লিভারে চর্বি: এক ভয়াবহ নিশ্চুপ মহামারি

ডা. নীরা ফেরদৌস
  প্রকাশিত : ০২ আগস্ট ২০২১, ২১:২০| আপডেট : ০৩ আগস্ট ২০২১, ১৭:১৮
অ- অ+

লিভারের চর্বি বা নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD) লিভারের কতগুলো অবস্থার সমন্বয়ে এক ধরনের রোগ। যা অতিরিক্ত মদপানের সাথে সম্পর্কিত নয়। এটা সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে।

১. সাধারণত ফ্যাটি লিভার যাতে লিভারের চর্বি জমা হয় এবং স্বল্প বা কোনো প্রদাহ জটিলতা থাকে না।

২. নন অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস বা (NASH)- ন্যাস যাতে লিভারে চর্বি জমে তাতে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। লিভারের কোষগুলো নষ্ট হয়ে লিভার সিরোসিস এবং পরিশেষে ক্যানসার হয়ে থাকে।

লিভারে চর্বি বিশ্বজুড়ে দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশ্বের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ এই রোগে ভুগছেন। এটা আমেরিকাতে দীর্ঘমেয়াদী লিভারের রোগ (CLD) এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।

আমাদের দেশের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৩৩ শতাংশ মানুষ এই রোগে ভুগছেন। অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস, মধ্যবয়সী, বিবাহিত এবং গ্রামের নারীদের এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

উপসর্গসমূহ

সাধারণ ফ্যাটি লিভার: সাধারণত কোনো উপসর্গ থাকে না। তবে শ্রান্তিবোধ, দিকের উপর পেটে ব্যথা বা অস্বস্তিবোধ হতে পারে।

ন্যাস থেকে সিরোসিস:

পেট ফুলে যাওয়া বা পেটে পানি আসা

ত্বকের রক্তনালিগুলো ফুলে ওঠা

হাতের তালু লাল হওয়া

জন্ডিস

পেটে চাকা/পিণ্ড অনুভূত হওয়া

রক্তবমি, কালো পায়খানা (আলকাতরার মতো)

তন্দ্রাভাব, ভুল বকা, কথার জড়তা ইত্যাদি।

কারণসমূহ: প্রকৃত কারণ এখনও অজানা। তবে জিনগত বৈশিষ্ট্য, ইনসুলিন হরমোনের কার্যকারিতা কমে যাওয়া, রক্তে চিনির পরিমাণ বেশি থাকা, রক্তে খারাপ চর্বির পরিমাণ বেশি থাকা এস কারণ মিলে লিভারে চর্বি জমতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

ঝুঁকি

১. রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড (খারাপ চর্বি বেশি থাকা)

২. মেটাবলিক সিনড্রোম- এক ধরনের অবস্থা যা পেটের চর্বি বা মেদ ভুঁড়ি, ডায়াবেটিস বা প্রি ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও রক্তের চর্বি ইত্যাদির সমন্বয়ে হয়। এই অবস্থাটা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।

৩. মেদভুঁড়ি ও অতিরিক্ত ওজন

৪. পলিসিস্টিক ওভারী সিন্ড্রোম। যা নারীদের এক ধরনের সমস্যা।

৫. টাইপ টু ডায়াবেটিস

৬. হাইপো থাইরয়েড বা থাইরয়েড হরমোন কমে যাওয়া

৭. পিটুইটারী হরমোনগুলোর স্বল্পতা।

ন্যাস (NASH) হওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিসমূহ হলো-

১. বয়স্ক ব্যক্তিরা

২. ডায়াবেটিস

৩. পেটের চর্বি

লিভারে চর্বির স্বাভাবিক পরিণতি

সাধারণত ৪৪ থেকে ৬৪% মানুষ যাদের লিভারে চর্বি আছে। যাদের ন্যাস (NASH) হতে তিন থেকে সাত বছর সময় লাগে।

ন্যাস (NASH) থেকে ১- থেকে ২৫% মানুষের সিরোসিস হতে আট থেকে ১৪ বছর সময় লাগে।

সিরোসিস থেকে দুই থেকে ১৩% মানুষের লিভারে ক্যানসার হতে তিন থেকে সাত বছর সময় লাগে।

আরও চিন্তার বিষয় হলো- সাধারণ লিভারের চর্বি থেকে প্রায় ২৪% মানুষ তিন থেকে সাত বছরের মধ্যে সিরোসিসের রোগী হতে পারেন।

রোগ নির্ণয়

সাধারণত লিভারে চর্বি রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না। তাই অন্য কোন কারণে চিকিৎসা নিতে বা টেস্ট করাতে গিয়ে ধরা পড়ে।

রোগ নির্ণয়ের জন্য তীব্রতা মাপার জন্য ব্লাড টেস্ট ছাড়াও পেটের আলট্রাসনোগ্রাম, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, ফাইব্রোস্ক্যান (বিশেষ এক ধরনের আলট্রাসনোগ্রাম), ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইলাস্ট্রোগ্রাফি করা হয়।

তবে লিভার থেকে টিস্যু নিয়ে (বায়োপসি) পরীক্ষা করা হল সবচেয়ে ভালো টেস্ট যা (গোল্ড স্ট‍্যান্ডার্ড) বলে বিবেচিত।

চিকিৎসা

উদ্বেগের বিষয় হলো, এখনো পর্যন্ত লিভারের চর্বি রোগ নির্মূলের কোনো কার্যকরী ওষুধ নেই। তবে অনেক ওষুধ গবেষণা পর্যায়ে আছে।

একমাত্র কার্যকারী উপায় হলো শরীরের ওজন কমানো। ওজন ১০ ভাগ কমালে লিভারের চর্বি বা ন্যাসের উন্নতি হয়। তবে ন্যাস থেকে লিভার সিরোসিস হয়ে গেলে লিভার প্রতিস্থাপনই একমাত্র কার্যকরী চিকিৎসা।

প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের উপায়

শরীরের ওজন কমানোর সাথে সাথে ডায়াবেটিস ও রক্তের খারাপ চর্বির চিকিৎসা করে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে অন্তত তিন থেকে পাঁচ দিন ব্যায়াম করতে হবে। প্রতিদিন খাদ্যে সবুজ শাক সবজি, ফলমূল শস্য, বাদাম রাখতে হবে।

চিনি-মিষ্টি, তৈল চর্বি পরিহার করা ভালো।

মদপান এবং ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে।

প্রতিদিন দুই কাপ কালো কফি খাওয়া ভালো। তবে যারা কফি পানে অভ্যস্ত নয় তাদের নতুন করে শুরু করা উচিত হবে না।

ভিটামিন ই ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এই রোগে কিছুটা কাজ করলেও এ বিষয়ে আরও গবেষণা করা দরকার।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, অতিরিক্ত ভিটামিন ই পুরুষদের প্রস্টেট গ্রন্থির ক্যান্সার ও সকলের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।

তাই আসুন সবাই লিভারের উপর থেকে বিভিন্ন ধরনের চাপ কমাই। যেমন- শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও অন্যান্য রোগের যথাযথ চিকিত্সা ও টিকা গ্রহণ করি।

পরিশেষে বলতে চাই- গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ লিভারের যত্ন করি সুস্থ থাকি।

তথ্য: মায়োক্লিনিক, যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্র

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, এমএইচ শমরিতা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ, কনসালটেন্ট (মেডিসিন, বাতরোগ ও ডায়াবেটিকস), মডার্ন আর্থ্রাইটিস কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, ধানমন্ডি, ঢাকা

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
মায়ের লাশ বাড়িতে রেখে পরীক্ষা কেন্দ্রে দুই শিক্ষার্থী 
স্পেনে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলেন লিভারপুল তারকা দিয়োগো জোতা
নির্বাচন সামনে রেখে টেলিকম নীতিমালা প্রণয়ন সমীচীন নয়: মির্জা ফখরুল 
Navigating Complexity: The Role of Chaos Theory in Management Education
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা