আটলান্টিকের তীরে লাল সবুজের বিপ্লব

রেজাউল মাসুদ
 | প্রকাশিত : ১২ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:০৪

দেশটির নাম আইভরিকোষ্ট, যুদ্বাবস্হা বিরাজ করছে বহু বছর যাবৎ। এক যুগের মত হল জাতিসংঘ দেশটির শান্তি রক্ষার দায়িত্ব পায়। বাংলাদেশে পুলিশ, আর্মি এয়ার নেভিসহ তিন হাজারের মত সদস্য দেশটির স্হিতাবস্হা ও শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে।

সেদিন ছিল শনিবার, জুন মাসের নয় তারিখ।

সকালে ঘুম ভাঙল এএসপি মানসের ডাকাডাকিতে,

তখনও পূব আকাশ ফর্সা হয়ে উঠেনি,

তার চোখ মুখে ভয় আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা! “স্যার গতকাল আইভরি কোষ্টের তাই তে নিজার ব্যাটের (নিজার দেশের সেনাসদস্য) সাতজন জাতিসংঘের সৈন্য নাকি এমবুসে পড়ে নিহত হয়েছে। সাথে আরও অনেক সিভিলিয়ান হতাহত হয়েছে। পরিস্থিতি খুবই খারাপ স্যার , আমার ভয় করছে।” এ খবর বাংলাদেশের মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে স্বজনরা উদ্বিগ্ন আর উৎকন্ঠায় পরে যায়। যে যার সাথে পারছে যোগাযোগ করছে।আশ্চর্য আমরা কিছুই শুনলামনা এখান থেকে! আমাদের স্বজনরা ভয়ের নিউজ আগেই শুনে টেনশনে পড়ে গেল! বাইরে থেকে স্বজনদের ভয়টা আসলেই বেশী কাজ করে।কিন্ত আমরা যুদ্ধের মাঠে, তেমন ভয় লাগছেনা।আসছিই তো যুদ্ধ করতে, শান্তি আনয়নে। আমরা ভীত সন্ত্রস্ত না হয়ে পরিবার পরিজনদের আশ্বস্ত করলাম ঘটনাটা আমাদের কর্মস্হল থেকে চারশ কিমি দূরের রিমোট একটা জায়গায়। ওখানে নাইজার নামক দেশের জাতিসংঘের সৈন্যরা প্যাট্রল করার সময় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গ্রুপের হামলায় সাতজন নিহত হন।বাংলাদেশের সদস্যদের কারও কোন সমস্যা হয়নি!

কিন্ত পরমুহুর্তেই আমাদের উপর যে অর্ডারটা আসল তাতে ভীত সন্ত্রস্ত না হযে পারলামনা। আমাদেরকে আইভরিকোস্টের বেজ ক্যাম্প ইয়ামুসুক্রু থেকে চারশ কিমি দূরের সেই ঘটনাস্হল আতঙ্কের শহর “তাই তে” আইনশৃঙ্খলা ও স্হিতাবস্হা রক্ষার জন্য দুই প্লাটুন ফোর্স মোতায়েনের নির্দেশ দেওয়া হল এবং তা করতে হবে কালকের মধ্যেই। ভয় বিপদ যাই হোক, নির্দেশ না মানার কোন উপায় নেই! অস্হিরতার মধ্যেই তোড়জোড় শুরু হল লোক মনোনয়নে, খাবার দাবার, তাবু গাড়ী অস্ত্র গুলাবারুদসহ যাবতীয় লজিস্টিকস সাপোর্ট নিয়ে ষাট জনের এক বহর যাত্রা করল অজানা ভয় আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার শহর তাই ই তে!

যুদ্ধেই চলে এসেছি তাই আর পিছপা হওয়ার তো আর অবকাশ নেই! বাংলাদেশে আমরা অভ্যন্তরীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়েজিত, কিন্ত এখানে সেনা নৌ বিমান এবং পুলিশের কাজ একই ধাঁচের একই রকম, তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষা করা।আর যুদ্ধের মাঠে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা। তাই তে আসার পূর্বে জাতিসংঘের যাবতীয় রিস্কি কর্মকান্ডের ব্যপারে এবং যুদ্ধের প্রস্ততিসহ আমাদের ট্রেইন আপ করানো হয়েছে। কিছুদিন পর বাংলাদেশ আর্মির ইন্জিুনিয়ারিং কোরের এক প্লাটুন ফোর্স মোতায়েন হল। আমাদের সাহস বেড়ে গেল। আসল পাকিস্তান আর্মির একটা কন্টিনজেন্ট। তাই তে আগে থেকেই মোতায়েন ছিল মরক্কো সেনাবাহিনীর একটা ইউনিট।সাথে আফ্রিকানসহ বিভিন্ন দেশের পুলিশ আর্মি সিভিলিয়ানকে রয়েছেই ।

কিন্ত লাল সবুজের বাংলাদেশ। এদেশের পুলিশ এবং সৈন্যদের ত্যাগ তিতিক্ষা সংগ্রাম এবং যাবতীয় কার্যক্রম আর অবদান

সবাইকে ছুয়ে যায়। স্হানীয় আইভরিয়ানদের মনে রেখাপাত করে।

আসার পর থেকে সাতদিনের মত কিযে দুর্বিসহ দিনছিল তা ভাবলেই গা শিউরে উঠে। না ছিল বিদ্যুৎ পানি গ্যাস, না ছিল এডমিনিস্ট্রিভ বা মানসিক কোন সহায়তা বা সহযোগিতা করার কোনকিছু। আর জায়গাটা হলো আইভরিয়ান ন্যাশনাল পার্ক যেটা একেবারে দেশের মাঝখানে। ঠিক আফ্রিকান জঙ্গল যাকে বলা হয়। নানা রকম হিংশ্র জন্ত জানোয়ারের ভয় বাদ দিলেও মশার ভয়টা ছিল প্রচন্ড রকমের, কামড় দিলেই সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া। এখানে আসার সাথে সাথে মরক্কো সৈন্যদের প্রস্ততি দেখে যা বুঝেছিলাম তাতে মনে হয়েছিল চারদিকে সসস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে, আর আমরা ঠিক যুদ্ধের মাঠে অবস্হান করছি!পরদিন রাতে চাঁদ র সিকিউরিটি অফিসার বলে গেল “আজ রাত্রে ক্যাম্প আক্রমন হওয়ার কথা আছে, সবাই বুলেট প্রুফ আর অস্ত্র নিয়ে পজিশনে থাকো , এপিসি নিয়ে অনগার্ডস থাকতে বলেন আপনাদের সৈন্যদের।” হাবিলদার এনামুল বলল, স্যার আমরা তো পুলিশের লোক, যুদ্ধ করতে তো আসিনি, সেনাবাহিনী আসুক আমরা কেন মরতে যাব!”

এক এনসিও হাউমাউ করে কেদেঁ উঠল, স্যার আমার সাড়ে চার বছরের মেয়েটাকে বোধহয় আর দেখা হলো না। যাই হউক কোন রকমে সেই দিনের ভয়ের বিনিদ্র রজনী কাটালাম, পরদিন একই মেসেজ চারদিকে একই গুজব সন্ত্রা্সী গ্রুপের বিশাল এক অস্ত্রধারী বহর আমাদের ক্যাম্পের একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে। আজ রাত্রেই নাকি তাই ক্যাম্পে আক্রমণ হবে।মিল অপসের লেঃকঃ বলে গেল এই জায়গাটা যেহেতু উঁচু তাই ওরা মর্টার শেল দিয়ে আক্রমণ করতে পারে, আপনাদের এপিসি(আরমোরা পার্সোনাল ক্যারিয়ার)নিয়ে প্রথমেই মুভ করবেন, আর ভয়ে কেউ দৌড়াদৌড়ি করবেননা, করলেই আগে মারা যাবেন, এরপর এসএমজি এলএমজি, রাইফেল তারপর পিস্তল বাহীদের রাখবেন। এরকম ভয় আর জবুথবুতে প্রতিটি মুহুর্ত পার করছিলাম।আতঙ্কে একেকটি ভয়াভহ রাত পার করেছি।

এরপর পুরো আইভরিকোষ্টে জাতিসংঘের কনসেনট্রেশন তাই কে কেন্দ্র করে মুভ করতে থাকল। পুলিশ কমিশনার ,ফোর্সঃ কমান্ডার, এসআরএসজি থেকে শুরু করে নিউইয়র্ক বানকি মুনের প্রতিনিধি সহ বহু ভিআইপি পরিদর্শনে তাই হয়ে উঠল ব্যস্ত নগরী। তাই এর পরিস্হিতি আস্তে আস্তে উন্নতি করতে থাকল। বাংলাদেশ পুলিশের উপস্হিতি ভিজিল্যান্স বাড়তে থাকলো, প্যাট্রলের সংখ্যা দুই থেকে বাড়িয়ে চার পাঁচে উন্নিত করা হলো। আশে পাশের পুরো এলাকায় প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে মিটিং করা হল বার বার, আশ্বস্ত করার চেষ্টা চলতে থাকল। আমাদের সাথে আনপোল, লোকাল পুলিশ ,জান্দারমারীর লোক,সিকিউরিটি সহ মানবাধিকার ডেস্কের অফিসার বৃন্দ সবসময় সমন্বয় করে কাজ করতে থাকলো। আমরা গ্রামবাসিদের বলি তোমাদের কোন ভয় নেই, তোমাদের জন্যই আমরা এখানে এসেছি, তোমাদের জরুরী যে কোন মুহুর্তে আমাদের কে পাবে, আমরা গ্রাম প্রধানের কাছে মোবা নম্বর দিয়ে আসতাম, ঔষধ, ডঃ সুবিধা, বা কোন ড্রাই ফুডসহ অন্যান্য যেকোন সাহায়্য যেমন আম্বুলেন্স,কোন দুর্ঘটনায় সাড়া দেওয়া ইত্যাদি যদি কারো লাগে আ্মাদের ক্যাম্পে যেন তারা নির্ভয়ে আসে বা ফোনে জানায়।এই সব বিষয় স্হানীয় লোকজনের মধ্যে ব্যপক সাড়া পড়ে গেলো। তারাও পরম নির্ভরতায় আমাদের বন্ধু ভাবতে থাকল এবং পুরো এলাকা জুড়ে একটা আস্হার পরিবেশ তৈরী হল।

প্রশাসনিক লোকজনের মাঝেও আমাদের সুনাম দ্রুত পৌছে গেল ।বাংলাদেশ পুলিশ কন্টিনজেন্টের ইয়ামুসুক্রুর গ্রুপটি দারুন তৎপর। তারা বেশ সাহসী এবং বন্ধুবৎসল। তাই তে ঘটতে থাকল এমন করে লাল সবুজের বিপ্লব।এই ক্যাম্পে যত আইভরিয়ান কাজ করে সবাই বাংলাদেশী বলতে যেন পাগল। দুপুর বা রাত্রের কেউ না কেউ আমাদের সাথে খাবার খায়। আমরাও না করিনা কখনো, কেননা আমরা তো অতিথিপরায়ন জাতি, পরিবারের লোকজনকে না খাইয়ে আমরা অতিথিদের জন্য ব্যপক আয়োজন করি। রাস্তায় গাড়ী বা আমাদের কাউকে দেখলেই ওদের অকৃত্রিম হাসিমাখা মুখ বা হাত দিয়ে সম্ভাষন জানানো কিংবা ওদের বাংলায় বলতে থাকা বাংলা পুলিশ গুড, কি যে ভাল লাগে। কেমন আছো, বিগ বস,আরামে দ্রা ইত্যাদি যখন হাসতে হাসতে বলে কি যে ভাল লাগে আফ্রিকান দের মুখে তখন বাংলা শুনতে! তাদের মুখে প্রশান্তির হাসি দেখে তখন মনে হয় আমাদের শ্রমটা বোধ হয় সত্যিই স্বার্থক! পরিবারের সুখশান্তি বিসর্জন দিয়ে পনের হাজার কিমি দুরের আফ্রিকান এক দেশে শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত করতে পেরে অনেক বেশী সফল মনে হয় নিজেকে তখন।

লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফেসবুক কর্নার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :