পণ্ডিত মশাই কোথাও চান্স পাননি

অধ্যাপক ড. ফরিদ আহমেদ
| আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:২৪ | প্রকাশিত : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:০৬

সমাজে একটি প্রচলিত কথা-যার নেই কোনো গতি, সেই করে পণ্ডিতি। আজ সেই কথাটি অনেক উপর থেকে ধ্বনিত হচ্ছে। হীরক রাজার দেশে পণ্ডিতের অবস্থা ও সক্ষমতা আমরা দেখছি। সেটা স্মরণ করিয়ে দিতে নয় বরং কিছুটা অগোছালো প্রতিক্রিয়া জানাতে আমার এই লেখা। একবার এক মহারথীর মুখে শুনেছিলাম কয়েক জেনারেশন শিক্ষক না হলে জাতের শিক্ষক হয় না। সেই মহারথী তখন জলপাই রঙের পোশাকে মোহিত ছিলেন। এখনো আমাদের দেশের মানুষ রঙিন পোশাক আর রঙিন পানির প্রতি আকৃষ্ট বোধ করে। ভালো লাগা ব্যক্তিগত। কিন্তু সেই ভালোলাগা যখন ভিন্ন চোখে দেখা হয় তখন নানা প্রশ্নর জন্ম দেয়। শিক্ষক সমাজের একজন হয়ে প্রতিবাদ করার অধিকার ও দায় দুটিই আছে বলে এই লেখা।

আমি জানি অনেক শিশু শিক্ষক হতে চায়। তাদের কিছু যুক্তি থাকে। কিন্তু আমরা তাদের সামনে এমন এক চিত্র তুলে ধরি যে তারা আর ভুলেও শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখে না। তারা হয় ক্ষমতা বা টাকার লোভী হয়ে ওঠে। সেজন্য অভিভাবক দায়ী-শিক্ষক পেশা বা শিশুর দায় নয়।

আমাদের সমাজে দেখতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন একজন ছাত্র ভালো রেজাল্ট করতে থাকে তখন ওই শিক্ষার্থীর মনে শিক্ষক হওয়ার বাসনা জাগে। গবেষণা করে কিছু আবিষ্কার করবে এরকম ভাবনাও একজন শিক্ষার্থীর মনে জাগে। সেই বাসনা না থাকলেও বন্ধু, বান্ধবীরা কিংবা শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় একজন শিক্ষক হয়। এমনকি পিতামাতাও শিক্ষক হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়। সুতরাং কোথাও চান্স না পেয়ে শিক্ষক/পণ্ডিত মশাই হন এমন যুক্তি অন্ততঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলায় খাটে না। তবে এখানে তদবির আছে। তদবির করে শিক্ষক হওয়া যায়। এই সত্যকে অস্বীকার করা যায় না।

কিন্তু সরকারি কলেজের শিক্ষক হতে বাংলাদেশে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মধ্য দিয়ে শিক্ষক হতে হয়। সেখানে কোনো তদবির চলে বলে আমার জানা নেই। সেখানে বিভিন্ন ক্যাডার আছে। কেউ হয়তো শিক্ষাকে প্রথম পছন্দ দিলেও অধিকাংশ শিক্ষাকে সবচেয়ে শেষে দিয়ে থাকে। এই পছন্দের ক্রমকে যদি গুরুত্ব দেয়া হয় তবে কোথাও চান্স না পেয়ে একজন কলেজের শিক্ষক হয়ে থাকে। যিনি শিক্ষক হন তিনি বিসিএসে কি রকম নম্বর পেয়েছেন সেটা না দেখে কি আমরা বলতে পারি কোথাও চান্স না পেয়ে শিক্ষক! একজন আমলা কিভাবে একজন শিক্ষককে কান ধরিয়েছে সেটা বোধহয় ভুলে গেছি!

বাস্তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক হন তিনি অধিকাংশ আমলাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রথম শ্রেণি পান। প্রথম শ্রেণি ছাড়া শিক্ষক হওয়া যায় কদাচিৎ। কিন্তু আমলা-মন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রথম শ্রেণির প্রয়োজন পড়ে না। গাইড ভালোভাবে পড়লেই অনেক ভালো ফল বিসিএসে করা যায়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে আমলা হয়েছেন অনেকেই। যদি তাদের প্রশ্ন করি তবে একটি সহজ উত্তর আমরা পাই তাদের কাছ থেকে। একজন অধ্যাপক বড়জোর গ্রেড-১ বেতন পেতে পারেন। তার ক্লাস বা রুমে ঢুকতে কোনো পাস লাগে না।

একজন শিক্ষক জীবনে একবার বিদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবন্ধ পড়তে আহবান পেলেও তিনি কোনোমতে একটি ইকোনমি ক্লাসে টিকিট কিনতে হয়রান হয়ে যান। আর আমলা হলে বিজনেস ক্লাস পর্যন্ত টিকিট পায়। এমনকি এখন একজন উপসচিব হলেই গাড়ি কেনার টাকা মাসে মাসে ৩০ হাজার টাকা তেল-ড্রাইভার পায়। এতো সুযোগ সুবিধা দেখে একজন শিক্ষক না হয়ে আমলা হয়।

প্রাথমিক বা মাধ্যমিকের শিক্ষকরা কি তবে কোথাও চান্স না পেয়ে শিক্ষক হয়েছেন? যদি হয়েও থাকেন তবে কি আমরা এভাবে বলতে পারি কি? আমরা তো জানি সংসদে ৩০০ সিট আছে। আমরা জানি ১০০০ আমলার পদ আছে। সুতরাং, কেউ চান্স পাবে আর কেউ পাবে না।

কিন্তু শিক্ষক হয়ে তারা শিক্ষকই হতে চান। অন্তত আমার পরিবার ও আমার শিক্ষকদের আমি জানি। তারা শিক্ষক হয়েছেন এবং শিক্ষকতা করেছেন এবং করছেন শিক্ষকতা পেশার সম্মান বিবেচনা করে। এভাবে শিক্ষকদের তবে কেন দূরে ঠেলে দেওয়া? কোনো কোনো শিক্ষকের আচরণে হয়তো আমি কষ্ট পেতে পারি -কিন্তু তাই বলে সকলকে এভাবে?

আমরা শিক্ষকদের দায়ী করছি এজন্য যে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিংয়ে নেই। আমরা সকলেই জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রো উপাচার্য , ট্রেজারার , সিন্ডিকেট মেম্বার সরকার দিয়ে থাকে। আর সেই নিয়োগ কিভাবে পেতে হয় তাও সকলে জানে। রাজনীতি সেখানে প্রধান পরিচয় হয়ে উঠে। ওইরকম বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়কে র‌্যাংকিংয়ে নিতে হলে হাত কানে দিয়ে নামাজের যেমন নিয়ত করতে হয় তেমনি করতে হবে যা বাংলাদেশে সম্ভব হয়েছে কি?

এই লেখা যখন লিখছি তখন এমন একজনের একটি ফোন পেলাম যে কিছু তথ্য চেয়ে ফোন করল। সে সেগুলো চায় তার ছাত্রদের দিতে। সে যখন বিসিএসে আবেদন করেছিল তখন জীবনের সবশেষ বিসিএসে সবশেষে শিক্ষা ক্যাডার দিয়েছিল। সে কোথাও চান্স না পেয়ে শিক্ষক হয়েছেন। কিন্তু শিক্ষক হয়ে তিনি বদলে গেছেন। যে তথ্য তিনি আমাকে দিতে বলেছেন তা না দিয়েই শিক্ষকতা তিনি করতে পারেন।

সুতরাং শিক্ষকদের যদি শিক্ষায় নিয়োজিত করতে হয় তবে মেধাবিদের শিক্ষায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। মুখে মুখে শিক্ষকদের সম্মান করি বললেই হবে না। তাদেরকে সম্মানের সঙ্গে চলবার সুযোগও দিতে হবে। বিগত পে কমিশনের চেয়ারম্যান জনাব ফরাসউদ্দিন শিক্ষকদের সর্বোচ স্কেল দেওয়া নিয়ে বলেছিলেন ব্রিটিশ আমলেও আমলাদের বেতন শিক্ষকদের উপরে ছিল।

দেশে এখন ঘি আর তেলের মূল্য সমান। সেখানে কি আশা করা যায়? যতদিন আমরা আমলাদের তোষামোদ করবো -মানে সৈয়দ মুজতবা আলীর স্কুল ইন্সপেক্টর যেখানে( সাহেবের তিন পায়া কুকুর সম্পর্কিত ঘটনা) সালাম পাবে সেখানে শিক্ষক ভালো কিছু দিতে ব্যর্থ হবে। আমাদের সমাজে মেয়েকে দেওয়া হয় মুরগির পাখনা আর বাবাকে দেওয়া হয় রান। এই বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থায় র‌্যাংকিং একটি স্বপ্ন যাকে কোনোদিন ছোয়া যাবে না।

শিক্ষকরা জাতির মেরুদণ্ড নির্মাণে অগ্রপথিক। তাদের সম্মান ক্ষুণ্ন করে কি পাওয়া যাবে আমি জানি না। তবে জাতি আরও পিছিয়ে পড়বে অনুমান করা যায়। শিক্ষকদের কষ্ট দিয়ে জীবনে কেউ কি সুখী হতে পেরেছেন? মেডিকেল কলেজের শিক্ষকরা কি কোথাও চান্স না পেয়ে শিক্ষক হয়েছেন? দয়া করে এভাবে শিক্ষকদের কষ্ট না দেওয়ার অনুরোধ করতে পারি কি? সমাজে অনেক গুরুজন আছেন যারা শিক্ষক ছিলেন। তাদের অন্তত শিশুদের কিংবা দুর্জনের সামনে এভাবে উন্মোচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পণ্ডিত মশাই হয়তো শিক্ষক হতে চাননি। হয়তো আমলা হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পণ্ডিত মশাই দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বানাতে পারেন।

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :