ভুয়া ভিসায় সৌদি গিয়ে বিপদে কুলিয়ারচরের শত যুবক, স্বজনের কান্না

আমিনুল হক সাদী, কিশোরগঞ্জ
  প্রকাশিত : ০৫ অক্টোবর ২০২২, ১৭:৪৫
অ- অ+

দালালের ফাঁদে পড়ে ভুয়া ভিসায় সৌদিআরব গিয়ে আটকা পড়েছে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের কয়েক গ্রামের শতাধিক যুবক। স্বজনদেও দাবি সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ি দেওয়ার।

সৌদিতে আটকে পড়া খোকন মিয়ার স্ত্রী কুলিয়ারচরের রামদি গ্রামের বাসিন্দা ফারজানা বেগম বলেন, আমার স্বামী খোকন মিয়া সিএনজি অটোরিকশা চালাতেন। ৪ মেয়ে এবং ৩ ছেলে নিয়ে আমাদের সংসার। প্রতারক হান্নানের দেখানো সুখের স্বপ্নের ফাঁদে পা দিয়ে সামান্য ভিটে-বাড়ি, গোয়ালের গরু আর প্রতিদিনের রোজগারের একমাত্র অবলম্বন অটোরিকশাটি বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকা তুলে দেয় হান্নানের হাতে। যথারীতি সৌদি আরব পাড়ি দেয়। সেখানে ৮ মাস যাবত আকামা না থাকায় কাজ-রোজগার নেই। দেশে ছোট ছোট শিশু সন্তানদের নিয়ে তিনবেলা দুমুঠো ভাত জোগারে হিমশিম খাচ্ছি।

কুলিয়ারচরের মনোহরপুর গ্রামের আমানুল্লাহর স্ত্রী সুবর্ণা বেগম জানান, ৮ মাস বেকার থাকার পর তার স্বামী হান্নান-মান্নানের কাছে আকামা এবং কাজ চাওয়ায় তাকে নির্জন এক স্থানে নিয়ে দুইদিন আটকে রেখে মারধর করে। পরবর্তীতে এমন করলে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়। তিনি তার স্বামীর জীবন বাঁচাতে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।

তারাকান্দি গ্রামের মাজেদা বেগম বলেন, অসুস্থ বৃদ্ধ মা-বাবার সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে ঋণ করে পাঁচ লাখ টাকায় ছোট ভাই হবি মিয়াকে হান্নান-মান্নানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু হান্নান-মান্নান তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় আকামাহীন ফেরারি জীবন হবির। বোনকে হবি বলেছেন, তিনি সেখানে মরে গেলে লাশও দেখতে পাবেন না!

তারাকান্দি গ্রামের তাসলিমা বলেন, আমার স্বামী রমজান মিয়া ছিলেন দরিদ্র কৃষি শ্রমিক। সম্পদ বলতে কিছুই নেই। দুই মেয়ে আর এক ছেলে নিয়ে তাদের সংসার। দেশের বাইরে যাবার স্বপ্ন কখনই দেখত না। কিন্তু হান্নানের কথায় ভিটেটুকু বিক্রি করে প্রবাসী হয় রমজান।

সৌদিআরবে আটকে থাকা দুই যুবক রমজান মিয়া ও আমানুল্লাহ ভিডিও বার্তায় আটকেপড়া ওইসব প্রবাসীদের কষ্টের বর্ণনা দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিওবার্তা ভাইরাল হয় এলাকায়। সেখানে রমজান আর আমানুল্লাহ নিজেদের দেশে ফিরিয়ে আনার আর্জি জানিয়ে বলেছেন, অন্যথায় তাদের লাশও ফিরে পাওয়া যাবে না একদিন।

কুলিয়ারচর উপজেলার রামদি ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামের মৃত মুক্তার মিয়ার দুই ছেলে মান্নান ও হান্নান। বড়ভাই মান্নান ২৫/৩০ বছর যাবত সৌদিআরব প্রবাসী। ছোটভাই হান্নান থাকেন দেশে। এই দুই সহোদরের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে ওই গ্রামের হত দরিদ্র এইসব পরিবার এখন অথৈ জলে ভাসছে। হান্নান-মান্নান শুধু তারাকান্দি গ্রাম থেকে ৯৫জন দরিদ্র কৃষিশ্রমিক, অটোরিকশা চালক, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, খামারি, মুদি দোকানির কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে নেয় ভিসা দেওয়ার কথা বলে। অন্যান্য খরচের কথা বলে নেয় প্রত্যেকের কাছ থেকে আরও ৬০/৭০ হাজার টাকা। গ্রামের এইসব হতরিদ্ররা তাদের আত্মীয়-স্বজন, বিভিন্ন এনজিওসহ গ্রাম্য সুদি মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে এই বিশাল অংকের টাকা তুলে দেয় হান্নানের হাতে। সৌদিআরব যাওয়ার পর ৭দিনের মধ্যে আকামাসহ কাজে যোগদানের কথা থাকলেও, দিনের পর দিন কেটে গেলেও আকামা বা কাজের কোনো ব্যবস্থা না হওয়ার কথা দেশে তাদের স্বজনদের জানালে হান্নানকে চাপ দিলে একদিন সে লুকিয়ে সৌদিআরব চলে যায়।

স্বজনরা জানান, ৮/৯ মাস যাবত তারা তাদের লোকজনদের দেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। এতে করে প্রতি পরিবারের আরও ৬০/৭০ হাজার টাকা করে খরচ পাঠানো হয়ে গেছে। যাবার সময়কার ঋণ, ঋণের সুদ, পরিবারের খরচ-ইত্যাদির চাপে তারা বর্তমানে দিশেহারা। তারা সরকারের কাছে দাবি করেন, অবিলম্বে তাদের স্বজনদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক। পাশাপাশি তারা দালাল হান্নান-মান্নানের কাছ থেকে তাদের ক্ষতিপূরণ আদায়সহ অন্যায় অত্যাচার ও জুলুমের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

এদিকে কিশোরগঞ্জ সদরের মহিনন্দ ইউনিয়নের কলাপাড়া গ্রামের মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, আমাকে মিঠামইন উপজেলার এক প্রতারকের সহায়তায় ঢাকার জিয়ার মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা দিয়ে সৌদিতে যাই। সেখানে আমাকে কোম্পানীর কথা বলে সাপ্লাই করে চালান দিয়ে দেয়। আমি কয়েক মাস উঠের সঙ্গে গহীণ মরুভূমিতে খেয়ে না খেয়ে থেকে এক পর্যায়ে আত্মীয়-স্বজনকে বিষয়টি জানালে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে যান। যে কোম্পানির মাধ্যমে গিয়েছিলাম সে কোম্পানীতে চাকরি না দিয়ে আমাকে শ্রমিক হিসেবে বিক্রি করে দেয়। ফলে কোথাও আর কাজে যেতে পারিনি। এভাবে মাস খানেক পর আরও লক্ষাধিক টাকা খরচ করে সেখান থেকে মুক্ত হয়ে আসি। আমার মতো আর কোনো মায়ের সন্তান এভাবে প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে যেন বিদেশ না যায়।

মিঠামইনের অপর বাসিন্দা মো. আবু বকর বলেন, আমার ভাইকে অস্টগ্রামের আব্দুল্লাহপুরের স্বপন মিয়ার মাধ্যমে দুই কিস্তিতেক ৪ লাখ টাকা দিয়ে সৌদি আরব প্রেরণ করেছিলাম। বর্তমানে সেখানে তিনি মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আমার ভাইকে দেশে আনতে পারলে অনেক খুশি হইতাম।

এদিকে স্বজন ও প্রবাসীদের অভিযোগ বিষয়ে এক ভিডিও বার্তায় সাংবাদিকদেরকে অভিযুক্ত হান্নান জানান, এলাকার দরিদ্র লোকদের স্বচ্ছলতা ফেরাতে ৭২জন লোককে সৌদিতে এনেছেন। সৌদিআরবের বর্তমান শ্রমবাজার মন্দা থাকায় ১৫/২০জন লোকের কাজ দিতে পারেননি। তাদেরকে আকামাসহ কাজে নিয়োগের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুলিয়ারচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিয়া ইসলাম লুনা সাংবাদিকদেরকে জানান, তিনি বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছেন। এপর্যন্ত কেউ তাকে লিখিতভাবে জানায়নি বিষয়টি। এটি যেহেতু একটি আইনি বিষয়, খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জকে (ওসি) বলেছেন তিনি।

(ঢাকাটাইমস/৫অক্টোবর/এআর)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
গোপালগঞ্জে হামলার ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে ট্রল, দিনাজপুরের এএসপি প্রত্যাহার
‘গোপালগঞ্জে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়নি’
“চাঁদাবাজ যতই প্রভাবশালী হোক, পার পাবে না”
গোপালগঞ্জে বৃহস্পতিবারের এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা