শরীরের ওজন কমানো ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধের মূলমন্ত্র

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৮ জুন ২০২৩, ০৮:৩০ | প্রকাশিত : ০৮ জুন ২০২৩, ০৮:২৮

ফ্যাটি লিভার রোগটি বিশ্বজনীন। যকৃতে চর্বি জমাকে ফ্যাটি লিভার বলে। মানুষ বুঝতেই পারেন না যে লিভারে ফ্যাট জমলে তা গুরুতর আকার নেয়। দেশে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি লোক ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, জীবনাচরণ পরিবর্তনের পাশাপাশি ৭ থেকে ১০ শতাংশ শরীরের ওজন হ্রাস করাই ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধের মূলমন্ত্র। ফ্যাটি লিভার থেকে মুক্তি পেতে ওজন কমানো সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। যাদের ওজন বেশি, তারা যদি মাত্র ৭-১০% ওজন কমাতে পারেন তবে ফ্যাটি লিভার থেকে খুব দ্রুতই মুক্তি সম্ভব।

রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, বিভিন্ন মেডিসিনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, অতিরিক্ত ওজন বা খুব দ্রুত ওজন কমানো, পেটে অতিরিক্ত মেদ, বেশি পরিমাণ রিফাইন্ড শর্করা গ্রহণ, মদ্যপান বা জেনেটিক্স কারণে একজন মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হতে পারেন। মূলত, শর্করা এবং ফ্যাট বিপাক ক্রিয়ার নানা অসামঞ্জস্যতার ফলে এই রোগ হয়।

লিভার মানুষের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি বিপাকের কাজ করে। এছাড়া হজমেও সাহায্য করে। ফ্যাটি লিভার মানে হলো যকৃতে চর্বি জমে যাওয়া এবং যকৃত একটু বড় হয়ে যাওয়া। শরীরে উৎপন্ন বিষাক্ত কিছু পদার্থকে পরিবর্তন ঘটিয়ে কম ক্ষতিকারক পদার্থে পরিণত করে বিভিন্ন উপায়ে শরীরের বাইরে নির্গমনের কাজ করে লিভার। লিভার কখনোই বিশুদ্ধ পদার্থগুলো নিজের মধ্যে জমা করে রাখে না। লিভারে চর্বি জমলে সেখানে প্রদাহের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তখনই সিরোসিস অব লিভারের ঝুঁকি বাড়ে।

মানুষের লিভারে সাধারণত ৩-৪ পাউন্ড চর্বি থাকে। লিভার সেলের চারপাশেও কিছু চর্বি থাকে। এ চর্বির পরিমাণ কোনোভাবে বেশি হলে অর্থাৎ ১০ শতাংশের বেশি হলে সেটিকে ফ্যাটি লিভার বলা হয়।

সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগ জটিল হয়ে লিভার সিরোসিসের মতো জটিলতা হতে পারে। লিভারের মধ্যে সাধারণত ৫ শতাংশ চর্বি শোষণ হতে পারে। যদি ৫ শতাংশের ওপরে চর্বি জমা হয়ে থাকে, তখনই আমরা একে ফ্যাটি লিভার বলে থাকি।

ফ্যাটি লিভার দুই প্রকার, অ্যালকোহলযুক্ত ফ্যাটি লিভার এবং নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার। প্রথমটি অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে এবং দ্বিতীয়টি অ্যালকোহল ছাড়া অন্য অনেক কারণে হয়ে থাকে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফ্যাটি লিভারের অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে চর্বি এবং কার্বোহাইড্রেট বেশি গ্রহণ, ডায়াবেটিস এবং শারীরিক কার্যকলাপের অভাব ইত্যাদি।

ফ্যাটি লিভার স্বাভাবিক থাকলে অর্থাৎ লিভার অ্যানজাইমগুলো যদি না বেরিয়ে থাকে, লিভারে কোনো প্রদাহ না থাকলে তাকে স্বাভাবিক ফ্যাটি লিভার বলা হয়। তবে ফ্যাটি লিভার থেকে লিভারে প্রদাহ হলে তাকে বলে স্ট্যাটো হেপাটাইটিস। অর্থাৎ ফ্যাটি লিভারের কারণে তার প্রদাহ হয়েছে।

এ ছাড়া থাইরয়েড হরমোনে কোনো সমস্যা থাকলে ফ্যাটি লিভার হতে পারে। ডায়াবেটিস ওজন আধিক্য, চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণ ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ফ্যাটি লিভারের সব থেকে বড় লক্ষণ স্বাভাবিকের থেকে বেশি কোমরের মাপ। মোদ্দা কথা ভুঁড়ি। লিভারে চর্বি জমলে স্বাভাবিক কাজ কিছুটা ব্যাহত হয়। খাওয়ার ইচ্ছা কমে যায়, খাবারে অরুচি হয়, দ্রুত ওজন কমা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, খুব দুর্বল লাগা ও কোনো কাজ করতে ইচ্ছা না করা।

ফ্যাটি লিভার হলে মাথাব্যথা, মন খারাপ ও ডিপ্রেশন, আচমকা কাঁপুনিসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়। নখ বা চোখ হলদেটে লাগলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে লিভার ফাংশন টেস্ট করিয়ে নিতে হবে। হজমের সমস্যা ও অ্যাসিডিটির সমস্যা হতে পারে।

ফ্যাটি লিভার রোগ থেকে বাঁচার জন্য খাদ্যভাসে পরিবর্তন আনার কোনো বিকল্প নেই। একজন মানুষের ওজন, উচ্চতা, পরিশ্রমের ধরন, শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে নিয়মিত সুষম এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। বিভিন্ন রঙের শাকসবজি, ফল, লাল আটার রুটি বা লাল চালের ভাত এবং সঠিক পরিমাণে প্রোটিন, খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন রাখতে হবে। চিনি এবং চর্বি জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে।

ফ্যাটি লিভারে যে সব খাবার খাবেন

সবুজ শাক-সবজি

ব্রোকলি লিভারে চর্বি জমতে বাধা দেয়। পালং শাকসহ সবুজ শাক-সবজি ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে।

প্রদাহ কমায় ও চর্বির মাত্রা ঠিক রাখে মাছ

স্যামন, সার্ডিন, টুনা এবং ট্রাউটের মতো মাছে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড বেশি থাকে। ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড লিভারে ফ্যাটের মাত্রা উন্নত করতে সাহায্য করে এবং প্রদাহ কমিয়ে আনে।

রসুন

খাবারের স্বাদ বাড়াতে খাবারে রসুন ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ভেষজটি ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত মানুষের শরীরের ওজন এবং চর্বি কমাতে সাহায্য করতে পারে।

দুধ এবং কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাতীয় খাবার

দুধ থেকে তৈরি ছানা, মাঠা বা ঘোলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে। এটি লিভারকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। ২০১১ সালে ইঁদুরের ওপর গবেষণা চালিয়ে এমন যুক্তির পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়।

আখরোট

আখরোটে প্রচুর পরিমাণে থাকে ওমেগা থ্রি। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত যারা আখরোট খেয়েছেন তাদের লিভার ফাংশনের আরও উন্নতি হয়েছে।

তেঁতুল

তেঁতুল খেলে দূর হয় ফ্যাটি লিভার। শুধু ফ্যাটি লিভার নয়, যে কোন ধরনের লিভারের সমস্যা থাকলে তেঁতুল সব থেকে উপকারি। তেঁতুল আমাদের শরীর থেকে ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দেয় এবং হজম প্রক্রিয়াকে সঠিক রাখে। এছাড়াও খারাপ কোলেস্টেরল ধ্বংস করে।

অ্যাভোকাডো

অ্যাভোকাডোতে স্বাস্থ্যকর চর্বি বেশি থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, অ্যাভোকাডোতে থাকা রাসায়নিক লিভারের ক্ষয় ধীর করে দিতে পারে। এটি ফাইবার সমৃদ্ধ, যা ওজন নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে।

সূর্যমুখী বীজ

সূর্যমুখী বীজে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-ই রয়েছে। এটি একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা লিভারকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে।

গ্রিন টি

গবেষণায় দেখা গেছে যে, গ্রিন টি শরীরের চর্বি কমাতে সাহায্য করতে পারে। যদিও গবেষণার ফলাফল এখনো চূড়ান্ত নয়। গবেষকরা দেখেছেন যে, গ্রিন টি লিভারে চর্বি সঞ্চয় কমাতে পারে এবং লিভারের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে। এছাড়াও গ্রিন টিতে আরও অনেক উপকারিতা রয়েছে।

কফি

গবেষণায় দেখা গেছে যে ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্তদের মধ্যে যারা কফি পান করেন তাদের লিভারের ক্ষতি কম হয়েছে। আর যারা কফি পান করেন না তাদের ক্ষতি বেশি হয়েছে। কফিতে থাকে ক্যাফেইন। ক্যাফেইন অস্বাভাবিক লিভার এনজাইমের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।

অলিভ অয়েল

স্বাস্থ্যকর অলিভ ওয়েলে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, অলিভ অয়েল লিভারের এনজাইমের মাত্রা কমাতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে

বিশুদ্ধ পানি

যকৃত বা লিভার ভালো রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে পানি পান করা। লিভার ভালো রাখতে অবশ্যই সঠিক পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করা আবশ্যক। সুতরাং, অস্বাস্থ্যকর পানীয় যেমন কার্বোনেটেড বেভারেজ বা রাস্তার মোড়ে থাকা শরবত পানের অভ্যাস থাকলে আজ থেকে বাদ দিন এবং বিশুদ্ধ পানি পান করুন এবং আপনার যকৃতকে ভালো রাখুন।

যেসব নিয়ম মানতে হবে

ফ্যাটি লিভার কমাতে প্রতিদিন ব্যায়াম করা জরুরি। বাড়িতে প্রতিদিন সকালে ১৫ থেকে ২০ মিনিট নিয়ম করে ব্যায়াম করুন। এতে লিভারের সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফ্যাটি লিভারও সেরে যাবে কিছুদিনে।

ফ্যাটি লিভারের অর্থ হলো লিভারে ফ্যাট জমতে থাকা। চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার লিভারের জন্য বিষ বললেও ভুল বলা হয় না। তাই চিনি খাওয়া একেবারেই কমিয়ে দিন। কোনোরকম মিষ্টিজাতীয় খাবারও খাবেন না।

তেলজাতীয় খাবারও লিভারের জন্য ভালো নয়। এই ধরনের খাবার শরীরে ফ্যাট জমতে সাহায্য করে। এর ফলে লিভারের অবস্থা আরও খারাপ হবে। ফ্যাটি লিভার কমাতে হলে তৈলাক্ত খাবার একেবারেই ভুলে যাওয়া ভালো।

মদ লিভারের জন্য ক্ষতিকর, তারপর যদি ফ্যাটি লিভার হয়, তাহলে তো কথাই নেই। মদ এড়িয়ে চলুন সম্পূর্ণ। অন্যদিকে প্রতিদিন বেশি পরিমাণে পানি খান। পানি শরীরের টক্সিন বা ক্ষতিকর পদার্থ ধুয়ে বের করে দেয়। এর ফলে লিভারও ভালো থাকে।

প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটাহাঁটি করতে হবে। শরীরচর্চা ফ্যাটি লিভারের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। তাই সকালে নিয়ম করে এক ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি শুরু করুন। এতে শরীর ভালো থাকবে। ফ্যাটি লিভারও সেরে যাবে।

নিয়মিত স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাবার সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করলে ডায়াবেটিস, ওজন নিয়ন্ত্রণ বা লিপিড প্রোফাইল ঠিক রাখা কোনো কঠিন বিষয় নয়। আর এই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারলে লিভার থেকে ফ্যাট খুব সহজে দূর হবে। মনে রাখবেন, লিভার ভালো রাখতে ফিট থাকার কোনো বিকল্প নেই।

(ঢাকাটাইমস/০৮ জুন /আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :