শিক্ষাসনদ-এনআইডি-ড্রাইভিং লাইসেন্স সবই জাল বানাতেন তারা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২২ মার্চ ২০২২, ১৫:২৯

ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জাল সার্টিফিকেট ও অন্যান্য জাল নথিপত্র তৈরি চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। চক্রটি নির্বাচন অফিস ও বিআরটিএ অফিসের সামনে অবস্থান করে গ্রাহকদের টার্গেট করে এসব কাজ করত। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সরকারি বিভিন্ন অফিসের হুবহু জাল ভাউচার ও মানি রিসিট দিতেন চক্রের সদস্যরা।

চক্রটি গত ১০ বছর ধরে বিপুল পরিমাণ ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স বানিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৩ কোটি টাকা।

সোমবার র‌্যাব-৩ এর অভিযানে রাজধানীর মালিবাগ, বাসাবো, শাহজাহানপুর ও কোতয়ালী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তারা হলেন- প্রতারণা চক্রের মূলহোতা মো. গোলাম মোস্তফা, মো. জালাল বাশার, মো. মুসলিম উদ্দিন, মো. মিনারুল ইসলাম মিন্নি ও মো. তারেক মৃধা।

অভিযানে তাদের কাছ থেকে দুটি কম্পিউটার, দুই হাজার ৪৬০টি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের জাল ভাউচার রশিদ, ২৬টি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, ১টি ল্যাপটপ, ১টি ডিজিটাল ক্যামেরা, ১৮টি ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স, ৮০টি সাদা রঙের প্লাস্টিকের ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরির ব্ল্যাঙ্ক কার্ডসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

মঙ্গলবার দুপুরে কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু রোহিঙ্গা নাগরিক এক শ্রেণির অসাধু চক্রের মাধ্যমে ভুয়া এনআইডি কার্ড পান। এছাড়া কয়েকজন জঙ্গি সদস্য আত্মগোপনের উদ্দেশে ভুয়া এনআইডির মাধ্যমে পাসপোর্ট তৈরি করে বিভিন্ন দেশে গিয়ে নানান অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সেসব দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বেশকিছু দীর্ঘদিনের পলাতক আসামি গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। সেখানে আমরা দেখেছি তারা নিজেদেরকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য ভিন্ন নামে ভুয়া এনআইডি কার্ড তৈরি করে নিজের প্রকৃত পরিচয় আড়াল করে অন্যত্র বসবাস করছেন।

সম্প্রতি রাজধানীতে বেশ কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে খন্দকার আল মঈন বলেন, আমরা ঘাতক পরিবহনের চালকদের গ্রেপ্তারে দেখেছি তাদের অনেকেই অপরিপক্ক চালক এবং তারা ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স সংগ্রহ করে পরিবহন চালাচ্ছে।

সম্প্রতি দেখা যায়, কয়েকজন অসাধু ব্যক্তি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপণের মাধ্যমে বিভিন্ন দ্রব্য বেচাকেনার পাশাপাশি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ভুয়া এনআইডি কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, বিভিন্ন প্রকার জাল সনদ তৈরি করে আসছে। বিজ্ঞাপনটি র‌্যাবের সাইবার মনিটরিং সেলের নজরে এল র‌্যাব ওই চক্রের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।

র‌্যাব মুখপাত্র বলেন, চক্রে ৫-৭ জন সদস্য রয়েছে। তারা গত ৮ থেকে ১০ বছর ধরে ভুয়া জাতীয় পরিচয় পত্র, ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জাল সার্টিফিকেট ও অন্যান্য জাল নথিপত্র তৈরি করে আসছে। গ্রেপ্তার মোস্তফা এই চক্রের মূলহোতা, বাকিরা তার সহযোগী। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন নির্বাচন অফিস ও বিআরটিএ অফিসের সামনে অবস্থান করে গ্রাহকদের টার্গেট করত। পরবর্তীতে তাদেরকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিয়ে প্রতারণা করত। বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জনে তারা হুবহু জাল প্রাপ্তি স্বীকার পত্র ও মানি রিসিটটি বিআরটিএ ও বিভিন্ন ব্যাংকসহ ভুয়া সিল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করে গ্রাহককে প্রদান করত।

‘একইভাবে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে চটকদার বিজ্ঞাপন পোস্ট করত। পরবর্তীতে কোনো গ্রাহক তাদের সঙ্গে এনআইডি/ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য যোগাযোগ করলে তারা তাদের মধ্যে কেউ গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুততম সময়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স/এনআইডি প্রাপ্তির অফার দিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করার ক্ষেত্রে তার ফেক আইডি ব্যবহার করত। তারা প্রতিটি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা দাবি করত। এছাড়া দ্রুত এনআইডি/ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের জন্য ক্ষেত্র বিশেষ তারা ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা দাবি করত। এক্ষেত্রে তারা মোটরসাইকেল রাইডার, লাইসেন্সবিহীন বিভিন্ন গাড়িচালক যারা দ্রুত সময়ের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স/এনআইডি পেতে আগ্রহী অথবা যারা অবৈধভাবে লাইসেন্স/এনআইডি প্রত্যাশী তাদের টার্গেট করত।

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য তারা সাধারণত বিভিন্ন বিআরটিএ অফিস, নির্বাচন কমিশন অফিস বা সংশ্লিষ্ট অফিসের আশেপাশে দেখা করত। পরবর্তীতে তারা ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স/এনআইডি সরবরাহ করত। জরুরি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে তারা একদিনের মধ্যেই সরবরাহ করত। তারা মোবাইল ব্যাংকিং বা সরাসরি অর্থ লেনদেন করত।

তিনি বলেন, গ্রেপ্তার গোলাম মোস্তফা এ চক্রের মূলহোতা। তিনি এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। পরবর্তীতে ৩০ বছর আগে সে ঢাকায় আসে। ঢাকায় এসে সে ডেন্টাল মেডিকেল কলেজ থেকে এক্সরে মেশিন টেকনিশিয়ানের এক বছরের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে সে একটি ক্লিনিকে ৫ থেকে ৭ বছর এক্সরে মেশিন টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরি করে। এরপর ২০০০ সালে সে নিজে একটি এক্সরে মেশিন নিয়ে ছোট দোকান দেয়। ২০১০ সালে তিনি প্রতারণার সঙ্গে জড়িত হয়। তার একাধিক লেগুনা গাড়ি রয়েছে। একই ধরণের প্রতারণায় তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে এবং একাধিকবার তিনি কারাবরণও করেছেন।

গ্রেপ্তার মিনারুল ২০২০ সালে জামালপুরের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে টেক্সটাইল ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। সে ১ বছর ধরে এই চক্রের সঙ্গে কাজ করছেন। সে কম্পিউটার অভিজ্ঞ ও ভুয়া এনআইডি কার্ড ও ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ জাল সার্টিফিকের তৈরির ক্ষেত্রে গ্রাফিক্স ও ডিজাইনের কাজ করতেন।

গ্রেপ্তার মুসলিম জন্ম থেকেই ঢাকায় বসবাস করছেন। তিনি প্রাথমিকভাবে লেগুনাসহ বিভিন্ন সিএনজি এর চালক হিসেবে কাজ করছেন। গত ৮ থেকে ১০ বছর ধরে সে পুরাতন মোটরসাইকেল কেনা বেচাসহ বিআরটিএ ও নির্বাচন অফিসের সামনে থেকে গ্রাহক সংগ্রহ, যোগাযোগ ও কার্ড তৈরির পর সরবরাহসহ বিভিন্ন প্রতারণার কাজ করতেন।

গ্রেপ্তার জালাল গত ১৫ বছর ধরে ঢাকায় বসবাস করছেন। সে প্রথমে প্রেসে কাজ করত। পরবর্তীতে আদালতের সামনে দালালি করতেন। গত ৫ থেকে ৭ বছর ধরে সে এই প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত হয়। গ্রাহক সংগ্রহ, যোগাযোগ ও কার্ড তৈরির পর সরবরাহসহ বিভিন্ন প্রতারণার কাজ করতেন।

তারেক পেশায় গত এক বছর ধরে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। আগে দুই তিন বছর ধরে বিভিন্ন চিপস্ কোম্পানির মার্কেটিংয়ের কাজ করেছেন। গ্রাহক সংগ্রহ, যোগাযোগ ও কার্ড তৈরির পর সরবরাহসহ বিভিন্ন প্রতারণার কাজ করতেন। চক্রের সঙ্গে এনআইডি ও বিআরটিএর কোনো অসাধু কর্মকর্তা জড়িত আছে কি না এমন প্রশ্নে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সরকারি কোনো অসাধু কর্মকর্তা জড়িত নেই, তবে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছি কিছু চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা জড়িত।

ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে সিম ও পাসপোর্ট করেছে কি না এই প্রশ্নের জাবাবে তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, ভুয়া এনআইডি দিয়ে সিম ও পাসপোর্টও তৈরি করেছে আগে। তবে এখন তা আর হয় না।

ঢাকাটাইমস/২২মার্চ/এসএস/ইএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজধানী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজধানী এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :