প্রশ্নপত্র ফাঁস: পুলিশ-মিডিয়ার মিথস্ক্রিয়া

মোল্লা নজরুল ইসলাম
  প্রকাশিত : ২৪ নভেম্বর ২০২১, ০৮:২০
অ- অ+

ভর্তি, নিয়োগ কিংবা পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস দেশের জন্য অভিশাপ তো বটেই, ভয়ানক এক মহামারির নামও। যে মহামারি অজস্র মেধাবীর স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিয়ে গোটা জাতিকে মেধা ও মেরুদণ্ডহীন করে তোলে।

সিআইডির অর্গানাইজ ক্রাইমে যোগ দেওয়ার পর অন্যান্য অপরাধের মতো নজর ছিল এই মহামারি ঠেকানোয় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দিকেও। কেননা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সে সময় প্রশ্নফাঁস বন্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী দিচ্ছিলেন।

এমনই এক সময়ে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের অনুসন্ধানী দল আসে আমার কাছে। কথা হয় অনুসন্ধানী সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল ইমরানের সঙ্গে।

ইমরান আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই। ভীষণ উদ্যমী এবং পরিশ্রমী ছেলে। লেখক হিসেবেও তার নাম-ডাক আছে। আছে দেশ, সমাজ ও নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কমিটমেন্ট। সেই কমিটমেন্টের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি জালিয়াতির গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইন্টেল নিয়ে হাজির হয় আমার কাছে। আমিও আগ্রহী হয়ে উঠি। সবাইকে আরও এগোতে বলি।

২০১৭ সালের অক্টোবরে ইমরান অনুসন্ধানটি আরও ম্যাচিউর করে নিয়ে আসে। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী পাঠিয়ে চক্রের তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করে। একদিন পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ঘ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা। সে রাতেই অপারেশন করতে হবে, তাও আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলে।

আমার বেশ আগ্রহ থাকলেও টিমের অন্য সদস্যরা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়ে। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং প্রক্টোরিয়াল টিমের অনুমতি ও সহযোগিতা ছাড়া অপারেশন করা ঠিক হবে না বলে জানায়। আমি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিয়ে ইমরানকে জানালে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের অনুমতি জোগাড় করে পুরো প্রক্টোরিয়াল টিম নিয়ে সে আমার অফিসে হাজির হয় এবং ভিসি স্যারের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। ওর এমন নাছোড়বান্দা মানসিকতায় মুগ্ধ হয়ে বৃহৎ এক অপারেশনাল টিম সাজাই।

তারপর বেরিয়ে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নফাঁসের চাঞ্চল্যকর সব খবর। ৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করি আমরা। ৮৭ জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ।

বলতে দ্বিধা নেই, একটার পর একটা লেয়ার মিলাতে গিয়ে আমার অফিসাররা ক্লান্ত হয়ে গেলেও ইমরান কখনো থেমে যায়নি। ইমরান ও তার দলের প্রতিটা স্টেপের পরিকল্পনা, মাঠপর্যায়ে প্রাপ্ত তথ্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ, টার্গেট লোকেট করার কৌশল, সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো।

একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি।

ইমরানের অনুসন্ধান ফলো করে সেবার রাজশাহীতে এক দিনের অপারেশনে গিয়ে নাটোর, পাবনা হয়ে আমাদের টিম ফিরল ৫ দিন পর। ভেবেছিলাম এবার ঠিকই উৎসটা মিলে যাবে। কিন্তু তিনজন আসামি ধরা গেলেও কোথা থেকে প্রশ্নটি ফাঁস হয়, সেটি আর মেলানো গেল না। বের হলো আরও একটি লেয়ার। এবার তাই যেতে হবে জামালপুর।

টানা অপারেশনে আমার অফিসররা খুবই ক্লান্ত, কিছুটা বিরক্তও। কিন্তু ইমরান নাছোড়বান্দা। সে জামালপুর যাবেই যাবে। আমি তাকে বিরতি নিতে বললাম। সে মন খারাপ করে আমার টেবিলের সামনে বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে গেল। চেহারার দিকে তাকানো যায় না। আমার খুব খারাপ লাগল। প্রতিটা অপারেশনে অফিসার বদল হলেও অনুসন্ধান যেহেতু ইমরানের, ওর বিশ্রামের সুযোগ ছিল না। প্রায় দুই মাস ধরে ও ছুটছে তো ছুটছেই।

ভাবলাম এত পরিশ্রমের পরও যেহেতু বিশ্রাম নিতে চায় না, কাজটা এগিয়ে নিতে চায়, ওর এই অদম্য মানসিকতাকে সম্মান জানানো উচিত। আমি নতুন আরেকটি টিম সাজিয়ে দিলাম। ওরা জামালপুর গেল।

এবং পরিশ্রমের ফলও পেল। সেই অপারেশনে গ্রেপ্তার হওয়া সাইফুল জানাল, ঢাকার ইন্দিরা রোডের একটি প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করত সে এবং প্রেস কর্মচারী খান বাহাদুর। ওই দিন ইমরান যদি অতটা অবুঝের মতো প্রেশার না দিত, অমরা নিশ্চিত বিরতিতে যেতাম, তাহলে এই চক্রটি বের করতে আরও দেরি হতো কিংবা কখনোই হয়তো বের করা যেত না!

আমাদের এই কাজে দিকনির্দেশনা ও সাহস দিয়ে মাথার ওপর সব সময় বটগাছ হয়ে ছিলেন মাননীয় আইজিপি স্যার ও মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন ফাঁসের এই চক্র থেকেই সারা দেশের সব ধরনের প্রশ্ন ফাঁসকারী মাফিয়াদের একটা ডাটাবেজ দাঁড়িয়ে যায়, যেটি ইমরান খুব নিরলসভাবে সংরক্ষণ ও অনুসরণ করেছে।

সেখান থেকেই সে বের করে এনেছে মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসের ভয়ংকর চক্রটিকে। দেখিয়েছে কীভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেসের মেশিনম্যান সালাম এবং তার পরিবার বিশাল এক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিল।

এবার ডিবি পুলিশ ও তার টিম বের করে আনল ব্যাংক নিয়োগের প্রশ্ন ফাসকারী বৃহৎ এক চক্র। তাদের যৌথ অনুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে অপারেশনে নামল ডিবি। মূল হোতারা গ্রেপ্তার হলো। খবর প্রচারের পর পরীক্ষা বাতিল করল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমরা জানলাম বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষকও এ চক্রে জড়িত!

ইমরান ও তার দল যখন সিআইডিতে আমাদের সঙ্গে কাজ করেছে, সিআইডি দেশের প্রশ্ন ফাঁসকারী বড় বড় চক্রকে আইনের আওতায় এনেছে। পুলিশ-মিডিয়ার যৌথ পরিশ্রমে উপকৃত হয়েছে দেশ।

ইমরান এবার তার অনুসন্ধানের তথ্য-উপাত্ত ডিবির সাথে শেয়ার করায়, সম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য পেয়েছে ডিবি। সমুন্নত হয়েছে পুলিশের ভাবমূর্তি। আমার ভালো লাগছে এই ভেবে যে, যে কাজ আমরা শুরু করেছিলাম, ইমরান সেটি ধরে রেখেছে এবং সর্বশেষ এ কাজে আমার ক্ষুদ্র সহযোগিতা থাকায় আমিও বেশ পুলকিত।

পুলিশ এবং গণমাধ্যম দীর্ঘদিনের বন্ধু। তারা একে-অপরের পরিপূরকও। হুইসেল ব্লোয়ার মিডিয়া এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ কাজে দেশ ও জনগণের মঙ্গল সুনিশ্চিত। গণমাধ্যমের কাজও যে পুলিশের প্রেরণা হতে পারে, অনুসরণীয় হতে পারে তার অনেক অনেক উদাহরণ আছে। ইমরানের কাজগুলো তার সর্বশেষ সংযোজন।

তরুণ লেখক ও অদম্য সাংবাদিক স্নেহের আবদুল্লাহ আল ইমরানকে পুলিশ পরিবারের পক্ষ থেকে অভিনন্দন। এই অভিনন্দন অবশ্য তার প্রাপ্য।

লেখক: অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
রাজনীতিতে অভিভাবক দল হিসেবে আমরা বারবার ধৈর্য ধরেছি: অধ্যক্ষ সেলিম ভুইয়া
এনবিআরের আরও ৬ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বরখাস্ত
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে শিক্ষা উপদেষ্টার আশ্বাস
তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আরও একজন গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা