চাঁদপুরের গৌরব ঐতিহাসিক হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ কমপ্লেক্স

চাঁদপুর জেলার অত্যন্ত জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে ইদানীং ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছে হাজীগঞ্জ। এ উপজেলা একটি সড়কপথে ও নদী পথে ব্যাপক যোগাযোগের নির্ভরযোগ্য স্থান হিসেবে মর্জাদা অর্জন করায় এখানে একটি নতুন জনবহুল শহরে গড়ে ওঠে। তা এখন হাজীগঞ্জ মডেল শহরে রূপ লাভ করেছে। এখানেই অবস্থিত হয়েছিল শতশত বছরের সেই ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। যাকে এক কথায় বলা হয় হাজীগঞ্জ ঐতিহাসকি বড় মসজিদ কমপ্লেক্স।
চাঁদপুর নৌ-সীমানার নদী বন্দর এলাকা হিসেবে খ্যাত চাঁদপুর জেলার ঐতিহ্য ও গুরুত্ব বহু বছরের। এই জনপদে ইসলাম প্রচারের কাজে দেশ-বিদেশ থেকে অনেকেই এসেছেন। অনেক পীর আউলিয়া এসে বসতি স্থাপন করেছেন। যে কারণে জেলায় গড় উঠেছে ধর্ম প্রচার কেন্দ্র (খানকা), শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইবাদতের জন্য বড় বড় স্থাপনা। জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে গড়ে উঠেছে ইবাদতের মারকাজ খ্যাত হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ কমপ্লেক্স। দৃষ্টি নন্দন এই মসজিদটি হচ্ছে দেশ ও বিদেশে সবার কাছে খুবই পরিচিত একটিস্থান। মসজিদের নয়নাভিরাম পরিবেশ দেখলে মনের মধ্যে প্রশান্তি জাগে। এই কমপ্লেক্সটি এখন উপজেলার সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।
জানা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দা আহমাদ আলী পাটওয়ারী ১৩২৫ বঙ্গাব্দের দিকে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করে বিশাল সম্পত্তি ওয়াকফ করেন। ওই সম্পত্তিতেই গড়ে ওঠে হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ কমপ্লেক্স। মসজিদের ৯ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি হিসেবে থাকছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।
১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ১৭ আশি^ন আহমদ আলী পাটওয়ারী (রহ.)’র পরম ইচ্ছায় হযরত মাওলানা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.) এর পবিত্র হাতে পাকা মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। মসজিদের প্রথম অংশ (পূর্ব) ৪৭৮৪ বর্গফুট, মাঝের অংশ ১৩০০৬ বর্গফুট এবং শেষাংশ (পশ্চিম) ১৬১৫ বর্গফুট। সর্বমোট মসজিদের আয়তন ২৮৪০৫ বর্গফুট।
মসজিদের প্রথম অংশের ওপরের দিকে সুরা ইয়াছিন ও সুরা জুমআ লিপিবদ্ধ ছিল। সংস্কারের সময় তা উঠিয়ে মসজিদের কবরস্থানে দাফন করা হয়। মসজিদের অনন্য সুন্দর মেহরাবটি কাচের ঝাড়ের টুকরো নিখুতভাবে কেটে কেটে মনোরম ফুলের ঝাড়ের ন্যয় আকর্ষণীয় নকশা সাজিয়ে তোলা হয়েছে। মাঝের অংশটি ৭৭টি আকর্ষণীয় পিলার ও ঝিনুকের মুজাইক দিয়ে নির্মিত হয়। তৃতীয় অংশে রয়েছে তিনটি বিশাল গম্বুজসহ আকর্ষণীয় বিশাল সুউচ্চ মিনার। ইংরেজি ১৯৫৩ সালে ১২২ ফুট উঁচু এই সুউচ্চ মিনারটি নির্মিত হয়।
কারুকার্য খচিত মসজিদের সর্বশেষ পূর্ব প্রাচীরের পবিত্র কালেমা শরীফ খচিত চিনা বাসনের টুকরো দিয়ে তৈরি মনোরম ফুলের ঝাড়ের ন্যয় আকর্ষণীয় করে সাজানো বিশাল ফটক। মসজিদের প্রবেশের সুবিশাল ফটকের আকর্ষণীয় সাজ দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নেয়। পাথরের সাজে সজ্জিত অসংখ্য তারকাখচিত তিনটি বড় বড় গম্বুজ পর্যটকদের আকর্ষণ করে তুলে।
মসজিদ কমপ্লেক্স থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এই মসজিদের জুমার নামাজের আজান ও একামতের উদ্বোধনী দিবসে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ চারজন মন্ত্রী এসেছিলেন। এ মসজিদে নামাজ পড়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ আরও অনেকে। বিভিন্ন সময় এসেছেন বরেণ্য আউলিয়ারাও।
স্থানীয়ভাবে প্রচলিত আছে, এই মসজিদ কমপ্লেক্সটি আল্লাহর অলীগণের রুহানী ফয়েজ ও বরকতে শিরক-বিদাত মুক্ত এবং ইবাদতের মারকাজ হিসেবে খ্যাত। মসজিদের কারামত ও ফয়েজ-বরকতে এই উপজেলা একন গৌরবান্বিত। যে কারণে অনেকেই নিয়ত ও মানতের অর্থ এখানে অনেক দান করে থাকেন। এই রেওয়াজ বহুবছর থেকে চালু আছে এবং মহিলারা দূর-দূরান্ত থেকে এখানে এসে নামাজ আদায় করছেন।
মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসা মুসল্লি নুরুল ইসলাম বলেন, আসলে সকল মসজিদে নামাজ আদায় করা সমান। কিন্তু এই মসজিদের পরিবেশ আমাদেরকে খুবই আকর্ষিত করে। যার কারণে অনেক দূর থেকে নারী-পুরুষ অনেকেই এসে নামাজ আদায় করেন।
প্রবীণ মুসল্লী মো. আব্দুল্লাহ বলেন, এই মসজিদের সৌন্দর্য মুসল্লিদেরকে টানে। এখানে আসলে যে বেহেশতি পরিবেশ পাওয়া যায়, সেটি অন্যস্থানে নেই বললেই চলে।
মসজিদের খতিব হাফেজ মুফতি আব্দুর রউফ বলেন, এই মসজিদে প্রতি জুমআর দিন প্রায় ২০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। রমজান মাসের শেষ জুমআর দিন প্রায় লক্ষাধিক মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। বিশেষ করে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় মহিলাদের জন্য পৃথক নামাজের ব্যবস্থা করা আছে। শুধুই তাই নয়, অনেকেই পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে এখানে এসে নামাজ পড়েন। মসজিদের পাশপাশি এখানে মাদ্রাসায় প্রায় ১১শ’ শিক্ষার্থী অধ্যায়ণরত আছে।
হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ কমপ্লেক্সের অধীনে রয়েছে আবাসিক ও অনাবাসিক মাদ্রাসা ও এতিমখানা। এর মধ্যে রয়েছে আহমাদিয়া কামিল মাদ্রাসা, মুনিরিয়া নুরানি মাদ্রাসা, ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং। এ ছাড়া মসজিদের অর্থ যোগানের জন্য স্থায়ী আয়ের উৎস হিসেবে রয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে মেহনত করছেন শিক্ষক ও কর্মচারী মিলিয়ে কর্মরত আছেন প্রায় ২০০ মুসল্লি।
ঐতিহাসিক মসজিদটির প্রথম মোতওয়াল্লি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ আলী পাটওয়ারী। তার মৃত্যু পর দায়িত্ব পান তার তৃতীয় পুত্র মো. মনিরুজ্জামান পাটওয়ারী এবং তার মৃত্যুর পর মোতওয়াল্লির দায়িত্ব নেন বড় ছেলে ড. মো. আলমগীর কবির পাটওয়ারী।
ড. মো. আলমগীর কবির পাটওয়ারী বলেন, প্রতি মাসে দান বাবদ যে টাকা পাওয়ায় যায়, তা দিয়ে মসজিদ কমপ্লেক্সের ব্যয় নির্বাহ সম্ভব হয় না। বাকি টাকা আসছে দোকান-মার্কেটের ভাড়ার টাকা থেকে। বর্তমানে এ ওয়াক্ফ এস্টেট ১০ কোটি টাকারও বেশি ঋণগ্রস্ত। তা সত্তে¡ও সর্বোত্তম সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, নিরবচ্ছিন্ন অজুর পানি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পর্যাপ্ত আলো ও বাতাসের ব্যবস্থা, ওয়াজ-মাহফিলসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা, রমজান মাসে রোজাদারদের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা, ইতেকাফকারীদের সেবা প্রদান, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা-এসব চালিয়ে যাচ্ছি। মাদ্রাসাগুলোর সংস্কার, উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণসহ যে কোনও দুর্যোগে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক কার্যক্রমেও সাধ্যমত আর্থিক সহযোগিতা করা হচ্ছে মসজিদের পক্ষ থেকে। এই কমপ্লেক্স হাজীগঞ্জ তথা জেলার উন্নয়নে মাইল ফলক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এ স্থানে কেহ না’আসলে বুঝতে পারবে না আল্লাহ্ তার বান্দার জন্য আলাহ্তালা এখানে কী নিদর্শন রেখেছেন।
(ঢাকাটাইমস/১২এপ্রিল/এআর)

মন্তব্য করুন