সুপরিকল্পিত পরিবার গঠন জাতির উত্তরণের প্রধান সোপান

মো. মাহমুদ করিম
 | প্রকাশিত : ০৮ মার্চ ২০২২, ২১:১১

আমরা যদি সমাজের কোনকিছু নিয়ে ভাবি তবে পরিবারকে নিয়ে সবার আগে ভাবতে হয়। পরিবার হলো রাষ্ট্রের সবচাইতে ক্ষুদ্রতম একক একটি সংগঠন, যা রাষ্ট্রের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর তথা জাতিকে উন্নতরুপে গঠনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে পরিগণিত হয়। এখানে পরিবারের উৎপত্তিগত স্থলে যদি আমরা বিবেচনা করি তবে দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ এবং নারীর মধ্যে বিবাহ সংগঠিত হয়। বিবাহ চুক্তি যদি দুজনের মাঝে একটি পরিকল্পিত সামাজিক সেতুবন্ধন, আচার ও রীতিসিদ্ধ এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার মাধ্যমে সংযোজিত পরিবারই সঠিকভাবে নির্দিষ্ট অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করা যায়।

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার আলোকে পারিবারগুলো যেভাবে গঠিত হচ্ছে এতে নানা অমিল, অপ্রত্যাশিত ঘটনার ইতিবৃত্তি, নির্যাতন, পারষ্পরিক বিবাদ, আশান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করছে। পরিবারগুলো এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো পরিকল্পিত উপায়ে পরিবারগুলো গঠন করা এবং নির্দিষ্ট অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে তাদের পরিচালিত করা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে পরিবারগুলোকে সুনিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালনা করে পরিবার থেকে সমাজ, দেশ ও দেশের জনগোষ্টিকে সুসংঘত করা ও মানসম্মত জাতি গঠনের প্রক্রিয়া সুনিশ্চিত করা।

পরিবার গঠনের আধুনিক রুপ: আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম মুঠোফোন, এই মুঠোফোনের সিম কিনতে আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করা হয়। বিবাহ বন্ধনে দুজন পুরুষ ও নারী যখন একত্রিত হচ্ছে এই চুক্তি প্রক্রিয়া সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে হচ্ছে না। দেশের বিবাহ ব্যবস্থা ও আইন এমন বন্ধুর অবস্থায় রয়েছে যে, একজন মানুষ দেশের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে দুই, চার বা দশটি ও বিয়ে করে ফেলতে পারে কিন্তু তাতে ধরার উপায় নেই। এভাবে একজন মানুষ একাধিক বিয়ে করে সমাজে অসংগতি সৃষ্টি করছে। গার্মেন্টসগুলো গার্মেন্টস কর্মীরাকে কোন জেলা থেকে আসছে, কে কাকে বিয়ে করছে, কে কাকে ছেড়ে কোথায় চলে যাচ্ছে ওদের সন্তান ফুটপাতে কোথায় পড়ে থাকছে তার কোন হদিস নেই।

তাই বিবাহ আইন ও নিয়মগুলো নতুন সংরক্ষণ একান্তই প্রয়োজন। যদি বিবাহ বন্ধন প্রক্রিয়া ফিঙ্গারপ্রিন্ট তথা আঙুলের ছাপের মাধ্যমে সংগঠিত হয় এবং দশটি আঙ্গুলের ফিঙ্গারিং সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে অনলাইন বিবাহ, রেজিষ্ট্রেশন চালু করা যায় তবে এই রেজিষ্ট্রেশনগুলো শুধু বিবাহচুক্তি নয় বরং দুইটি পরিবার থেকে দশজন করে সদস্য উভয়পক্ষের একত্রিত হবে। উপভয়পক্ষের এলাকা ওয়ার্ড কমিশনাররা অবশ্যই থাকবে এবং পারিবারিক সদস্যদের মত বিনিময় সভা সকল প্রকার বৈধ আলোচনা দুই পরিবারের দশজন দশজন সদস্যদের মধ্যে সংগঠিত হবে। ধর্মীয় সংস্কারের বিবাহ আইন মেনে এটি আধুনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবাহ সংগঠিত হবে।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত জীবন বিমা কর্পোরেশন, বিমা পলিসির মাধ্যমে অনলাইন বিাবহ বিমা নামে একটি বিমা হিসাব খোলা হবে, যাতে স্বামী তার স্ত্রীকে মোহরানা তথা অনান্য পাওনাদি বাবদ যে টাকা দেওয়া হবে বলে নির্ধারিত তা দশবছর মেয়াদ নিয়ে নির্দিষ্ট প্রিমিয়াম এর মাধ্যমে ভাগ করে মাসিক, ত্রিমাসিক, অর্ধবার্ষিক, বা বার্ষিক প্রিমিয়াম রূপে ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। এতে যেমন একটি পরিবার এর একজন পুরুষ অপর এক পরিবারের একজন নারীর দায়িত্ব গ্রহণ করবে তেমনি উভয়ের পরিবারিক বা সাংসারিক জীবন মান উন্নয়নের জন্য দশবছর মেয়াদি এই বিমা সামনের দিনগুলোতে বিশ বা ত্রিশ বছরে উন্নীত হবে এবং তাদের পরিবারিক চুক্তি আরও দৃঢ় হবে ও নবগঠিত পরিবারটি দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং নির্দিষ্ট অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকবে। পরিবারের নতুন সদস্য যখন আসবে তখন তারা তাদের জন্য শিক্ষাবীমা, চিকিৎসা বিমা, আরো ও অন্যান্য বিমা পলিসি গ্রহণ করে, ভবিষ্যৎ উন্নত থেকে উন্নততর পরিবারে রূপান্তিত হওয়ার অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে তাদের পরিচালনা করার দৃষ্ঠিভঙ্গি তৈরি হবে।

উল্লেখ্য যে, একজন কুলি, মজুর, কৃষক, জেলে, তাঁতী, শিক্ষক, উকিল, ডাক্তার সকলে এই দশ বছরের চুক্তির টাকা ধর্ম ও সামাজিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন অনুপাতে হিসাব করা হবে। কোনো অস্থাতেই এই নীতি এমন অবস্থান তৈরি করবে না যে, উক্ত বিমা কিস্তি দিতে উক্ত কর্মজীবী পুরুষদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয়। অন্য ভাবনায় কেউ যদি দ্বিতীয় বিবাহ বা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে চায় তবে এটি আইনি প্রক্রিয়ায় উক্ত পরিবারের পুরুষকে দশবছরের পূর্ণ প্রিমিয়াম প্রদান সাপেক্ষে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে হবে।

অর্থাৎ উক্ত নারীর ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তাকে পূর্ণতা দেবে। দ্বিতীয় বিবাহের ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে করতে পারবে সেক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর প্রিমিয়াম ঠিক রেখে দ্বিতীয় স্ত্রীর নতুন প্রিমিয়াম বা দশ বছরের পূর্ণচুক্তি সম্পাদন করতে হবে। প্রকাশ থাকে যে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে তিনি যে, জীবনবীমা সংগঠনটি প্রতিষ্ঠীত করেছিলেন তা দেশের অর্থ‣নতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের পক্ষে যে চিন্তাটি করেছেন তা তাদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করে। তারই ধারাবাহিকতায় একটি স্বপ্ন নিয়ে সকল পরিবারের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য জীবনবীমা প্রতিষ্ঠানটিকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের পরিবারগুলোকে উন্নতরূপে গঠন করা সম্ভব।

গুণীজনদের কিছু কথা: যদি এই পরিকল্পনা করা হয় যে, সকল নব্য বিবাহ সম্পন্ন পরিবার গুলোকে সুপকল্পিত উপায়ে সুসংঘবদ্ধ করতে পারলে এই সুনিয়ন্ত্রিত পরিবার, সুগঠিত সমাজ, জাতি ও দেশ গঠনের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করবে। যেমনটি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন অনুযায়ী জাতিগত উত্তরণের পথকে সুগম করবে।

অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির দার্শনিক অমর্ত কুমার সেন এর মানব উন্নয়ন তত্ত্বের হিসেবেও আমাদের সুপারিকলিল্পত পরিবার বেশ ফলপ্রসূ হবে। এতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখিত ব্যবস্থা শুধু পরিবারকে গঠন করবেনা বরং সমাজকে একটি নির্দিষ্ট গতিতে পরিচালিত করবে।

অন্যদিকে এটি বাংলাদেশে অর্থনীতিতে স্বনির্ভরতা আনবে। প্রতিটি পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল এবং খাদ্য, বস্ত্র বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা অর্থাৎ মৌলিক অধিকার সম্পন্ন হওয়ার নিশ্চয়তাকে অর্জন করবে। সকল পরিবার দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক জোনের আওতায় চলে আসবে। যার দুরুন, সামাজিক উন্নয়নের দর্শনগত রূপ প্রতিফলিত হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃষিভিত্তিক পরিবারকগুলোর উন্নয়নের নানাবিদ উদ্বযোগ গ্রহণ করেছিলেন।

বাংলাদেশের নওগাঁর প্রতিসরে কৃষকদের জন্য কৃষিঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন, যার ফলে পুঁজির অভাবে যে সকল কৃষকের কৃষি কাজ ব্যহত হত তা দূরীকরণে সূদুর প্রসারী ভূমিকা রেখেছিলেন যা কৃষক পরিবারগুলোর জীবন মান উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। রাজা রাম মোহন রায়ের সতিদাহ প্রথা উক্ত বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত যা সংস্কারের ফলে নারী অধিকার তথা পারিবারিক রিতিনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে।

কুরআন হাদীস এর আলোকে বিবাহ বিষয়ক আলোচনা:

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো- ‘তিনি তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জীনসঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ করতে পারো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম, আয়াত: ২১)

“আর তোমরা তোমাদের মধ্যে অবিবাহিত নারী-পুরুষদের বিবাহ দাও।” (সুরা নুর, আয়াত: ২৪:৩২)

“পুরুষরা নারীঅদের তত্ত্বাধায়ক, এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা নিজেদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে।” (সুরা নিসা, আয়াত ৩৪)

বহুবিবাহ: “তোমরা বিয়ে কর নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভাল লাগে; দু’টি, তিনটি অথবা চারটি। আর যদি ভয় কর যে, তোমরা সমান আচরণ করতে পারবে না, তবে একটি।” (সুরা নিসা, আয়াত ৩)

মোহরানা: “আর তেমরা নারীদেরকে সন্তষ্টচিত্তে তাদের মোহর দিয়ে দাও।” (সুরা নিসা, আয়াত ৪)

“তোমরা তাদেরকে বিয়ে করলে তোমাদের কোন অপরাধ হবে না, যদি তোমরা তাদেরকে তাদের মোহর প্রদান কর।” (সুরা মুমতাহিনা, আয়াত: ১০)

হাদীসের আলোকে: রাসুল (সা.) বলেন, “ অভিভাবক ও দইজন সাক্ষী ছাড়া কোন বিবাহ নেই।” (সহিহ জামে, হাদিস নং: ৭৫৫৮)।

রাসুল (সা.) বলেন, “যে নারী তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করবে তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল।’ (তিরমিজি, হাদিস নং: ১০২১)

“হযরত খানসা বিনতে খিযাম (বা খিদাম) (রা.) এর একবার বিয়ে হয়েছিল। এরপর তিনি স্বামীহীন হন। এমতাবস্থায় তার পিতা তাকে অন্য এক ব্যক্তির সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু হযরত খানসা এ বিয়ে পছন্দ করেননি। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে তাঁকে একথা জানালেন। ঘটনাটি শোনার পর নব করীম (সা.) এ বিয়ে বাতিল করে দিলেন।” (বুখারী)

মুসলিম পারিবারিক আইন ও বিধিমালা: বহুবিবাহ (১): কোন লোকের বিবাহ বলবৎ থাকিতে সে সালিশী কাউন্সিলের লিখিত পূর্বানুমতি ব্যতীত অন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইতে পারিবে না বা ঐরূপ অনুমতি ব্যতীত অনুষ্ঠিত কোন বিবাহ ১৯৭৪ সনের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিষ্ট্রেশন) অধ্যাদেশ-এর অধীনে রেজিষ্ট্রিকৃত হইবে না।

তালাক (১): কোন লোক তাহার স্ত্রীকে তালাক দিতে ইচ্ছা করিলে যে কোন প্রকারেই হউক তালাক উচ্চারণ করিবার পরেই সে তালাক দিয়াছে বলিয়া চেয়ারম্যানকে লিখিত নোটিশের মাধ্যমে জানাইবে ও স্ত্রীকেও উহার একটি কপি পাঠাইবে।

এইভাবে আধুনিক পরিকল্পিত মতানৈক্যের ভিত্তিতে গঠিত পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে যা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ নির্মানের দৃঢ় প্রতিজ্ঞাকে রাস্তবায়নের লক্ষ্যে পৌছে দেবে। এই ধরনের পরিবারের ভিত্তি যেমন মজবুত হবে তেমনি তাদের মাধ্যমে জাতিগত উন্নয়নের ঐক্য হবে সুবিশাল।

তথ্য নির্দেশ

১. বঙ্গবন্ধু সমগ্র জীবন হতে সংগৃীহিত।

২. রাজা রাম মহন রায় এর সমাজ সংস্কার আইন।

৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কৃষিভিত্তিক পরিবার গুলোকে নিয়ে পরিকল্পনা।

৪. অমর্ত কুমার সেন এর মানব উন্নয়ন তত্ত্ব।

৫. রাষ্টতত্ত্ব ও সংগঠন।

৬. আল-কুরআন, বিবাহ: (সুরা রুম, আয়াত: ২১), (সুরা নুর, আয়াত: ২৪:৩২), (সুরা নিসা,

আয়াত ৩৪)।

৭. আল-কুরআন, বহুবিবাহ: (সুরা নিসা, আয়াত ৩), (সুরা নিসা, আয়াত ৪), (সুরা মুমতাহিনা,

আয়াত: ১০)

৮. হাদীসের আলোকে: (সহিহ জামে, হাদিস নং: ৭৫৫৮), (তিরমিজি, হাদিস নং: ১০২১),

৯. বুখারী ঘটনা প্রবাহ

১০. মুসলিম পারিবারিক আইন ও বিধিমালা: বহুবিবাহ (১), তালাক (১)

লেখক: শিক্ষক, কবি ও শিল্পী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মুক্তমত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :