ঈদের ন্যায় কোরবানিতে কবি নজরুল
কেঁপো না ক্ষুদ্র মন আজ আল্লার নামে জান কুরবানে ঈদের পূত বোধন

ঈদ উৎসবের ন্যায় কোরবানিকেও সঙ্গীত-ছন্দে সুরারোপিত করেছেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
১৯৩৭ সালে অনবদ্য এক রচনা তাঁর,
"ও মোর রমজানের এই রোজাশেষে এলো খুশীর ঈদ"...
তারপর কোরবানি নিয়ে তাঁর রচনা,
"তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ।"
ঈদুল ফিতরের সঙ্গীতটিতে ছিলো, কবির স্ব-কন্ঠেরই সুর। কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীনের অনুরোধেই লিখেছিলেন, অপূর্ব ওই সঙ্গীতটি।
এছাড়াও অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের ‘কুরবানি’ কবিতায় জাতীয় কবি নজরুল বলেছেন,
ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন
এই দিনই মীনা ময়দানে
পুত্র স্নেহের গর্দানে
ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে
রেখেছে আব্বা ইবরাহিম সে আপনা রুদ্র পণ
ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন
আজ আল্লার নামে জান কুরবানে ঈদের পূত বোধন
ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।...
কবি নজরুল যখন ইসলামি সঙ্গীত লেখা শুরু করেন, তখন বাংলার রাজধানী কলকাতায় হিন্দু শিল্পীদের জয়জয়কার। তাই মুসলিম নামধারণ করে তারাই হিন্দুরাই তাঁর গান গাইতেন।
কবির ঈদুল ফিতরের সঙ্গীতটিই ছিল, ইসলামি সঙ্গীত রচনার ক্ষেত্রে 'মাইলফলক'। বিশেষ করে তখনকার ভারতীয় মুসলিম সমাজ, হিন্দু শ্যামাসংগীত রচনায় জন্য যে নজরুলকে "কাফের" বলতো, সেই সমাজই ক্রমে তাঁকে সানন্দে গ্রহণ করলো। বছর ঘুরে মুসলমানদের জন্য ঈদ-কোরবানি এলে নজরুলের এ সঙ্গীত ও রচনা ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হয়ে আকাশে-বাতাসে অনুরণনের সৃষ্টি করে চলতে থাকে, সে কেবল বাংলাদেশে নয়,পশ্চিমবাংলাসহ সারা দুনিয়ার বাংলা-ভাষাভাষী প্রবাসী বাঙালীদের হৃদয়ে। সত্যিই কবি ঈদুল ফিতরের ন্যায় ঈদুল আজহার তাৎপর্যকেও মহিমান্বিত করেছেন, কাব্যিক ছন্দে, সুরের ফল্গুধারায়।
"কোরবানি কি এবং কেনো?"
পবিত্র কোরআনে "কুরবান" শব্দ ব্যবহৃত হলেও ফারসী ও হিন্দি-উর্দুতে শব্দটিকে "কোরবানি" রুপ দেয়া হয়েছে। অর্থ, 'নৈকট্য'। অর্থাৎ চিত্তশুদ্ধির ও পবিত্রতার প্রধান মাধ্যম হলো, কোরবান বা কোরবানি। কোরবানি বা কোরবান শব্দটি ‘কুরবুন’ মূলধাতু থেকে উদ্ভূত। যার বঙ্গানুবাদ সান্নিধ্যলাভ বা নৈকট্য অর্জন করা। অর্থাৎ বান্দা হিসেবে তার প্রিয়বস্তুকে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা।
ঈদুল ফিতর একটি সামাজিক উৎসব, সমষ্টিগতভাবে আনন্দের অধিকারগত উৎসব। অপরদিকে, ঈদুল আজহা উৎসবের একটি অঙ্গ হচ্ছে কোরবানি। কোরবানি হল চিত্তশুদ্ধির এবং পবিত্রতার মাধ্যম। এটি সামাজিক রীতি হলেও আল্লাহর জন্যই এ রীতি প্রবর্তিত হয়েছে।
কাফির- মুশরিকরা তাদের দেব-দেবী ও কবর-বেদীতে পুজো দেয় এবং মূর্তির সম্মানে পশু বলী দেয়। প্রতিবাদস্বরূপ সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হযরত ইব্রাহিম(আঃ)কে তাঁর উদ্দেশ্যে বা সমীপে 'ছালাত' আদায়ে কোরবান বা কোরবানি করার আদেশদান করেন।
কোরআনে বর্ণনা অনুযায়ী হযরত ইব্রাহিম (আ.) হচ্ছেন, মুসলিম জাতির পিতা। ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক তাঁর শিশুপুত্র ইসমাঈল (আ.) -কে আল্লাহর রাহে বা নামে কোরবানি দেন। মক্কানগরীর জনমানবহীন মিনাপ্রান্তরে আল্লাহর আত্মনিবেদিত দুই বান্দা ইব্রাহিম ও ইসমাঈল আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ফলে তা কোরবানি দেয়ার অনুসরণে "সুন্নাতে ইব্রাহিমী" হিসেবে চালু হয়।
আল্লাহ বলেন, ‘আর আমরা তার (ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কোরবান। আমরা এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’ (ছাফফাত ১০৭-১০৮)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় করো এবং কোরবানি করো’ (কাওছার ২)। আল্লাহর প্রেরিত রাসূল মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন,
‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়’। প্রচলিত অর্থে ঈদুল আজহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শারঈ তরীকায় যে পশু যবহ করা হয়, তাকে ‘কোরবানি’ বলা হয়’। সকালে রক্তিম সূর্য উপরে ওঠার সময়ে ‘কোরবানি’ করা হয় বলে এই দিনটিকে ‘ইয়াওমুল আযহা’ বলা হয়ে থাকে। আল্লাহই একমাত্র বিধাতা প্রতিমুহূর্তেই যাঁর করুণালাভের জন্য মানুষ প্রত্যাশী। আমাদের বিত্ত, সংসার এবং সমাজ তাঁর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত এবং কোরবানি হচ্ছে, সেই নিবেদনের একটি প্রতীক। কোরবানি মুসলমানদের জন্য একটি ধর্মীয় ইবাদতও। যিলহজ্জ মাসের দশ থেকে বারো তারিখের মধ্যে এই ইবাদত পালন করতে হয়। কোরবান হচ্ছে, হযরত ইব্রাহিম (আ.) বিবি হাজেরা ও ইসমাঈলের এক পরম ত্যাগ। বর্ষপরম্পরায় এরপর থেকে কোরবানি দিয়ে আসেন পরবর্তী নবীগণও। আল্লাহর জন্যই এই রীতি প্রবর্তিত হবার পর এটি মুসলিম সমাজে সামাজিক রীতি হিসেবে চালু রয়েছে। ঈদুল আজহার দিন সমগ্র মুসলিম জাতি "ইব্রাহিমী সুন্নাত" পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রাণপণ চেষ্টা করে। কোরবানির স্মৃতিবাহী যিলহজ্জ মাসে হজ্জ উপলক্ষে সমগ্র পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মুসলমান সমবেত হয় ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মৃতি বিজড়িত মক্কা-মদীনায়। তাঁরা ইব্রাহিমী আদর্শে আদর্শবান হওয়ার জন্য জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেন। হজ্জ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনন্য উদাহরণ।
সুন্নাতে ইব্রাহিম" হিসেবে রাসুলুল্লাহ (সা.) সয়ং মদীনায় প্রতিবছর আদায় করেছেন। সাহেবিরাও তাঁর পথ অনুসরণ করেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহ সামর্থবানদের মধ্যে এটা চালু হয়। কোরবানির স্মৃতিবাহী যিলহজ্জ মাসে হজ্জ উপলক্ষে সমগ্র পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মুসলমান সমবেত হয় ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মৃতি বিজড়িত মক্কা-মদিনায়। তারা ইব্রাহিমী আদর্শে আদর্শবান হওয়ার জন্য জীবনের সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেন। হজ্জ মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক অনন্য উদাহরণ।
আল্লাহ বলেন, আর কোরবানির পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে’ (হজ্জ ৩৬)।
মানুষ আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে, এই শিক্ষাই ইব্রাহিম (আ.) আমাদের জন্য রেখে গেছেন। মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) আমাদের জন্য ঐ ত্যাগের আনুষ্ঠানিক অনুসরণকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে গেছেন। আর ঈদুল আজহার মূল আহ্বান হল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ করা। সকল দিক হতে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহর দিকে রুজু হওয়া। সম্পদের মোহ, ভোগ-বিলাসের আকর্ষণ, সন্তানের স্নেহ, স্ত্রীর মুহাববত সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রতি আত্মসমর্পণ করে দেওয়াই হল ঈদুল আজহার মূল শিক্ষা।
ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর হুকুমে পুত্র কোরবানি করেছিলেন। মূলতঃ তিনি এর দ্বারা পুত্রের মুহাব্বতকে কোরবানি করেছিলেন। আল্লাহর ভালোবাসার চাইতে যে পুত্রের ভালোবাসা বড় নয়, এটিই প্রমাণিত হয়েছে তার আচরণে। আল্লাহ এটাই চেয়েছিলেন। আর এটাই হল প্রকৃত তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি। ইব্রাহিম (আ.) তার প্রিয়পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করে এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যাতে অনাগত ভবিষ্যতের অগণিত মানুষ আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণের বাস্তব শিক্ষা লাভ করতে পারে।
আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকালের ভয় কর তাদের জন্যে ইব্রাহিম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (মুমতাহিনা ৪-৬)। কোরবানি কেবল পশু কোরবানি নয়। নিজের পশুত্ব, নিজের ক্ষুদ্রতা, নীচতা, স্বার্থপরতা, হীনতা, দীনতা, আমিত্ব ও অহংকার ত্যাগের কোরবানি। নিজের ছালাত, কোরবানি, জীবন-মরণ ও বিষয়-আশয় সব কিছুই কেবল আল্লাহর নামে, শুধু তারই সন্তুষ্টির জন্য চূড়ান্তভাবে নিয়োগ ও ত্যাগের মানস এবং বাস্তবে সেসব আমল করাই হচ্ছে প্রকৃত কোরবানি।
একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক, তাঁর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনই প্রকৃত মুমিনের কাজ এবং তাতেই নিহিত রয়েছে অশেষ কল্যাণ ও প্রকৃত সফলতা।
নানা ইতিহাসগ্রন্থ ও ঐতিহাসিক সূত্র থেকে বাংলাদেশের রোজা পালন ও ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহা পালনের তথ্য পাওয়া যায় যে, ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশে মুসলিম অধিকারে এলে এদেশে নামাজ, রোজা ও ঈদ অনুষ্ঠানের প্রচলন হয়েছে তার বেশ কিছু আগে থেকে। কারণ বঙ্গদেশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুসলিম অধিকারে আসার বহু আগ থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ, সাধকরা ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারত হয়ে পূর্ব বাংলায় আস্তানা গড়েন। অন্যদিকে আরবীয় ও অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে বণিকরা চট্টগ্রামের বন্দর হয়ে বাংলার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি করেন এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য প্রচার করেন। সেই থেকে পূর্ব বাংলার ওপর একটি মুসলিম সংস্কৃতি তথা ধর্মীয় প্রভাব পড়ে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর বাঙালির ‘ঈদ’ উৎসবের সূচনাও ঠিক এভাবেই হয়েছে বলে ধারণা করা হয় এবং সময়ের পরিক্রমায় অনেক মুসলিম অনুষ্ঠানের মধ্য থেকে ‘ঈদ’ পরিণত হয় এক বৃহত্তর ধর্মীয় উৎসবে। ঈদুল আযহা বা কোরবানি ঈদে বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা সাধারণত উট, দুম্বা, ভেড়া, বকরি বা ছাগল, মহিষ, গরু ইত্যাদি কোরবানি দিয়ে থাকনে। তবে আদিকালে আমাদের দেশে কোরবানির জন্য ছাগল বেশি জনপ্রিয় ছিল, কেননা তখন গরু কোরবানি করা খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিলনা। এর কারণ হিসেবে একটি তথ্যে দেখা যায়, ১০০-১৫০ বছর আগে বাংলাদশেে গরু কোরবানি দেয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কোরবানি যদি কেউ দিতে চাইত তাহলে খাসি বা ছাগলই দিত। তৎকালীন বিখ্যাত সাহিত্যিক-রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদ তার আত্মজীবনীতে সে সময় ঈদুল আযহা সর্ম্পকে র্বণনা দিয়েছেনে, ‘বকরা ঈদে কেউ গরু কোরবানি করিত না। সে আমলে পরাক্রমশালী জমিদারদের তরফ থেকে গরু কোরবানি কড়াকড়ভিাবে সর্বত্রই নিষিদ্ধ ছিল। শুধু বকরি কোরবানি করা চলত। মোগল যুগে বাংলাদেশে ঈদুল আযহা কিভাবে উদযাপন করা হতো তা জানা যায়নি। এমনকি উনিশ শতকের শুরুতে ঈদুল আযহার তেমন কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি। আরকেটি গুরুত্বর্পূণ সত্য হলো, ১০০-১৫০ বছর আগে ঈদ মুসলমানদরে প্রধান উৎসব হসিবেে তমেনভাবে উদযাপতি না হওয়ার মূল কারণ ছলি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়া। এছাড়াও বত্তিহীদরে দরদ্র্যিতার কারণে মানুষরে স্বতঃর্স্ফূত আশা-আকাঙ্ক্ষার স্ফুরণ না ঘটা। এছাড়াও সকোলে বশিুদ্ধ ইসলাম সর্ম্পকে অজ্ঞ ছলি সাধারণ মানুষ। যদওি এ অবস্থার পরর্বিতন এনেছিল ফরায়েজী আন্দোলন (১৮১৫ খ্রি.)। উনশি শতকরে গোড়ায় যখন রাজনতৈকিভাবে মুসলিম স্বাতন্ত্রবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল তখন থকেইে গুরুত্ব পেয়েছে ঈদ। তবে খানকিটা জাঁকজমকরে সঙ্গে দুটি ঈদ উদযাপনের মধ্যে আছে বিত্তের সর্ম্পক। স্বাভাবকিভাবেই শহর, মফস্বলে ও গ্রামাঞ্চলে যারা ধনী, বিত্তবান তাদের ঈদ আর সাধারণ মানুষের ঈদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। ইসলাম প্রচারের শুরুতে র্অথাৎ আদিতে বাঙালি মুসলমানরা কিভাবে ঈদ উদযাপন করতেন তা জানা আজ অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তবে এ কথা নিঃসংশয়ে বলা যায়, অতীতে মুসলমানদরে ঈদুল ফিতর যেমন বাংলাদেশে বড় কোনো র্ধমীয় উৎসব হিসবে উদযাপতি হয়নি, তেমনি উদযাপতি হয়নি ঈদুল আযহাও। আজকে আমরা স্বতঃর্স্ফূতভাবে আনন্দ ও ধুমধামের সঙ্গে ঈদুল আযহা উদযাপন করি তা মাত্র ৬০-৭০ বছররে ঐতহ্যি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মুসলমানদের ন্যায় বাংলাদেশের মুসলমানেরাও যথাযথ ধর্মীয় ভাবাম্ভীর্য বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় ঈদুল আযহা পালন করে থাকেন। এ ঈদে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি দেওয়া নিয়েও থাকে এক ধরনের বিশেষ ব্যস্ততা। এছাড়াও এ সময় ছোট থেকে বড় সবাই নতুন পোশাক পরে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশিদের বাড়িতে সাক্ষাৎ করতে যায় এবং কুশল বিনিময় করে। ঈদের সময় প্রত্যেক বাড়িতেই সাধারণ খাবারের পাশাপাশি উন্নতমানের খাবার প্রস্তুত হয়। শুধু মুসলমান ই নয় অন্য ধর্মাবলম্বীরা বন্ধু-বান্ধবদেরও নিমন্ত্রিত হয়ে এ উৎসবে যোগ দিতে দেখা যায়। দেশের সকল স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সহ সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ঈদ উপলক্ষে কয়েকদিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়। প্রবাসীদের অধিকাংশই নিজ নিজ গ্রামের বাড়ি গিয়ে আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঈদ উদযাপন করে। বিভিন্ন মসজিদ-ময়দানে ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় রেডিও-টেলিভিশনগুলো সপ্তাহব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে এবং পত্র-পত্রিকাসমূহ ঈদুল আযহার তাৎপর্য তুলে ধরে মূল্যবান বিশেষ নিবন্ধাদি প্রকাশ করে। ঈদুল আযহার লক্ষ্য হচ্ছে সকলের সাথে সদ্ভাব, আন্তরিকতা এবং বিনয়-নম্র আচরণ করা। মুসলমানদের জীবনে এই সুযোগ সৃষ্টি হয় বছরে মাত্র দু’বার। ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা একই কাতারে দাঁড়িয়ে পায়ে পা এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুই রাকাত নামায আদায়ের মাধ্যমে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে যায়। পরস্পরে কুশল বিনিময় করে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়, জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং আন্তরিক মহানুভবতায় পরিপূর্ণ করে। মূলত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে দৈন্য, হতাশা তা দূরীকরণের জন্য ঈদুল আযহার সৃষ্টি হয়েছে। যারা অসুখী এবং দরিদ্র তাদের জীবনে সুখের প্রলেপ দেওয়া এবং দারিদ্রের কষাঘাত দূর করা প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলমানদেরই কর্তব্য। সকলেরই সেসব কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়, ‘তোরা ভোগের পাত্র ফেলরে ছুঁড়ে, ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ’। ঈদের পবিত্রতম মহিমায় ও ত্যাগের শিক্ষায় পরিশুদ্ধ হোক প্রতিটি প্রাণ।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক

মন্তব্য করুন