গ্যাসভিত্তিক আরও চার বিদ্যুৎকেন্দ্র

সৈয়দ ঋয়াদ/ওমর ফারুক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২৬ জুলাই ২০২২, ০৭:৫৫ | প্রকাশিত : ২৬ জুলাই ২০২২, ০৭:৫২

দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সরকারের নেওয়া বিশেষ প্রকল্পের মধ্যে ভাড়াভিত্তিক ‘রেন্টাল’ ও ‘কুইক রেন্টাল’ অন্যতম। বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে নানামুখী আলোচনা সমালোচনার মধ্যে ২০০৯ সালে এসব প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। বিদ্যুৎ খাতে দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্পের পরিবর্তে স্বল্প মেয়াদি প্রকল্পগুলো চাহিদা পূরণ করলেও এর জন্য সরকারকে গুনতে হয়েছে কয়েক গুণ বেশি অর্থ।

সম্প্রতি বিশ্ববাজারে গ্যাস ও এলএনজির মুল্য বৃদ্ধির ফলে অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রই উৎপাদন করতে পারছে না। ফলে দিতে হচ্ছে শিডিউলভিত্তিক লোডশেডিং।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশে (পিজিসিব) সূত্রে জানা যায়, গত কয়েকদিন তরলীকৃত প্রকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) স্বল্পতার জন্য ১৬টি কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। উৎপাদন ব্যহত হলেও প্রতিটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকেই হাজার কোটি টাকার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। এই অবস্থায় নতুন করে আরও ২ হাজার ৭৬৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন গ্যাসভিত্তিক চারটি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

গ্যাস সংকটে থাকা বিদ্যুৎশিল্পে নতুন কেন্দ্র যোগ হওয়ার বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা শাখা পাওয়ার সেল এর মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন ঢাকাটাইমসকে বলেন, যে সাতটা নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হচ্ছে সেগুলো আমাদের মাস্টার প্ল্যানের অংশ। এখনকার গ্যাসের শর্টেজের কারণে সংকট চলছে, এর সঙ্গে লং টার্ম মাস্টার প্ল্যানের হিসাব মেলানো যাবে না। এভাবে চললে তো পুরো পৃথিবী টালমাটাল হয়ে যাবে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন আর ক্যাপাসিটি চার্জ নেই। মানুষ সেটা জানে না।

নিজেদের দুর্ভাগ্যের কথা জানিয়ে পাওয়ার সেলের এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা হয়তো মানুষকে বোঝাতে পারিনি। দেশে এখন আর কুইক রেন্টাল খুব একটা নেই। যেগুেেলা কুইক রেন্টাল ছিল এমন ১০ থেকে ১২টা ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পে’ নিয়মে চলছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ করলেই টাকা পাবে, তা নাহলে পাবে না। আর যেসব কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে পাঁচ বা দশ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, সেগুলো ডিজেলচালিত। যখন অন্য কোনো উপায় থাকে না। তখনই সেগুলো ব্যবহার করা হয়।

চলমান সংকটের বিষয়ে পাওয়ার সেলের এই মহাপরিচালক বলেন, আমাদের এই সংকট সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোকাবিলা করতে হবে। এরপর সব ঠিক হয়ে যাবে। সরকার সেভাবেই কাজ করছে। অক্টোবর থেকে বিদ্যুতের ভোগান্তি থাকবে না।

নতুন করে গ্যাস ও এলএনজিনির্ভর নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পগুলো হচ্ছে, ৮৮০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন্ রুপসা ৮০০ (২*৪০০) মেগাওয়াট সিসিপিপি, ৫৮৩ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন্ মেঘনাঘাট ৫৮৩ মেগাওয়াট সিসিপিপি, ৫৮৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন্ মেঘনাঘাট-নারায়ণগঞ্জ ৫৮৪ মেগাওয়াট সিসিপিপি ও ৭১৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মেঘনাঘাট ৭১৮ মেগাওয়াট সিসিপিপি। মোট ২৭৬৫ মেগাওয়াটের এ প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি প্রায় ৩০ শতাংশ।

ডিজেলভিত্তিক মোট ৪০৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয়টি, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ১৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি এবং গ্যাসভিত্তিক মোট ৪৫৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি মিলে মোট ১ হাজার ১৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৩টি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়ে গেছে। এছাড়া কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ইতোমধ্যে বন্ধ করা হয়েছে।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। বাড়তি সক্ষমতা সাড়ে ৭ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকছে।

অপরিকল্পিতভাবে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন, অযোগ্য কোম্পানিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প দেওয়া, প্রতিযোগিতা ছাড়া অতিরিক্ত দরে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি এবং স্বল্প মেয়াদের রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোর বারবার মেয়াদ বাড়ানোর ফলে বিদ্যুৎ খাতে বছরের পর বছর খরচ বেড়েছে। শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে গত ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছররে বেসরকারি খাতে ৯০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। এর মধ্যে ১২ কোম্পানির পকেটে গেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা।

বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হয়ে থাকে মূলত জ্বালানি খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয় এবং ক্যাপাসিটি চার্জের মাধ্যমে। অধিকাংশ সময়ে বসে থাকা বা অল্প কয়েকদিন চলা বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে সরকারের কাছ থেকে প্রতিবছরে ৩০০-৪০০ কোটি টাকা নিচ্ছে। যা সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ খাতের সাবেক কর্মকর্তারা জানান, চাহিদার অতিরিক্ত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ফলে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। বাড়তি সক্ষমতা সাড়ে ৭ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকছে। যার আরেকটি উদাহরণ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে গেলেও সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ শেষ না হওয়ায় কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বিদ্যুৎ না দিলেও ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে পায়রা বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশে চাহিদার অতিরিক্ত সাত হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। আগামী চার বছরে আরও ১৩ হাজার মেগাওয়াটের কেন্দ্র উৎপাদনে এলে বসে থাকা বা নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। কারণ, চার বছরের মধ্যে চাহিদা সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ হাজার মেগাওয়াট বাড়তে পারে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ না কিনেও অতিরিক্ত টাকা পরিশোধের অঙ্ক অনেক বেড়ে যাবে।

সূত্র জানায়, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ১১ বছরে শুধু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। আর বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছর এ ব্যয় ছিল আরও প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ১২ বছরে পিডিবিকে এ খাতে ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা।

গত ১১ বছরে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ না কিনেও সরকার যে ৯০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে, এর মধ্যে ৬০ হাজার কোটি টাকাই গেছে ১২টি কোম্পানির পকেটে। পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে সামিট গ্রুপ। বর্তমানে সামিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রগুলোর জন্য কোম্পানিটি বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল গত ১১ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে প্রায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। মালয়েশিয়াভিত্তিক কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস ৮১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গত ১১ বছরে সাত হাজার কোটি টাকার ওপর ক্যাপাসিটি চার্জ গ্রহণ করে। ইউনাইটেড গ্রুপ এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে নিয়েছে। বাংলাক্যাট ৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা।

ওরিয়ন গ্রুপ ৫০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এখন পর্যন্ত ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে। হোসাফ গ্রুপ ও মোহাম্মদী গ্রুপ দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই ক্যাপাসিটি চার্জ নেয়ার তালিকায় আছে ম্যাক্স গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও কনফিডেন্স গ্রুপ। (ঢাকাটাইমস/ওএফ/এসআর/আরকেএইচ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :