যে কারণে কর্মক্ষমতা কমছে মায়েদের

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১০:০৮

যে নারী স্বাভাবিক নিয়মে সন্তান প্রসব করার সক্ষমতা রাখেন তাকেও যখন সিজারের পরামর্শ দেওয়া হয়, তখন বলার অপেক্ষা রাখে না, এটা কতিপয় চিকিৎসকের এক ধরনের ব্যবসা হয়ে উঠেছে। এর জন্য অনেক হাসপাতালে দালালও নিয়োগ করা থাকে। কোনো কোনো হাসপাতালে নির্দেশনাই থাকে সিজারের বিষয়ে। এটা একজনের অভিজ্ঞতা নয়, অসংখ্য ভুক্তভোগী নারী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ।

ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ২০০৪ সালে যেখানে সিজারের হার ছিল ১১ দশমিক ৭২ শতাংশ। বর্তমানে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪.২৪ শতাংশে। ১৮ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় চার গুণ। এটি আশঙ্কাজনক। বিত্তশালীদের পকেট কাটার বড় হাতিয়ার এই সিজারিয়ান অপারেশন। রাজধানীর নামী-দামী হাসপাতালে ৮০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত প্যাকেজে সিজার করা হয়।

অন্যদিকে মাঝারি সারির হাসপাতালে ৫০-৮০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। এছাড়া ছোট ক্লিনিকে ২০-৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত সিজার চার্জ নেওয়া হয়। আর মফস্বলে তা ১৫-৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবে। জন্মদাতা মায়ের মুখে হাসি ফুটবে- এমন উচ্ছ্বাস নিয়ে যান হাসপাতালে। কিন্ত টাকা পয়সার খুইয়ে আসেন মলিন মুখে। জন্মের পর সিজারের টাকা দিতে না পারায় সন্তান বিক্রির ঘটনাও ঘটেছে। এমন নজিরও রয়েছে।

এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) গেল বুধবার সিজারে বাচ্চা হওয়ার বিষয়ে যে তথ্য তুলে ধরে তা রীতিমত আতংকের। সংস্থাটি ২০০৪-২০১৮ পর্যন্ত তাদের নিজস্ব জরিপের ফল প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, দেশে প্রয়োজন ছাড়াও সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা হওয়ার হার বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিকনির্দেশনা মতে এ হার ১৫ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৩-২০০৪ সালে বাংলাদেশে সিজারের হার ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ থাকলেও ২০১৭-১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থ্যাৎ, ১৪ বছরে দেশে সিজারে বাচ্চা নেওয়ার হার বেড়েছে ২৮ দশমিক ২৩ শতাংশ।

সিজারে শহরের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে গ্রাম। ২০০৩-২০০৪ সালে গ্রামাঞ্চলে সিজারে বাচ্চা জন্মের হার ছিল ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ যা ২০১৭-১৮ সালে এসে দাঁড়ায় ২৯ দশমিক ১৮ শতাংশে। শহরে আগে থেকেই এই হার ছিল বেশি। সে সময় শহরে সিজার হতো ১১ দশমিক ৭২ শতাংশ। এখন হয় ৪৪ দশমিক ২৪ শতাংশ।

বাংলাদেশের জরিপ দেখাতে গিয়ে প্রতিবেদনে প্রতিবেশী দেশগুলোর সিজারের হারও তুলে ধরা হয়। তাতে দেখা যায়, প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়েও বাংলাদেশে সিজারিয়ানের হার বেশি। একই সময়ে ভারতে ২২ শতাংশ, পাকিস্তানে ২২ শতাংশ, নেপালে ১৬ ও মিয়ানমারে ১৭ শতাংশ সন্তান প্রসব সিজারের মাধ্যমে হয়ে থাকে।

বিআইডিএস’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অপারেশন করা নারীদের থেকে তথ্য নিয়েছে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস)। তারা ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ২৭ হাজার ৩২৮ হাজার নারীর মধ্যে এ জরিপ চালায়। যারা তার আগের ২ বছর জীবিত শিশু জন্ম দিয়েছেন।

সাক্ষাৎকার নেওয়া নারীরা জানান, ম্যালপ্রেজেন্টেশন, ফেইলিওর টু প্রগ্রেস ইন ল্যাবার, প্রসব যন্ত্রণা এড়ানো, প্রি-একল্যাম্পসিয়া, প্রোল্যাপসড কর্ড, ডায়াবেটিস ও আরও কয়েকটি কারণে তারা সিজারের মাধ্যমেই সন্তান জন্মদান করে থাকেন। এছাড়াও নিরক্ষর নারীর তুলনায় শিক্ষিত নারীর সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের সম্ভাবনা ২ দশমিক ৮৭ গুণ বেশি ছিল। যেসব নারীর মাসিক আয় বেশি, তাদের মধ্যেও সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের প্রবণতা বেশি।

সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি ও এনজিওভিত্তিক হাসপাতালে সিজারের মাধ্যমে শিশুজন্মের হার খুব বেশি দেখা যায়। সেখানে এ হার যথাক্রমে ৮৩ দশমিক ৭০ ও ৪৩ দশমিক ৯০ শতাংশ।

সিজারের জন্য কোথায় কেমন খরচ হয় তাও বিশ্লেষণ করেছেন ডা. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘সিজারের জন্য গড় খরচ সরকারি হাসপাতালে ১৩ হাজার ৬২২ টাকা ও বেসরকারিতে ২১ হাজার ৫০৬ টাকা। আর এনজিওর ক্লিনিকগুলো থেকে এ সেবা নিতে লাগে ১৬ হাজার ৮৬০ টাকা। ২০১৮ সালে মোট ৮ লাখ ৬০ হাজার সিজার হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জনের অস্ত্রোপচারই ছিল অপ্রয়োজনীয়।’

সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে বেসরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় সিলেটে আর সবচেয়ে কম বরিশালে। সিলেটে ব্যয় হয় ৩০ হাজার ৫৫৭ টাকা ও রাজশাহীতে ব্যয় হয় ১৫ হাজার ৭০৫ টাকা। আবার সরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় সিলেটে ১৭ হাজার ৮৩৭ টাকা। আর সবচেয় কম হয় রংপুরে ৭ হাজার ৩১ টাকা।

নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশনে (এনজিও) সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় সিলেটে ২১ হাজার ৪৭৬ টাকা এবং রংপুরে ১২ হাজার ৮১ টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ঢাকায় ১৩ হাজার ৩৮৩ টাকা, চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ৮৩১, বরিশালে ১৬ হাজার ৮৪৬, খুলনায় ১১ হাজার ৮৯৩, রাজশাহীতে ১০ হাজার ৯৪১, সিলেটে ১৭ হাজার ৮৩৭, রংপুরে ৭ হাজার ৩১ ও ময়মনসিংহে ১১ হাজার ৫১৬ টাকা ব্যয় হয়। বেসরকারি হাসপাতালে ঢাকায় ২৩ হাজার ১৬৮, চট্টগ্রামে ২৫ হাজার ৫০৭, বরিশালে ২৮ হাজার ৯৫৯, খুলনায় ১৫ হাজার ৭২৯, রাজশাহীতে ১৫ হাজার ৭০৫, সিলেটে ৩০ হাজার ৫৫৭, রংপুরে ১৮ হাজার ২৩০ ও ময়মনসিংহে ১৯ হাজার ৯৭৩ টাকা। এনজিও’র হাসপাতালগুলোতে ঢাকায় ২০ হাজার ৪৯৮, চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ২৬৯, বরিশালে ১৫ হাজার ৮২৩, খুলনায় ১৪ হাজার ৭১০, রাজশাহীতে ১০ হাজার ৩৪৬, সিলেটে ২১ হাজার ৪৭৬, রংপুরে ১২ হাজার ৮১, ময়মনসিংহে ১৫ হাজার ৬১ টাকা।

সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য তুলে ধরে ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘২০১৮ সালেই বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় সিজার হয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজার।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘গ্রামে সিজারের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ার পেছনের কারণ হল বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো গ্রামের দিকে মনযোগী হওয়া। এক শ্রেণির দালাল এবং চিকিৎসকরাও বুঝে হোক বা না বুঝে হোক বা যেকোনো কারণে হোক মানুষদের সিজারে উৎসাহিত করছে।’

ড. বিনায়ক সেন বলেন, ‘বাড়িতে এখন আর ডেলিভারি হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নেওয়া হচ্ছে প্রসূতিদের। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে মানুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি শারীরিকভাবেও নানা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। সিজারের কারণে মায়েদের কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে।’

পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য (সচিব) ড. আব্দুস সাত্তার মন্ডল বলেন, ‘আগে গ্রামের মানুষ শহরে যেত মামলা-মোকদ্দমার জন্য এখন যাচ্ছে সিজারের জন্য।’

নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন হক ওই সেমিনারে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে পরামর্শ দেন, সন্তান জন্মদানের জন্য দাইদের প্রশিক্ষণ পুনরায় শুরু করতে হবে এবং তাদের অবশ্যই রেফারেল চেইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

শতভাগ প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের জন্য সরকারের যে উদ্যোগটি ভুল ছিল বলেও মন্তব্য করেন শিরীন হক।

সেমিনারে বক্তারা বলেন, ‘বর্তমানের ডাক্তাররা সময় বেশি লাগে এমন অজুহাতে স্বাভাবিক ডেলিভারি না করে দ্রুত সিজার করেন। এতে সময়ও বাঁচে আবার টাকাও বেশি আয় হয়। সিজার পরবর্তী মা এবং সন্তানের সার্বিক অবস্থা জানা না যাওয়ার পাশাপাশি তাদের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে তা চিহ্নিতও করা যাচ্ছে না।’

দেশের ধাত্রী প্রথা হারিয়ে গেছে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেন, সন্তান জন্ম নেওয়ার আগের লক্ষণগুলো ধাত্রীরা ভালোভাবে ধরতে পারতেন। আবার অনেক সময় দেখা যায় সিজার করার আগেই ডাক্তারকে টাকা দিতে হয়। না হলে তারা আসতে চান না। এ যেনো এক এক ধরণের অরাজকতা। কিন্তু কোনো ধাত্রীর ক্ষেত্রে এমন অবস্থা তৈরি হয়নি যে, অর্থ না দিলে মাঝরাতে তিনি আসবেন না।

(ঢাকাটাইমস/৩০সেপ্টেম্বর/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

ট্রেনে ঈদযাত্রা: ৮ এপ্রিলের টিকিট বিক্রি শুরু

ঢাকায় কর দিয়ে ২৬৮০ বিয়ে 

সংরক্ষিত আসনের এমপিদের মধ্যেও সংখ্যায় এগিয়ে ব্যবসায়ীরা: সুজন

মানবাধিকার ও ভোক্তা অধিকার রক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা জরুরি: ড. কামাল উদ্দিন

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে রেলকে গড়ে তুলতে হবে: রেলমন্ত্রী

ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার

জিম্মি নাবিকদের মুক্তির আলোচনা অনেকদূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ডিএনসিসি কার্যালয় সরানোর মধ্য দিয়ে কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু 

বিএসএমএমইউ উপাচার্যের দায়িত্ব নিলেন দীন মোহাম্মদ, বললেন ‘কোনো অন্যায় আবদার শুনব না’

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :