যুক্তরাষ্ট্র, কংগ্রেসম্যান ও বাংলাদেশ

মো. সাখাওয়াত হোসেন
  প্রকাশিত : ১৮ জুন ২০২৩, ০৮:৪৬
অ- অ+

খবরে জানা যায়, বিশেষ একটি কোম্পানিকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহে বিশেষ সুবিধা না দেওয়ায় বাংলাদেশের ওপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছয় কংগ্রেসম্যান। এ কারণেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যু সামনে এনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে রিপাবলিকান দলীয় ওই কংগ্রেসম্যানরা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে চিঠি লেখেন। চিঠিতে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও তথ্য তুলে ধরে এর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করেন তারা। পরে ওই চিঠিসহ একটি বিবৃতি নিজের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন কংগ্রেসম্যান বব গুড। বব গুড সাধারণত কনজারভেটিভ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচিত এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অধিকার প্রতিষ্ঠায় সামাজিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে থাকেন। উল্লেখ্য, ছয় কংগ্রেসম্যানের কর্মকান্ড নিয়ে স্বয়ং আমেরিকাতে আলোচনা সমালোচনা আছে।

কোন ধরনের বিষয় মূলত ছয় কংগ্রেসম্যানকে চিঠি লিখতে প্ররোচনা যুগিয়েছে এর কার্যকারণ খুঁজে বের করা জরুরী হয়ে পড়েছে। কেননা সামনে জাতীয় নির্বাচন, এই নির্বাচনকে ঘিরে দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রের জাল ফেলা হয়েছে এবং এর থেকে উত্তরণে সর্বোচ্চ সতর্ক থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ধারণা করা হচ্ছে; রাজনীতির মেরুকরণ তথা আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাব প্রতিপত্তির হিসাব নিকাশের ফলশ্রুতিতে বিরোধীদের লবিং ও জোর তদবিরের কারণে সরকারের বিরুদ্ধে আমেরিকার সরকারকে চিঠি দিয়েছে ছয় কংগ্রেসম্যান। এলএনজি সরবরাহে বিশেষ ‍সুবিধা না দেওয়ায় উল্লিখিত কংগ্র্যাসম্যানদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে চীন সরকারের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় আমেরিকা রুষ্ট হয়েছে।

বিভিন্ন পর্যালোচনায় জানা যায়, মার্কিন কোম্পানি লিন্ডেন এনার্জিকে বাংলাদেশে এলএনজি সরবরাহের বড় ব্যবসা পাইয়ে দিতে কয়েক বছর ধরে চলছে নানা তৎপরতা। কোম্পানিটি এলএনজি সরবরাহে অগ্রাধিকারমূলক সুযোগ চেয়েছিল। উল্লেখ করা হয়, প্রস্তাবিত বাণিজ্য সুবিধা পেলে বাংলাদেশের র‌্যাব ও এর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশন) তুলে নেওয়ার জন্য কাজ করার কথা বলা হয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য যাতে ‘অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার’ পায়, সে বিষয়েও ভূমিকা রাখার কথা জানান তারা।

ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসভিত্তিক বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি বাংলাদেশে ২০ বছর মেয়াদে এলএনজি সরবরাহের জন্য একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছে। প্রস্তাবে একটি অফশোর (সমুদ্রে) এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ ও বছরে চার মিলিয়ন টন এলএনজি সরবরাহ করতে চায়। কোম্পানটি আরও প্রস্তাব করেছে যে, এর বিনিময়ে তারা মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশি গার্মেন্ট পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের শুল্কমুক্ত বা কম শুল্কে প্রবেশাধিকার নিশ্চিতের বিষয়টি নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখতে চায়। অর্থাৎ তাদের প্রস্তাব কিন্তু উদ্দেশ্যমূলক ও দূরভিসন্ধিমূলক। কেননা কোন কোম্পানী যখন স্বাভাবিকভাবে একটি সরকারকে তাদের পণ্যের উপর প্রস্তাব প্রদান করে সেখানে তাদের পণ্যের গুণাগুণ, পণ্যের ‍উপর নির্ভরশীলতা, পণ্যের বহুমুখিতা প্রভৃতি বিষয়ের উপর বিশ্লেষণমূলক দক্ষতার মূল্যায়ন দেখাতে হয়। গুনাগুণ ও দামের বৈচিত্র্যতার কারণে ক্রেতা মূল্যায়নপূর্বক পণ্যের অর্ডার করে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পণ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ না করে অন্যদিকে ইঙ্গিতপূর্ণ বিষয়াদির উল্লেখ করায় প্রস্তাবটিকে অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্যমূলক মনে হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। প্রকৃতঅর্থে, বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ‍উপর নির্ভরতা কমে এসেছে, বাংলাদেশ কার্যকর সকল ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে এবং কিছু কিছু জায়গায় আন্তর্জাতিক পরিসরে নেতৃত্ব প্রদান করছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমেরিকার বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা আমাদের কারও অজানা নয়, তলাবিহীন ঝুড়ি স্বীকৃতি দিয়ে অনেকেই মন্তব্য করেছে। সে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় সাফল্যে রাষ্ট্রটি ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিতে পারে, এমনটা ভাবা কোনভাবেই অমূলক নয়। সে কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে আমেরিকার যে কোন ধরনের মন্তব্যের বিষয়ে মন্তব্য করার পূর্বে সামগ্রিক বিষয়টি নিয়ে পরিপূর্নরূপে মূল্যায়ণ করার প্রয়োজন রয়েছে।

যেহেতু এলএনজি সরবরাহের বিষয়টি সামনে এসেছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকার অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে কথা হচ্ছে; এলএনজি সরবরাহের বাইরেও এরকম আরও বিষয় থাকতে পারে যেখানে সরকার সঠিক পন্থা অবলম্বন করায় আমেরিকা গোস্বা করেছে। তাদের গোস্বা থেকেই বাংলাদেশের উপর তারা বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার পায়তারা করছে এবং বিষয়গুলো পত্রিকার পাতায় ফলাও করে ছাপা হচ্ছে। কিন্তু ভেতরের বিষয় সম্বন্ধে সাধারণ জনতা তেমন অবগত নয় তাই সঠিক বিষয় বাইরে বের হয়ে আসছে না এবং সাধারণ জনতা অন্ধকারে থাকছে। আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, প্রয়োজনে সরকার রাষ্ট্রীয় কাজে লবিষ্ট নিয়োগ করে ভেতরকার খবর বের করে নিয়ে আসতে পারে এবং আমাদের দেশের জনসাধারণকে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

এলএনজি সরবরাহের বিষয়ে ভেতরকার খবর যেহেতু কিছুটা হলেও বাইরে এসেছে সেহেতু এর বাইরেও আরও কোন খবরাখবর থাকতে পারে সে বিষয়েও আমাদের মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এখানে বলাবাহুল্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা যেভাবে নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মনোবাসনা দেখিয়ে চলেছে বিগত সময়ে সাধারণত এমনটা দেখা যায়নি। কার্যত আমেরিকার স্বার্থে আঘাত লাগায় এমনটি ঘটেছে বলে মন্তব্য অনেকের। যে কোন মূল্যে আমেরিকা তাদের হস্তক্ষেপ ধরে রাখতে চায়, যখন তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কোন রাষ্ট্র সম্মতি প্রদান না করে তখনি তারা রাষ্ট্রটির উপর স্যাংশন দিয়ে থাকে। বর্তমান সরকারের সময়ে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে সরকারকে চাপে রাখতে উঠেপড়ে লেগেছে। এমনটি কেন করছে, সে বিষয়ে অধিকতর তদন্ত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে সঠিক বিষয় তুলে নিয়ে এসে জনগণকে জানানো উচিত। তাহলে জনগণ আমেরিকার প্রকৃত চরিত্র সম্বন্ধে জানতে পারবে এবং বিশ্ববাসীও বাংলাদেশের ব্যাপারে আমেরিকার গ্রহণীয় ব্যবস্থা ব্যাপারেও অবগত হবে।

মার্কিন প্রশাসন সবসময়ই সাম্রাজ্যবাদে বিশ্বাসী। তাদের সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারে কেউ সাড়া না দিলে কিংবা বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে বিষয়টিকে তারা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। বাংলাদেশ নানাবিধ কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে থাকে। আবার অর্থনৈতিক সক্ষমতায়ও বাংলাদেশ অসামান্য অগ্রগতি সাধন করছে। সেই অগ্রগতির কারণেই বিশ্ব বিনিয়োগও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। সকল কিছু বিবেচনায় আমেরিকার একটি কোম্পানী বাংলাদেশে এলএনজি সরবরাহের প্রস্তাব পাঠায়, পত্রিকার সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি জানা যায়। প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল, আমেরিকার প্রশাসনের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক মজবুত করার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত কোম্পানীটি ভূমিকা রাখবে মর্মে চিঠিতে বলা হয়।

সঙ্গত কারণেই মনে হয়, আমেরিকার অভিযোগের ব্যাপারে সরকারের দুর্বলতা থেকে থাকলে সরকার আমেরিকার কোম্পানীটির প্রস্তাব লুফে নিত। সরকার কিন্তু সে পথে যায়নি, যথাযথ প্রক্রিয়ায় কাজ বন্টিত হয়েছে। পাশাপাশি যে কোম্পানীটি এ ধরনের প্রস্তাব পেশ করতে পারে তাদের সততা ও কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট ‍সুযোগ থেকেই যায়। এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে বিশেষ করে আমেরিকার কোম্পানীটির ব্যাপারে সরকারের পক্ষ হতে তদন্ত সাপেক্ষে সঠিক বিষয়টি বের করে নিয়ে আসা উচিত। যেহেতু পত্রিকায় খবরটি ছেপেছে সেহেতু পত্রিকা কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট দায় নিয়েই বিশেষ করে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেই সংবাদটি পরিবেশন করেছে। সরকারের ‍উচিত হবে, উল্লিখিত কোম্পানীটির ব্যাপারে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করে, প্রস্তাবকৃত চিঠির ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষকে সতর্ক করা ও বিশেষভাবে আশ্বস্ত করা। তদন্ত কাজটি যে কোন প্রক্রিয়াই হতে পারে কিন্তু প্রকৃত বিষয় হচ্ছে সত্যকে উদঘাটন করতে হবে।

আমরা বরাবরই দেখেছি, নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই দেশের মধ্যকার লুকিয়ে থাকা অপরাধীদের আস্ফালন বেড়ে যায়। কতিপয় রাজনৈতিক দল তাদেরকে নানাভাবে সমর্থন প্রদান করে সামগ্রিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার পায়তারা চলে। এর সঙ্গে সঙ্গে বিদেশী কতিপয় রাষ্ট্র ষড়যন্ত্রের পালে ইন্ধন যোগাতে সহায়তা করে। কাজেই সরকারকে দ্বিপাক্ষিক সমস্যাকে প্রতিহত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের মূল কাজ হবে এ ব্যাপারে সাধারণ জনতাকে উদ্বুদ্ধ করে ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করার স্বার্থে রুট লেভেলে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া। রাজনীতিবিদদের নিকটও প্রত্যাশা থাকবে নির্বাচনকে ঘিরে সকল প্রকারের সহিংসতাকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে দল মত নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করে যাওয়া। কোনভাবেই ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র করার সুযোগ দেওয়া যাবে না। বিশেষ করে আমেরিকার বিষয়ে আরও সতর্ক অবস্থায় থাকতে হবে। কোন বিশেষ কারণে আমেরিকা কতিপয় ক্ষেত্রে মতামত প্রদান করছে সে বিষয়গুলোকে খুঁজে বের করার যথার্থ উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।

মো. সাখাওয়াত হোসেন, চেয়ারম্যান, ক্রিমোনলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আ.লীগকে নিষিদ্ধ করলে ভালো হতো: জামায়াত আমির
জামালপুরে মাদ্রাসায় ছাত্রী ভর্তিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ২০
ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে ডিএনসিসির কর বকেয়া ৩০ কোটি টাকা
শহীদ নিজামীর খুনিদের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে ইনশাআল্লাহ: রফিকুল ইসলাম 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা