শীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় লবঙ্গ

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:১৩

শীতকালে রোগব্যাধি লেগেই থাকে। বিশেষ করে সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, বুকে কফ জমা, শ্বাসকষ্ট, বাতের ব্যথার মতো সমস্যা বেশি বেড়ে যায়। এই সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো খুব জরুরি, যাতে শরীর সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। শীতের সময় দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় এমন কিছু খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করুন, যাতে সুস্থ-সবল থাকতে পারেন। লবঙ্গ এমনই একটি খাবার যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। সাম্প্রতিককালের গবেষণা বলছে, শুধু রান্নার স্বাদ ও গন্ধ বাড়াতেই নয়, ঔষধি গুণাগুণে ভরপুর লবঙ্গ।

লবঙ্গ দারুণ একটি খাবার। রান্নার স্বাদে ঝাঁঝালো গন্ধ ও মশলাদার স্বাদ আনতে ব্যবহার করা হয় লবঙ্গ। যুগ যুগ ধরে আর্য়ুবেদিক চিকিৎসায় লবঙ্গের ব্যবহার হয়ে আসছে। মনে রাখবেন, এই মশলা বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান ও মিনারেলস-এ ভরপুর। এই খাবারে রয়েছে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেল। তাই ক্যানসার থেকে শুরু করে সুগারে আপনাকে বাঁচাতে পারে লবঙ্গ।

লবঙ্গ হচ্ছে লবঙ্গ গাছের শুকিয়ে যাওয়া ফুল। আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে লবঙ্গ গাছের নানা অংশ যেমন শুকনো ফুল, ডাল এবং পাতা ব্যবহার হয়ে আসছে। রান্নায় স্বাদ বাড়ানোর জন্য লবঙ্গ ব্যবহার করা হয়। সামান্য তরকারি হোক বা স্যুপ, বেকারি আইটেম হোক বা পায়েস, মাছ হোক বা মাংস— মশলাটির প্রয়োগে যে কোনও খাদ্যবস্তুর স্বাদহয়ে ওঠে স্বর্গীয়।

চির সবুজ লবঙ্গ গাছের ইংরেজি নাম ক্লোভ এবং বৈজ্ঞানিক নাম সিজিজিওমোরোমেটাম। লবঙ্গ গাছের ফুলের কুড়িকে শুকিয়ে তৈরি করা হয়। লবঙ্গকে লং বলেও ডাকা হয়। লবঙ্গ গাছ ১৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। বোটাসহ ফুলের কুঁড়ি শুকিয়ে গেলে লবঙ্গে পরিণত হয়। ফল ১ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়,এরা মাংসল,পাকার পরে শুকালে গাড়ো খয়েরী রঙ ধারণ করে।

লবঙ্গের আদিবাস ইন্দোনেশিয়ার মালুকু দ্বীপে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে লবঙ্গ ব্যবহার করা হয়। মাদাগাস্কার এবং ইন্দোনেশিয়ায় ব্যাপক ভাবে লবঙ্গ চাষ করা হয়। ইন্দোনেশিয়ায় এর আদিবাস হলেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় প্রচুর পরিমাণে লবঙ্গ উৎপাদিত হয়।

লবঙ্গের সুগন্ধের মূল কারণ ‘ইউজেনল’ নামের যৌগ। এটি লবঙ্গ থেকে প্রাপ্ত তেলের মূল উপাদান, এবং এই তেলের প্রায় ৭২-৯০% অংশ জুড়ে ইউজেনল বিদ্যমান। এই যৌগটির জীবাণুনাশক এবং বেদনা নাশক গুণ রয়েছে।

লবঙ্গের তেলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অ্যাসিটাইল ইউজেনল, বেটা-ক্যারোফাইলিন, ভ্যানিলিন, ক্র্যাটেগলিকঅ্যাসিড, ট্যানিন, গ্যালোট্যানিক অ্যাসিড, মিথাইল স্যালিসাইলেট, ফ্ল্যাভানয়েড, ইউজেনিন, র‌্যাম্নেটিন, ইউজেনটিন, ট্রি-টেরপেনয়েড, ক্লিনোলিক অ্যাসিড, স্টিগ্মাস্টেরল, সেস্কুইটার্পিন।

১০০ গ্রাম লবঙ্গে ৬৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৬ গ্রাম প্রোটিন, ১৩ গ্রাম টোটাললিপিড, ২ গ্রাম সুগার, ২৭৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি ও ৩৩ গ্রাম ডায়েটারিফাইবার থাকে।

খনিজের মধ্যে ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিঙ্ক –কমবেশি সবই আছে। আর ভিটামিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বি-৬, বি-১২, সি, এ, ই, ডি, কে, থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ফোলেট রয়েছে। এই সব যৌগের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য আছে।

লবঙ্গের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে তৈরি হওয়া ফ্রি র‌্যাডিকেলস ধ্বংস করতে পারে। ফলে হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারও প্রতিরোধেও বিশেষ ভূমিকা নেয়। তাই প্রতিদিন খালি পেটে লবঙ্গ চিবালে একাধিক অসুখের আশঙ্কা কমে যায়। বিশেষ করে পরিপাকতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে চাইলে ও দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে চাইলে লবঙ্গের জবাব নেই। মোটকথা একাধিক অসুখে লবঙ্গ আশ্চর্যজনকভাবে কার্যকরী। জেনে নিন লবঙ্গের স্বাস্থ্য উপকারিতা-

প্রত্যেক দিন ব্যক্তির রাতে ঘুমানোর আগে ১টি লবঙ্গ ও ১ গ্লাস গরম পানি পান করলে বিভিন্ন ধরনের রোগের থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে সহজেই। লবঙ্গ হজম প্রক্রিয়া উন্নত করতে সাহায্য করে। যেমন- গ্যাস, বমিভাব এবং বদহজমের মতো অনেক সমস্যায় লবঙ্গ খুব উপকারী। এছাড়াও লবঙ্গ প্রতিদিন খেলে গলায় সংক্রমণ হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বুকের জমে থাকা কফ বের হয়ে যায়। হজম, পিত্তবিনাশকারী, হাঁপানি, জ্বর, বদহজম, কলেরা, মাথাব্যথা, হাঁচি এবং কাশির মতো রোগেও এটি বিশেষ উপকারী।

লবঙ্গ কামোদ্দীপক ও যৌন রোগে উপকারি। লবঙ্গ কামোদ্দীপক। এর সুবাস অবসাদ দূর করে, শরীর ও মনের ক্লান্তি ঝরিয়ে দেয়। যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে।

লিভারে নতুন ও স্বাস্থ্যকর কোষ তৈরিতে সাহায্য করে লবঙ্গ। লিভার থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দিতেও কার্যকরী ভূমিকা নেয়। আসলে লবঙ্গে রয়েছে থায়মল এবং ইউজেনল নামে সক্রিয় উপাদান যা লিভারকে করে তোলে শক্তিশালী।

লবঙ্গের আর একটি উপাদান হল নাইজেরিসিন। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এই উপাদানের জন্যই রক্ত থেকে শর্করা বিভিন্ন কোষে পৌঁছে দেওয়া, ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোর কার্যক্ষমতা বাড়ানো ও ইনসুলিন নিঃসৃত হওয়ার পরিমাণ বাড়ানোর মতো কাজ ভালো ভাবে হয়। তাই মধ্য মাত্রার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে লবঙ্গ ভালো কাজে দেয়।

লো-বোন মাস এমন একটি অবস্থা, যা বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে অস্টিয়োপোরোসিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কয়েকটি পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, লবঙ্গের উপাদান হাড়ের জোর ও বোন ডেনসিটি বাড়াতে সাহায্য করে।

দাঁতের ব্যথা কমায়। লবঙ্গ দাঁতের ব্যথা দূর করে। মাড়ির ক্ষয় নিরাময় করে। লবঙ্গতে উপস্থিত অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান শরীরে প্রবেশ করার পর এমন কিছু বিক্রিয়া করে যে নিমেষে দাঁতের যন্ত্রণা কমে যায়। প্রায় সব টুথপেস্টের কমন উপকরণ এই লবঙ্গ।

বমি বমি ভাব দূর করে লবঙ্গ। ট্রেনে বা বাসে যাওয়ার সময় যদি মাথা ঘুরতে থাকে ও বমি এসে যায়, তাহলে মুখে একটি লবঙ্গ রেখে সেই রস চুষলে বমি ভাব ও মাথা ঘোরা কমে যাবে। গর্ভবতী মায়েরা সকালের বমিবমি ভাব দূর করতে লবঙ্গ চুষতে পারেন। লবঙ্গের সুগণ্ধ বমিবমি ভাবদূর করে।

লবঙ্গ সর্দি–কাশি ও ঠাণ্ডা লাগা কমায়। সর্দিকাশির মহৌষধ হিসেবে লবঙ্গ বহু বছর ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লবঙ্গ চিবিয়ে রস গিলে খেলে বা লবঙ্গ মুখে রেখে চুষলে সর্দি, কফ, ঠাণ্ডা লাগা, অ্যাজমা, গলাফুলে ওঠা, রক্ত পিত্ত আর শ্বাস কষ্টে সুফল পাওয়া যায়।

ধোঁয়া, রোদ এবং ঠান্ডার জন্য শ্লেষ্মা বেড়ে নানা ধরনের মাথা ব্যথা বা মাথার রোগ দেখা দিতে পারে। মাথা ব্যথা কমাতে লবঙ্গের উপকারিতা অপরিসীম।

প্রচণ্ড স্ট্রেস ও উৎকণ্ঠা কমায়। এক টুকরো লবঙ্গ মুখে ফেলে চুষে চুষে খেয়ে ফেলুন। পান করতে পারেন লবঙ্গের চাও। মেজাজ ফুরফুরে হয়ে উঠবে।

রক্ত পরিশোধন করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। লবঙ্গ শরীর থেকে ক্ষতিকর উপাদানগুলো সরিয়ে রক্তকে পরিশোধন করতে ভূমিকা রাখে। রক্তকে পরিস্কার করে।

লবঙ্গ হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। হজমে সহায়তা করে এমন এনজাইমনিঃসরণের মাধ্যমে এবং অ্যাসিড ক্ষরণের মাধ্যমে লবঙ্গ আমাদের হজম ক্ষমতা সক্রিয় করে তোলে। এরাফ্লাটুলেন্স, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, ডিসপেপসিয়া এবং নসিয়া কমাতে সাহায্য করে। এটি শরীরের রক্ত প্রবাহেরও উন্নতি ঘটায়।

আর্থ্রাইটিসের যন্ত্রণা কমায়। লবঙ্গে উপস্থিত অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান আর্থ্রাইটিসের প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে। প্রসঙ্গত, জয়েন্টপেইন কমানোর পাশাপাশি পেশির ব্যথা, হাঁটুতে, পিঠে বা হাড়ের ব্যথা এবং ফোলা ভাব কমাতেও এই ঘরোয়া ঔষধটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

ক্যানসার প্রতিরোধ করে লবঙ্গ। বিশেষ করে ব্রেস্ট ক্যানসার, ওভারিয়ান ক্যানসার প্রতিরোধ করে থাকে।

ছত্রাক ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি রোধ করতে লবঙ্গ দারুণ কাজে দেয়। বিশেষ করে চুল পড়া কমাতে এবং চুলের সৌন্দর্য বাড়াতে লবঙ্গ তেলের জুড়ি মেলা ভার। এক্ষেত্রে আধ চামচ লবঙ্গ তেলের সঙ্গে সম পরিমাণ অলিভ অয়েল মিশিয়ে সেই মিশ্রণ চুলের গোড়ায় লাগিয়ে মিনিটদশেক মাসাজ করতে হবে। মিনিটকুড়ি বাদে ঠান্ডা পানি দিয়ে আরেকবার চুল ধুয়ে নিতে ভুলবেন না যেন! নিয়মিত এইভাবে চুলের যত্ন নিলেই উপকার মিলবে। লবঙ্গ তেল আর লেবুর রস একসঙ্গে মিশিয়ে লাগালেও খুশকি চলে যায়।

ত্বকের বিভিন্ন সমস্যায় প্রাকৃতিক দাওয়াই হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে লবঙ্গ। বিশেষ করে ব্রণ, ফুসকুড়ি, ত্বকের লাবণ্য চলে যাওয়া এমনকি মাথার খুসকিও দূর করে লবঙ্গ। এছাড়াও ত্বকের বিভিন্ন দাগ দূর করতে ব্যবহার করতে পারেন লবঙ্গ। যে কোনও দাগ ভ্যানিশ। মুখে তেল ছিটকে ফোসকা পড়েছে? মশার কামড়ে লাল হয়ে গেছে? লবঙ্গ তেলেই লুকিয়ে সমাধান। লবঙ্গ তেল যে কোনও দাগ সহজেই তুলে দেয়। সেই সঙ্গে স্কিন টোন ভালো হয়। দাগ ছোপ মিলিয়ে যায়।

শুধু লবঙ্গ যেমন ভালো, ঠিক তেমন লবঙ্গ চা খাওয়াটাও দারুণ উপকারি। লবঙ্গ চা ওজন কমায়, ত্বকের সমস্যা দূর করে, সাইনাস থেকে মুক্তি দেয়, মাড়ি এবং দাঁতের ব্যথা কমায়।

লবঙ্গ চা তৈরির পদ্ধতি

সসপ্যানে দুই কাপ পানি দিন। পানি ফুটে উঠলে গ্যাস বন্ধ করে দিন। এতে ৪/৫টি লবঙ্গ গুড়া করে দিন, এর সঙ্গে আদাকুচি এবং দারুচিনি মেশান। ১৫ মিনিট ঢাকা দিয়ে রাখুন। তারপর চা ছেঁকে নিয়ে তাতে ১ চা-চামচ মধু এবং ১ টেবিল চামচ লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন।

ঢাকাটাইমস/২১ জানুয়ারি/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :