটি। পাশাপাশি কোনো সমস্যা এলে তা স্থানীয়ভাবে সমাধান করতে বলা হয়েছে। এই ঋণ প্রদানের মাধ্যমে কোভিড পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ীরা যেন স্বাভাবিকভাবে তাদের ব্যবসায় ফিরতে পারেন এজন্য কমিটিকে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। সব ধরনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে যেন সুষমভাবে ঋণ বিতরণ করা যায় তাই ঋণের ডুপ্লিকেশন ঠেকানোর জন্য কমিটিকে তদারকি ও সমন্বয়ের দায়িত্বও দেয়া হয় ওই চিঠিতে। সেই সঙ্গে প্রতিমাসে কমপক্ষে একবার কমিটি সভা করে তার সিদ্ধান্তগুলো ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রমের মাসিক অগ্রগতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিবকে জানানোর জন্য বলা হয়েছে।

বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. জিয়াউল হক বলেন, তিনি এই কার্য-পরিধির মধ্যেই ব্যাংকগুলোকে এসএমই ঋণ বিতরণের বিষয়ে তাগিদ দিয়েছেন। তার স্বাক্ষরিত চিঠিতে গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত সভার বিষয়টি তুলে ধরে লক্ষ্যমাত্রা ও ঋণ বিতরণের চিত্র তুলে ধরতে বলেন। এমডিদের লেখা চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে আপনাদের বগুড়া শাখা অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও কুটির এবং মাঝারি শিল্পের ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে যথেষ্ট উদ্যোগী ও কর্মতৎপর নয় বলে প্রতীয়মান হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ অর্জনের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হলো।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে জেলার এসএমই ঋণ বিতরণ মনিটরিং কমিটির প্রধান হিসেবে ডিসি যে চিঠি ব্যাংকগুলোকে দিয়েছেন, এটি প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ তিনি ব্যাংকগুলোকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করেছেন। অনুরোধ করেছেন যেন ক্ষতিগ্রস্তরা কম সময়ে প্রয়োজনী ঋণ পান। তাঁর এই কর্ম তৎপরতা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের নির্দেশনা বাস্তবায়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ এই চিঠি নিয়ে ব্যাংকগুলো যে প্রশ্ন তুলছে, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ব্যাংকগুলোর উচিত তাদের দায়িত্বগুলো যথাযথ পালন করা। তারা এটা না করে ডিসির চিঠির বিরুদ্ধে যে আপত্তি তুলছেন, তা নিজেদের দায়বদ্ধতার অবহেলাকে আড়াল করার চেষ্টা।

এ ব্যাপারে সাবেক নৌ ও বেসামরিক বিমান পরিবহন সচিব শফিক আলম মেহেদী মনে করেন, এখানে আপত্তি তোলার পেছনে আমলতান্ত্রিক দৃষ্টি ভঙ্গি কাজ করছে। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের করোনার ক্ষতি থেকে টেনে তুলতে এটি সরকারের একটি উদ্যোগ। আমরা যদি এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন চাই, তাহলে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলের কাজের মধ্যে সুসমন্বয় থাকতে হবে। এখানে ছোট-বড় এই প্রশ্ন তোলা ঠিক না। এটা জেলা এসএমই ঋণ বিতরণ মনিটরিং কমিটির আহবায়ক হিসেবে অবশ্যই জেলা প্রশাসক ব্যাংকগুলোকে অবহিত করতে পারেন যে, আপনার ওপর যে দায়িত্ব ছিল সেটি সুষ্ঠুভাবে পালিত হচ্ছে না বা গতিশ্লথ। এটা আরও ধ্রুত বিতরণ করা প্রয়োজন, এটা তিনি বলতে পারেন। এখানে আমি কোনো ভুল দেখি না।’

সাবেক এই সচিব আরও বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির। বিশেষ করে আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির। আমরা যদি দেশের সেবক হিসেবে ভাবি, তাহলে মনিটরিং কমিটির প্রধানও সেবক, ব্যাংকের এমডি সাহেবও সেবক। এখানে বড়-ছোটর প্রশ্ন নয়। ঢাকার উপসচিবের সঙ্গে জেলার ডিসিকে মিলালে হবে না। ডিসি সাহেব হচ্ছেন কেন্দ্রীয় সরকারের জেলার প্রতিনিধি। তাঁর ওপর অনেক গুরুদায়িত্ব। ডিসি এবং ব্যাংকের এমডিদের মধ্যকার মনোস্তাত্তি¡ক এই দ্ব›দ্বটি কিন্তু জনস্বার্থবিরোধী। এনিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানার জনতা, বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট, আইএফআইসি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, আল-আরাফাহ্ ইসলামী, ঢাকা, পূবালী, ট্রাস্ট, সাউথইস্ট ও এনআরবি ব্যাংকের এমডিদের চিঠি দিয়েছিলেন বগুড়ার ডিসি। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ‘গোপনীয় শাখা’ থেকে ডিসি স্বাক্ষরিত এই চিঠিগুলো পাঠানো হয়। কয়েকটি ব্যাংক এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মৌখিক আপত্তি জানিয়েছে বলে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এসএমই ঋণ বিতরণের বিষয়ে বগুড়ার জেলা প্রশাসক ব্যাংকগুলোকে যে চিঠি দিয়েছেন এটি তিনি জেলা মনিটরিং কমিটির প্রধান হিসেবে দিয়েছেন। এই ক্ষমতা সরকার তাঁকে দিয়েছে। তিনি যদি ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণের ধীরগতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন, তাহলে ভুল কিছু করেছেন বলে আমার মনে হয় না। বরং সাধুবাদ পাওয়ার মতো কাজ করেছেন। নিজের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন। কারণ বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কল্যাণে এই প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। তাঁর নির্দেশনা মেনে যতদ্রæত ক্ষতিগ্রস্তদের এই ঋণ দেওয়া যাবে, ততই মঙ্গল। এখানে কারো গড়িমশি করার সুযোগ নেই।’

ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকসের উদ্যোক্তা অর্থনীতি বিভাগের এই সমন্বয়ক আরও বলেন, ‘ব্যাংক এবং জেলা এসএমই ঋণ বিতরণ মনিটরিং কমিটি কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়। একে অন্যের সহযোগী। পারস্পরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর শুভ এই উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে যে উদ্দেশে ২০ হাজার কোটি টাকার বিশাল এই প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, তা ব্যাহত হবে। এ ব্যাপারে কোনো ব্যাংকের গাফলতি থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত সেটি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।’

আহবায়ক এবং সদস্য সচিব ছাড়াও জেলা এসএমই ঋণ বিতরণ মনিটরিং কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ বিতরণে নিয়োজিত লিড ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের জেলা পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তা, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যাংকের প্রতিনিধি, এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি, জেলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি, জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতির জেলা সভাপতি, খাত ভিত্তিক শিল্প সংগঠনের জেলা সভাপতি, উইমেন চেম্বার/অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, জেলা প্রশাসক মনোনীত স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং জেলা প্রশাসক মনোনীত মাইক্রো ফাইনান্সিং প্রতিষ্ঠানের জেলা প্রতিনিধিকে কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/২৩জুন/এইচএফ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
রাঙ্গুনিয়ায় মডেল মসজিদ উদ্ধোধন করলেন ধর্ম উপদেষ্টা 
আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার এখনো পাই নাই: রমজান আলী
শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে আবারও সক্রিয় অপশক্তি: সপু
বগি লাইনচ্যুত, খুলনার সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা