পোশাক শিল্পের হাত ধরেই দেশের অর্থনীতিতে এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য

মো. খসরু চৌধুরী সিআইপি
 | প্রকাশিত : ২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১৯:০৮

অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো শিল্প খাত। এক্ষেত্রে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান সবচেয়ে বেশি। এ খাত শুধু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারকেই সমৃদ্ধ করেনি, একইসঙ্গে নিশ্চিত করেছে অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান।

পোশাক শিল্পের হাত ধরেই দেশের অর্থনীতিতে এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে সামনের সারিতে বাংলাদেশ। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে পোশাক শিল্প। দেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান এবং তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের ক্ষমতা বাড়িয়েছে এ খাত।

বর্তমানে বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। সারা পৃথিবীতে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাতি দিয়েছে এই পণ্য। শ্রমঘন এ শিল্পটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। আশির দশক পর্যন্ত মোট রপ্তানির ৫০ শতাংশ ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। এরপর পাটকে পেছনে ফেলে পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু। ১৯৮২ সালে কারখানার সংখ্যা ছিল ৪৭ এবং ১৯৮৫ সালে ৫৮৭, আর ১৯৯৯ সালে ২ হাজার ৯শ এবং বর্তমানে কারখানা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের ৩ দশমিক ৮৯ ভাগ। কিন্তু গত দশ বছরের গড় হিসাবে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসছে এ খাত থেকে। পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণ নতুন উদ্যোক্তা দল সৃষ্টি করেছে। যারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী বেসরকারি খাত গড়ে তুলেছেন। এ খাতের হাত ধরেই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিকাশ হয়েছে। গার্মেন্টস দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও পরে তারা অন্যান্য শিল্পে রূপান্তর ঘটিয়েছে। আর বর্তমানে রাজস্ব আয়ের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই আসছে বেসরকারি খাত থেকে। অন্যদিকে পোশাক শিল্পের বিকাশে নারীর ক্ষমতায়নসহ বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা ছাড়াও তৈরি পোশাক শিল্পে ২৫ লাখের বেশি নারী শ্রমিক কাজ করছেন। এতে শ্রমজীবী নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন পরিবারে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের কারণে এসব নারীর সামাজিক মর্যাদাও বেড়েছে। চাকরির সুবাদে পুরুষের কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে।

স্বাধীনতার পর গত ৫১ বছরে পোশাক শিল্প দেশকে অনেক দিয়েছে। কর্মসংস্থান ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে বিশাল অবদান এ খাতের। আজকের যে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, তার পেছনে পোশাক শিল্পের অবদান অন্যতম। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ৩০টি অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশকে ধরা হয়।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বিরূপ অবস্থার মধ্যেও টিকে থাকার জন্য যে দুটি খাতকে কৃতিত্ব দেওয়া হয় তার একটি হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। রপ্তানি বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখা এই শিল্প কেবল দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডের ভূমিকাই রাখছে না, নারীর ক্ষমতায়নেও বিপ্লবের সূচনা করেছে।

২০২১-২২ অর্থ বছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো রপ্তানি থেকে ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এর মধ্যে কেবল তৈরি পোশাক খাত থেকে ৪২.৬১ বিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানির ৮১.৮১%। এটি রপ্তানি ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৯.৭৩%। বিপুল অংকের এই রপ্তানির পেছনে রয়েছেন গ্রাম থেকে উঠে আসা লাখ লাখ নারী।

জাতীয় অর্থনীতিতে শিল্প স্থাপন ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্প একধাপ এগিয়ে। সারা বিশ্বে তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। রফতানি বাণিজ্যেও তৈরি পোশাক শিল্পের আছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বেকার সমস্যা সমাধান, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই শিল্প। এ শিল্পের হাত ধরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে পেয়েছে নতুন পরিচিতি। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এই খাত। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেজিং ইত্যাদি শিল্পেরও ঘটেছে সম্প্রসারণ। এর বাইরেও পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্স্যুরেন্স সেবার চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্পে দক্ষতা অর্জন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ। গতবছর ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক বাংলাদেশ রফতানি করেছে, ২০৩০ সালে যা ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে। বাংলাদেশ এখন চাহিদা মোতাবেক যে কোনও পরিমাণ পণ্য যথা সময়ে সরবরাহ করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। রফতানি বাণিজ্যে বড় লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়নে সরকার প্রয়োজনীয় সবধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পণ্যের মান এবং ডিজাইন আধুনিক করা হচ্ছে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে কিছু বিদেশি দক্ষ কর্মী ছিল, এখন আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ কর্মীরাই কাজ করছে। শিল্প বিকাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। অনেক গুলোর কাজ এখন শেষ পর্যায়ে।

প্রতিযোগিতা মূলক বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিগত যে কোনও সময়ের চেয়ে বর্তমানে বিশ্বমানের ও আধুনিক তৈরি পোশাক তুলনামূলক কম দামে সরবরাহ করতে সক্ষম। সরকারের সহযোগিতায় তৈরি পোশাক শিল্পসহ দেশের অর্থনীতির চাকা চলমান ছিল। বাংলাদেশ এখন যে কোনও পরিমান পণ্য সরবরাহ করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।

এক সময়ে বাংলাদেশের মসলিন ও জামদানি ছিল ভুবন বিখ্যাত। কিন্তু উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের ফলে এ শিল্পের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়। বাংলাদেশে তার এই শিল্প মর্যাদা হারায়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে বস্ত্র ক্ষেত্রে তার হারানো গৌরব ফিরে পায়। বাংলাদেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পোশাক শিল্প এক নতুন সম্ভাবনাময় সংযোজন। বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে এই খাত থেকে। বেকার সমস্যা সমাধান বিশেষ করে সমাজের অবহেলিত অর্ধশিক্ষিত মহিলাদের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলার পেছনে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য।

পোশাক শিল্পের উৎপাদিত পোশাকের মধ্যে শার্ট, পাজামা, জিন্সপ্যান্ট, জ্যাকেট, ট্রাউজার, গেঞ্জি, স্যুয়েটার, পুলওভার, ল্যাবরেটরি কোর্ট, খেলাধুলার পোশাক, শীতকালীন নানা ধরনের গরম কাপড়ের তৈরি পোশাক, নাইট ড্রেস, মেয়েদের ব্লাউজ প্রভৃতি বিশ্ববাজারে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে।

বর্তমান বাংলাদেশে বস্ত্র শিল্প সংশ্লিষ্ট তৈরি পোশাক শিল্পের বিরাট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় গার্মেন্ট শিল্পের প্রসারের পথে বিরাজমান যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করে এ শিল্পের উত্তরণে এগিয়ে আসা সংশ্লিষ্ট সকলের অন্যতম দায়িত্ব। আর এ লক্ষ্যে সঠিক পরিকল্পনা ও সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলেই এখানে ১০০% সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।

লেখক: পরিচালক, বিজিএমইএ; শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ; চেয়ারম্যান, নিপা গ্রুপ ও কেসি ফাউন্ডেশন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :