সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সংযোজন: অবহেলার এক ভয়াবহ চিত্র

মো. আছাদুজ্জামান
| আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:১৯ | প্রকাশিত : ৩০ নভেম্বর ২০২২, ২৩:২০

১৯৭১ সালের ৭ মার্চে তদানিন্তন রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণের প্রোপট ও গুরুত্ব আমাদের সবার জানা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও উক্ত ঘোষণার মূলমন্ত্র প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চের উক্ত ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে নিহিত ছিল। উক্ত ভাষণকে বাঙালি জাতি হৃদয় দিয়ে মূল্যায়ন করলেও উহার রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তাদের প্রত্যাশা যথা সময়ে পূরণ হয়নি। বরং, অপ্রত্যাশিতভাবে বিলম্বিত হয়েছে। তবে দেশ স্বাধীন হবার দীর্ঘ ৪০ বছর পরে হলেও আমাদের নবম জাতীয় সংসদ ২০১১ সালে সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন পাস করে সংবিধানের পঞ্চম ফসিলে অন্তর্ভূক্ত করণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর উক্ত ঐতিহাসিক ভাষণকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করে জাতির সে প্রত্যাশা পূরণ করেছে। এ জন্যে আমাদের জাতীয় সংসদ এবং সরকার অবশ্যই সাধুবাদ পাবার যোগ্য।

বঙ্গবন্ধুর উক্ত ভাষণ শৈশবকাল থেকে শুনে আসছি। বহু, বহুবার শুনেছি। সুযোগ পেলেই এখনও শুনি। শুনতে শুনতে প্রতিটি বাক্য মুখস্ত হয়ে গেছে। বলতে দ্বিধা নেই, যতই শুনি ততই মুগ্ধ হই। বঙ্গবন্ধুর কন্ঠস্বর, উচ্চারণ, ভাষণে ব্যবহৃত শব্দ, বাক্য, ছন্দ, তাল, লয় ইত্যাদি সবকিছু আমাকে মন্ত্রের মত মুগ্ধ করে। শরীরে শিহরণ জাগায়। এক কথায় ভাষণটির প্রতি আমি প্রচন্ড ভাবে দূর্বল। তাই প্রিয় সে ভাষণ সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হবার পর, উহা সংবিধানের পাতায় লিপিবদ্ধ আকারে দেখবার প্রবল বাসনা মিটাতে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ কর্তৃক অক্টোবর, ২০১১ এ প্রকাশিত, উহার (সংবিধানের) একটি কপি সংগ্রহ করি। উক্ত কপিতে ৭৫-৭৭ পৃষ্ঠায় (পঞ্চম তফসিলে) ভাষণটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দেখতে খুব ভাল লাগল। অনেক আগ্রহ ভরে পড়তে শুরু করলাম। কিন্তু প্রায় প্রতিটি ছত্র পড়তে গিয়ে মারাত্মকভাবে হোচট খেলাম। ভাষণটি সংবিধানে লিপিবদ্ধকালে, অন্ততঃ ৬০ টি বাক্যের বিভিন্ন জায়গায় বিকৃত করা হয়েছে মর্মে দেখতে পেলাম তা নিম্নরূপ-

উপরে বর্ণিত বিকৃতিগুলো ছাড়াও কোনো কোনো স্থানে যথাযথ বিরাম চিহ্ন ব্যবহার না করে, আবার কোনো কোনো স্থানে উহার অপব্যবহার করে, বাক্যের অর্থের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে যেগুলোর বিস্তারিত আলোচনা এ নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি এড়াতে পরিহার করা হলো।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শতবর্ষ আগে তাঁর রচিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে আমাদের দেশকে 'সোনার বাংলা' বলে অভিহিত করেছেন। জাতীয় সঙ্গীতটি অন্তর্ভূক্ত করে কোন পাঠ্যপুস্তক রচনার দায়িত্ব প্রাপ্ত কোন ব্যক্তিকে কি কর্তৃপক্ষ, কালের বিবর্তনে শতবর্ষ আগের চেয়ে বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশী সমৃদ্ধ বিবেচনায়, সোনার বাংলার পরিবর্তে এদেশকে 'হীরার বাংলা' অভিহিত করে উক্ত সঙ্গীতটি ঐ পুস্তকে লিপিবদ্ধ করবার অনুমতি দিতে পারেন? সে এখতিয়ার কি কোন কর্তৃপর্বের আছে? কিংবা দায়িত্ব প্রাপ্ত উক্ত ব্যক্তিরও কি তেমনটি করবার এখতিয়ার আছে? জবাব নিশ্চয়ই না-বোধক।

একই যুক্তিতে আমাদের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর ড্রাফটিং, ভেটিং, যাচাই-বাছাই ইত্যাদি কাজের গুরু দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি বর্গেরও বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের উক্ত ঐতিহাসিক ভাষণ সংবিধানের তফসিলভুক্ত করবার ক্ষেত্রে উপরে বর্ণিতরূপ বিকৃতিতো দূরের কথা একটি দাড়ি, কমা, সেমিকোলনে রদ-বদল করবার অথবা যদি মার্জিত ভাষায় বলি সম্পাদনার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবার কথা নয়। তারপরেও আমি সন্দিহান। যদি তাঁরা উক্তরূপ কোন ক্ষমতা (যার সূত্র আমার জানা নেই) প্রাপ্ত হয়ে থাকেন অথবা সরকার ও জাতীয় সংসদ যদি ভাষণটি উক্তরূপ লিপিবদ্ধ করণের ক্ষেত্রে দোষনীয় কিছু হয়নি বলে মনে করেন তাহলে আমার অবস্হান নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক এবং সেক্ষেত্রে আমার নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। আর তাঁরা যদি তদ্রূপ

ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়ে থাকেন এবং কর্তৃপক্ষ যদি ভাষণটির উক্তরূপ লিপিবদ্ধ করণ দোষনীয় বলে মনে করেন, তা'হলে অনেক গুলি প্রশ্ন সামনে এসে যায়। সেগুলি হ'ল তাঁরা (দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিবর্গ) কি অবহেলা বশতঃ কাজটি করেছেন না কি ইচ্ছাকৃত ভাবে বঙ্গবন্ধুর উক্ত ভাষণ বিকৃত করে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেছেন?

এ দুটির কোনটির ক্ষেত্রে কি তাঁদের কৃতকর্মের সমর্থনে তাঁদের কাছে এমন কোন যুক্তি আছে যার উপর ভিত্তি করে জাতি তাঁদের উক্ত কৃত কর্মকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পারে? আমার বিশ্বাস নেই। এছাড়া, আরও প্রশ্ন জাগে যদি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে উক্তরূপ আচরণ করে থাকেন তাহলে তাঁরা আসলে কারা? তাঁরা কি স্বাধীনতার স্বপনের লোক, না কি স্বাধীনতার স্বপনের লেবাসধারী, স্বাধীনতা বিরোধীদের এজেন্ট? জাতির সামনে বিষয়টি পরিস্কার হওয়া দরকার ।

এখন দেখা যাক উক্তরূপ বিকৃতভাবে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সংবিধানের তফসিলভূক্ত করণের ফলাফল কী হতে পারে।

সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। দেশে প্রচলিত অন্য সব আইনের চেয়ে এর মর্যাদা অনেক বেশী, অনেক উঁচু। সংসদের সাধারণ সংখ্যা গরিষ্ঠ ভোটে দেশে বিদ্যমান অন্য যে কোন আইন সংশোধন বা বাতিল করা যায় এবং প্রয়োজনে নতুন আইনও পাশ করা যায়। কিন্তু সংবিধানের ক্ষেত্রে সেটি আদৌ সম্ভব নয়। সংবিধান সংশোধন করতে হলে জাতীয় সংসদের কমপক্ষে দু’তৃতীয়াংশ সংখ্যা গরিষ্ঠ ভোটের প্রয়োজন হয়। শুধু তাই নয়, সংবিধানের কোন কোন বিধান যথা- প্রস্তাবনা, ১-২৫ নং অনুচ্ছেদ, ৯ক ভাগের বিধানাবলী সাপেক্ষে ২৬-৪৭ক নং অনুচ্ছেদ ও ১৫০ নং অনুচ্ছেদ সহ মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অন্যান্য অনুচ্ছেদ সমূহ, এমনকি শতভাগ ভোট দ্বারাও, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, প্রতিস্হাপন, রহিত করণ বা অন্য কোন ভাবে সংশোধনযোগ্য নয়। তাছাড়া, সংসদ অধিবেশনে না থাকাকালে বা ভাঙ্গিয়া যাওয়া অবস্হায় মহামান্য রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে নতুন কোন আইন জারী করতে পারেন বা বিদ্যমান কোন আইন সংশোধন করতে পারেন। কিন্তু তিনি অধ্যাদেশ দ্বারা সংবিধানের কোন বিধান সংশোধন করতে পারেন না। এমনকি সার্বভৌম জাতীয় সংসদ যদি এমন কোন আইন পাশ করে যা সংবিধানের কোন বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক তাও, যতটুকু সাংঘর্ষিক ততটুকু পর্যন্ত, বাতিল বলে গণ্য হয়। অবশ্য, তা আপনা আপনি বাতিল হয় না। কাজটি সংবিধানের অভিভাবক মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট করে থাকেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে সংবিধান এমন একটি আইন যার অবস্থান দেশের অন্য সব আইনের উপরে।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের উক্ত ঐতিহাসিক ভাষণ উহার (সংবিধানের) তফসিলভূক্ত করবার ফলে ভাষণটি এখন দেশের সর্বোচ্চ আইন উক্ত সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। উক্ত তফসিলভূক্তির কাজটি করা হয়েছে সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের অধীনে। ৭খ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী, উক্ত ১৫০ নং অনুচ্ছেদ কোনক্রমেই সংশোধন যোগ্য নয়, যা ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তৎপ্রেক্ষিতে উক্ত ১৫০ অনুচ্ছেদের বিধান বলে সংবিধানের ৫ম তফসিলভূক্ত ভাষণটির উল্লিখিত ভুল সমূহ সংশোধন যোগ্য হবে কি না তা নিয়ে বিতর্কের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। যদি সংশোধনের সুযোগ নেই মর্মে স্হির হয় তা'হলে আমাদের স্বাধীনতার উক্ত ভিত্তি-ভাষণ চিরকাল উত্তরূপ ৬০টির অধিক ভুল সহ সংবিধানে বিদ্যমান থাকবে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভ্রমে পতিত হয়ে উহাকেই বঙ্গবন্ধুর সঠিক ভাষণ হিসেবে জানবে। সম্মানিত পাঠক, একবার, ভেবে দেখুন আমাদের সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত টেকনিক্যাল কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি বর্গের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে উক্তরূপ অবহেলা বা ইচ্ছাকৃত ভুলের ফলাফল কত ভয়ংকর, কত ভয়াবহ। আর যদি সংবিধানের তফসিলভুক্ত ভাষণটির উক্ত বিকৃতি সংশোধনীর মাধ্যমে অপনোদনযোগ্য হয় তা'হলেও কি বিষয়টি জাতি হিসেবে আমাদের জন্যে কম লজ্জার? দুর্ভাগ্য আমাদের।

লেখক: মহানগর দায়রা জজ, ঢাকা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :