স্মার্ট বাংলাদেশ- সিদ্ধান্ত আপনার না কি রোবটের

অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ
| আপডেট : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:২৮ | প্রকাশিত : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:২০

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশেকে নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে ঘোষণা করেছেন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ধারণাটি। ২০০৮ সালের দিকে যখন আমি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছি, তখন ভারতীয় এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয়। আমার পাশের টেবিলে বসে। পরিচয়ের পর জানতে চাইলাম তার গবেষণার বিষয়টা কী। উত্তরে সে বলেছিল- স্মার্ট সিটি। তখন মেলবোর্ন বিশ্বের সেরা শহর। তাই স্মার্ট সিটির প্রতি আমার তেমন আগ্রহ হয়নি। কারণ অস্ট্রেলিয়া তখন বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো eco-living নিয়ে ভাবছে। তাদের ভাবনায় কেবল মানুষ নয় প্রাণী, পরিবেশ স্থান পেয়েছে।

রাজনীতির অধ্যাপক মেলবোর্নের রবিন একরলেয় এবং লন্ডনের অ্যান্ড্রু ডবসন ইকোলজিকাল সিটিজেনশিপ নিয়ে প্রবন্ধ- বই লিখছেন। বিশ্বসংস্থাগুলো যখন পুরোনো টেকসই উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত, তখন পরিবেশ ন্যায়পরতা কিভাবে উন্নয়ন, পরিকল্পনা এবং সমাজ সংস্কারের আদর্শ হতে পারে।

স্মার্ট সিটি ধারণাটি এখন উন্নত বিশ্বে জনপ্রিয় ধারণা। এই ধারণার সঙ্গে স্মার্ট নাগরিক ধারণাটিও আছে। স্মার্ট হওয়া মানে সুনাগরিক হওয়া যার পেছনে থাকে শিক্ষা। একসময় আমরা গ্রামের মানুষদেরকে শহরের মানুষেরা বলতাম গেঁয়ো, চাষা, আনস্মার্ট, এর বিপরীতে শহরের ফ্যাশন করা ছেলে-মেয়েদেরকে বলতাম স্মার্ট। আর যে শিশুটি চটপট প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারতো তাকে বলতাম স্মার্ট। এখানে বুদ্ধিমান শিশুটি স্মার্ট।

সুতরাং সুন্দর পোশাক আশাক, বিনয়ী ও স্পষ্ট আচার আচরণ, বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ-তরুণীকে আমরা স্মার্ট বলে থাকি।

কিন্তু স্মার্ট সিটি ধারণাটি এসব থেকে ভিন্ন এবং স্মার্ট বাংলাদেশ ওই স্মার্টনেস যা সুন্দর পোশাক আশাক, বিনয়ী ও স্পষ্ট আচার আচরণ, বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ-তরুণীকে নির্দেশ করে সেই ধারণাটি থেকে অন্য কিছু। এখানে টেকনোলজি হচ্ছে মূল চালিকা শক্তি। এর মানে কি আমরা রোবটের কাছে সমর্পন করে আমাদের নাগরিক জীবন পরিচালনা করব?

স্মার্ট নাগরিক হতে হলে বুদ্ধিমান সত্তা হতে হবে। সুতরাং সেখানে থাকে জ্ঞানের বাহাদুরি। আর সেই বাহাদুরিকে যদি মূল চালিকা শক্তি বিবেচনা করি তবে শিক্ষার উন্নয়ন সবার আগে চলে আসে। এভাবে যদি আমরা চিন্তা করি তবে আমাদের নৈতিকতা কী হবে?

আমার এখন যে স্মার্টনেসের কথা বলছি তার কেদ্রবিন্দুতে আছে কৃত্রিম মেধা ও রোবট আছে বিগ ডাটা। আমি কাকে ভোট দেব কাকে সুন্দরী বলব সেটা আমাকে বলে দেবে রোবট, যে আমাদের সকল তথ্য জানে।

আমার রোগের বিবরণ দেব আর সেসব শুনে আমাদের রোবট বলে দেবে কী ঔষধ কিভাবে কতদিন খেতে হবে এবং সেগুলো কোথায় পাওয়া যাবে সেটাও বলে দেবে। তেমনি আমার বাড়িটি কোথায় কিভাবে বানানো তা ওই রোবট বলে দেবে। সুতরাং, আমাদেরকে রাজউকের অনুমতির জন্য একজন প্রকৌশলীর উপর নির্ভর করতে হবে না। তেমনি রোবট আমাদের নগর-গ্রামের পরিকল্পনা করে দেবে। আমাদের সকলে পড়াশোনা করা লাগবে না। বরং থাকতে হবে টাকা। কারণ রোবট বিনা পয়সায় কিছু করে দেবে না। আর টাকাও আমাদের লাগবে না। থাকবে একটি স্মার্ট কার্ড। সেটি উপস্থাপন করলেই আমাদের সকল সেবা পাবো। এমনকি মেট্রোরেলের দরজা খুলতে হবে না। পকেটে কার্ড থাকলে দরজা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাবে- একেবারে চিচিং ফাঁক !

এভাবে ভাবতে ভালো লাগে। স্মার্ট সিস্টেম বলে দেবে গর্ভের শিশুটি কন্যা নাকি পুত্রসন্তান এবং কোনোপ্রকার নৈতিক ঝামেলায় পড়তে হবে না গর্ভের শিশুটিকে ধ্বংস করতে। কারণ ভ্রূণটির চেতনা হওয়ার আগেই আমরা জেনে যাবো। এমন সিস্টেম যে আমি কী ভাবছি তা রোবট বলে দিতে সক্ষম হবে। সুতরাং, রোবট আগেই জেনে যাবে কোন নাগরিক কোন মার্কায় ভোট দেবে। ভোটারদেরকে ঝামেলা পোহাতে হবে না- কাকে ভোট দেব চিন্তা করে। যারা মনে করেন ভোটের দায় পরকালে বহন করতে হবে তারাও সঠিক প্রার্থী নির্বাচন করতে পারবেন। কারণ প্রার্থীদের সকল ডাটা আপনার জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং সেই ডাটা আপনাকে প্রক্রিয়া করতে হবে না। স্মার্ট রোবট বলে দেবে।

আপনি সন্তানকে নিউটন বানাতে চান- তো সে আপনার জীন গবেষণা করে বলে দিতে পারবে কিভাবে এডিটিং করলে আপনার সন্তান নিউটন হবে আবার শাহরুখ খানের মতো স্মার্ট হবে।

আমরা কি তবে আর আমাদের মতো থাকতে পারবো না? আমরা কি তবে যন্ত্রের পেছনে যারা আছেন তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবো? আমরা কি তবে এভাবে দাসত্ব বরণ করবো টেকনোলজি ও তার পেছনের মানুষগুলোর কাছে? সিদ্ধান্ত আপনার।

স্মার্ট বাংলাদেশে সিদ্ধান্ত আপনার থাকে কি? কারণ চারিদিকে থাকবে সুবিধাবাদী লোকের সমাহার। তারা নানা জীবন পলিসি নিয়ে আপনাকে উতপাৎ করবে- যেমন ডেভেলপাররা আপনার পুরোনো বাড়িটি ভেঙে নতুন অট্টালিকা বানিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখাবে। এখানে পুলিশ বসে থাকবে কম্পিউটার কী বলে এবং সেইভাবে সে সিদ্ধান্ত নেবে। আমাদের সেনারা সিদ্ধান্ত নেবে কিভাবে সীমান্ত সুরক্ষা দেবে এবং আকাশ মুক্ত রাখবে।

কিন্তু সেখানে যদি একটি ভাইরাস কেউ ঢুকিয়ে দিতে পারে তবে সর্বনাশ হবে যাবে। আপনি হয়ে যাবেন তাদের দাস অথবা একটি স্বাধীন সত্তাবিহীন মেধাশুন্য মানুষ। আপনার চিন্তার স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে ওরা। ওই কম্পিউটারে/রোবটের পেছনে বসে থাকা মানুষগুলো আপনাকে নিয়ে খেলবে! আপনি কারও খেলনা হবেন না কি? অবশ্য আমাদের নিয়ে এখন ধনী দেশগুলো খেলছে।

সুতরাং, আমরা বন্দি- আমরা তাদের খেলনা। তারা আমাদের মাথায় সুকৌশলে ঢুকিয়ে দেয় আদর্শ, নৈতিকতা, উন্নয়ন। আমরা তাদের গোলামী করছি যুগ যুগ ধরে। আমাদের মুক্তি কোথায়, যে মুক্তি বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন। যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন। সবুজ শ্যামল সোনার বাংলা !

লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :