রোগ প্রতিরোধে সামুদ্রিক মাছের ম্যাজিক

মাছ ও ভাতের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক বহুকালের। আদিকাল থেকেই মাছ খেতো বাঙালি। মাছের সঙ্গে ভাতের সম্পর্ক নিবিড় হওয়ার কারণটি হলো বাঙালির মুখ্য খাদ্য ভাত এবং দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় পছন্দের পদ মাছ। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই মাছ খাওয়ার ব্যাপারে যতোটা সচেতন, সামুদ্রিক মাছের ক্ষেত্রে তাদের ততোটা উৎসাহ দেখা যায় না। এর একটা বড় কারণ সামুদ্রিক মাছের স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে না জানা।
সামুদ্রিক মাছ এর পুষ্টিগুণ মিঠা পানির মাছের তুলনায় বেশি। আমাদের দেশে সারা বছরই বাজারে বিভিন্ন জাতের সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। সামুদ্রিক মাছের মধ্যে রয়েছে- ইলিশ, কোরাল, রূপচাঁদা, বাইলা, চিংড়ি, ফোঁপা, লইট্টা ও লাইখ্যা, টুনা, সার্ডিন, স্যামন, ট্রাউট, হেরিং, কড ইত্যাদি। প্রজাতি ভেদে সামুদ্রিক মাছ এর স্বাদও ভিন্ন হয়। কিন্তু পুষ্টিগুণ বিচারে সব সামুদ্রিক মাছই অনন্য।
সামুদ্রিক মাছে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন এ এবং ভিটামিন ডি। এছাড়াও মাছে চর্বি, খনিজ তেল, আয়রণ, ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস পাওয়া যায়। মাছের শতকরা ২৩ ভাগই আমিষ। এসব পুষ্টি উপাদান অনেক জটিল রোগ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করে থাকে। সামুদ্রিক মাছ এর আরেকটি স্বাস্থ্যকর দিক হলো এটি খুবই কম-ক্যালোরি যুক্ত খাবার।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সামুদ্রিক মাছ হার্ট-অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং উচ্চ-রক্তচাপের ঝুঁকি কমায়। শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক গঠনে বেশ ভূমিকা পালন করে। চলুন জেনে নেয়া যাক সামুদ্রিক মাছের অবিশ্বাস্য পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সর্ম্পকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য।
ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডের ভান্ডার
ওমেগা-৩ নামক অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড থাকে যা রক্তের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল এলডিএল ও ভিএলডিএল কমায় এবং উপকারী কোলেস্টেরল এইচডিএল বাড়িয়ে দেয়। ফলে হার্টের রক্তনালীতে চর্বি জমতে পারেনা এবং রক্তনালী পরিষ্কার, সুপরিসর অবস্থায় থাকায় রক্ত চলাচল বাঁধাহীন থাকে। অর্থাৎ ওমেগা–৩ রক্তে ট্রাইগ্লসারাইডের পরিমাণ এবং রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা কমায়। এই ফ্যাটি এসিড রক্তচাপের তীব্রতাও কমায়। ফলে ওমেগা–৩ নিয়মিত খেলে এটি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক প্রতিরোধে সহায়ক হয়। এ ছাড়া এই ফ্যাটি এসিড প্রদাহও কমায়।
অটোইমিউইন ডিজিজের ঝুঁকি কমায়
অটোইমিউন ডিজিজ হলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম ভুল বশতঃ শরীরের সুস্থ কোষের উপর আক্রমণ চালিয়ে সেগুলো ধ্বংস করে। টাইপ ১ ডায়াবেটিস, লুপাস, সিলিয়াক ডিজিজ, সোরিয়াসিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি রোগকে বলা হয় অটোইমিউন ডিজিজ। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ সামুদ্রিক মাছ খেলে শিশুদের টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। বিজ্ঞানীদের মতে সামুদ্রিক মাছ খেলে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং মাল্টিপল স্ক্লেরোসিসের মত অটোইমিউন ডিজিজের ঝুঁকি কমে। ডায়াবেটিস রোগীরা খাদ্য তালিকায় সামুদ্রিক মাছ রাখতে পারেন। এতে তাদের এ রোগ নিয়ন্ত্রণে সুবিধা হবে।
কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে
সামুদ্রিক মাছ এই আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ ও ডি, যা আমাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সামুদ্রিক মাছ খেলে বিশেষ উপকার পাবেন। এছাড়া সামুদ্রিক মাছের প্রোটিন ও তেল দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়
সামুদ্রিক মাছ এ প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড থাকে। আর এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড রেটিনার কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করার মধ্যদিয়ে সার্বিকভাবে দৃষ্টিশক্তির উন্নতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। আবার বয়োঃবৃদ্ধি জনিত রোগ ম্যাকুলার ডিজেনারেশান অন্ধত্বের একটি প্রধান কারণ এবং এটা বয়স্ক মানুষদের আক্রান্ত করে।
সহজে হজমযোগ্য
সামুদ্রিক মাছের আমিষ সহজে পরিপাকযোগ্য। এছাড়া দেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয়রোধে সাহায্য করে। এটি ভিটামিন বি-এর উৎকৃষ্ট উৎস। তাছাড়া সামুদ্রিক মাছের আমিষ ও তেল দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
মস্তিকের ক্ষমতা বৃদ্ধি
নিউরোলজিস্টদের মতে শরীরে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রা বাড়তে থাকলে ব্রেনের বিশেষ কিছু অংশের ক্ষমতা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে ডিমেনশিয়া বা অ্যালঝাইমারের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়।
হৃদরোগ প্রতিরোধ করে
সামুদ্রিক মাছে থাকা ওমেগা-৩ নামক ফ্যাটি এসিড হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী। এই ফ্যাটি এসিড হৃদরোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
ডিপ্রেশন দূরীকরণে
ডিপ্রেশন খুব সাধারণ একটি মানসিক রোগ। ডিপ্রেশনের রোগীদের মন-মেজাজ খারাপ থাকে, কাজে শক্তি পায় না এবং তারা কাজ ও জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যারা নিয়মিত সামুদ্রিক খাবার খান (সরাসরি খাদ্য হিসেবে কিংবা পরিপূরক হিসেবে) তাদের শরীর সুস্থ থাকার পাশাপাশি বিসাদগ্রস্ততা বা মনমরা ভাব দূরীভূত হয়। এর কারণ হচ্ছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড মস্তিষ্কের দু’টি প্রধান রাসায়নিক উপাদান সেরোটোনিন ও ডোপামিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এ দু’টি উপাদানের মাত্রা বা পরিমাণ কম থাকলেই মানসিক বিষাদগ্রস্ততা বা মনমরা ভাব সৃষ্টি হয়।
চুল ও ত্বকের যত্নে
প্রোটিনের উৎস হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ অতুলনীয়। চুলের গঠনের মূল উপাদান হলো প্রোটিন। চুলের গঠন সুন্দর এবং চুলপড়া প্রতিরোধে সামুদ্রিক মাছ এর প্রোটিন খুব কাজে দেয়। এছাড়াও, মাছের ওমেগো-৩ ত্বকের কোষের গঠনে ভুমিকা রাখে, সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে। তাছাড়া মাছের ফ্যাট ত্বকের মসৃণতা বাড়ায় আর পানি ও খাবারের পুষ্টি ত্বকের ভিতরে গিয়ে টক্সিন বের করে দেয়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
সামুদ্রিক মাছ ভিটামিন-বি এর উৎকৃষ্ট উৎস। বিশেষ করে স্যামন মাছে প্রচুর ভিটামিন বি-১২ রয়েছে। মাছে জিংক ও আয়োডিন আছে। জিংক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং আয়োডিন গলগণ্ড রোগ প্রতিরোধ করে। সামুদ্রিক মাছ এ প্রচুর সেলেনিয়াম রয়েছে, যা দেহে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও স্যামন, ম্যাকরেল মাছ থেকে ভিটামিন-এ ও ডি পাওয়া যায়।
গর্ভবতী নারী ও শিশু
যেসব নারী তাদের গর্ভকালীন সপ্তাহে অন্তত ৩৪০ গ্রাম সামুদ্রিক খাবার খান তাদের সন্তান বুদ্ধিদীপ্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে। সামুদ্রিক মাছের নানাবিধ পুষ্টিগুণের কারণেই এমনটা হয়।
সামুদ্রিক মাছ কোথায় পাবেন
পুরনো ঢাকার সোয়ারীঘাট সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। পাইকারি বাজার হিসেবে সোয়ারীঘাট ঢাকার সবচেয়ে পুরনো মেছো বাজার হিসেবে বহুল পরিচিত। নদীর মাছ, মিঠা পানির মাছ, সামুদ্রিক মাছসহ প্রায় সকল প্রজাতির মাছই পাওয়া যায়।
কাওরান বাজার থেকে সামুদ্রিক মাছ কিনতে হলে আপনাকে যেতে হবে মৎস বিতানে। এটি বাংলাদেশ মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশন কতৃক পরিচালিত একটি পরিষেবা। সপ্তাহের মধ্যে রবিবার থেকে শুরু হয় এ বিতানটি, আর চালু থাকে বৃহস্প্রতিবার পর্যন্ত। শুক্র ও শনিবার মৎস বিতান বন্ধ থাকে। তবে, এ দুইদিনও কিন্তু কাওরান বাজারের অন্যান্য মাছের আড়ৎ ও খুচরা দোকান খোলা থাকে।
গুলশান-১ এর ডিসিসি মার্কেট সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। গুলশানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মার্কেট হচ্ছে ডিসিসি মার্কেট। আর এই মার্কেটেই সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়।
চেইন বা সুপার শপে সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। স্বপ্ন, মীনাবাজার, আগোরা এবং অন্যান্য আরো কিছু সুপার শপে মাঝে মধ্যেই সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়।
আপনি বাসায় বসেই অনলাইনে সামুদ্রিক মাছ অর্ডার করতে পারেন। আর, অনলাইন প্রতিষ্ঠানগুলো আপনার ঘরে পৌঁছে দেবে সামুদ্রিক মাছ। এমন কয়েকটি ওয়েবসাইটের ঠিকানা নিচে দেয়া হলো-
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাংসের তুলনায় সামুদ্রিক মাছ অনেক বেশী কার্যকরি। রোগমুক্ত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য আপনাকে অবশ্যই খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে পুষ্টিকর খাবার সামুদ্রিক মাছ।
(ঢাকাটাইমস/২৩ মার্চ/আরজেড)

মন্তব্য করুন