আওয়ামী লীগের হাত ধরেই এসেছে বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল সব অর্জন

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ) প্রতিষ্ঠা হয়। এবার ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান এবং ভ্রান্ত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা। অতঃপর বাঙালি জাতির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, নির্যাতন, চরম অবেহলা ও দুঃশাসনে নিষ্পেষিত বাংলার জনগণের মুক্তি ও অধিকার আদায়ে প্রতিষ্ঠা হয় আওয়ামী লীগ। সংগঠনটির প্রথম কমিটিতে মওলানা ভাসানী সভাপতি ও শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং জেলে থাকা অবস্থায় যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস একসূত্রে গাঁথা। আওয়ামী লীগের উদ্যোগেই মাতৃভাষা বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার আনুষ্ঠানিক মর্যাদা লাভ করে। আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন-বিরোধী আন্দোলন, ’৬২ ও ’৬৪-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ, ’৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলন, ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ৬-দফাভিত্তিক ’৭০-এর নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
আওয়ামী লীগের ইতিহাস, বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ও সংগ্রামের ইতিহাস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ বাঙালি জাতির যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন, বাংলাদেশের উন্নয়নের পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের অবদান। জাতির পিতার স্বপ্ন, আদর্শ পূঁজি করেই তার উত্তরসূরির নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লড়াই। শতভাগ বিদ্যুৎ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্পায়ন, গৃহায়ন, নগরায়ণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ প্রশমনে বদলে গেছে বাংলাদেশের চেহারা। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমূখী শিল্পায়ন, পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বাড়াসহ অর্থনৈতিক সূচকে অগ্রগতি, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রো রেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পে অগ্রগতিতে বদলে গেছে বাংলাদেশের চেহারা।
আমি নিজে একজন ব্যবসায়ী হিসেবে মনে করি, আওয়ামী লীগ ব্যবসা ও উন্নয়নবান্ধব সরকার। ব্যবসা-বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয়, উৎপাদন, প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। দেশের শহর থেকে গ্রামগঞ্জ সবখানে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অথর্নীতি আজ চাঙ্গা হয়েছে। তলাবিহীন ঝুঁড়ি হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত বাংলাদেশ আজ মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে আজ মডেল ইকোনমিক কান্ট্রি।
শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে দ্রুত এগিয়ে নিতে কৃষি, শিল্প উৎপাদনের পাশাপাশি অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ওপরও তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরে বিশেষ করে ব্যবসা বাণিজ্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলকে বিবেচনায় নিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে এবং হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং শিল্পায়নের প্রসারেও সারা দেশে একশ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে।
আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। রাজধানীতে যানজট দূর করতে নির্মাণাধীন মেট্রো রেল প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল এই মেট্রো রেল এখন দৃশ্যমান। রাজধানীর উপকণ্ঠ হেমায়েতপুর থেকে গুলশান হয়ে ভাটারা এবং বিমান বন্দর থেকে রামপুরা হয়ে কমলাপুর পযন্ত আরও দুইটি মেট্রোরেল প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে ও স্থানে নির্মাণ হয়েছে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার। নির্মাণ হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। এই বন্দরের ওপর চাপ কমাতে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ায় রাবনাবাদ চ্যানেলে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হচ্ছে। আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে ১৬ মিটার গভীরতায় চ্যানেল ড্রেজিং সম্পন্ন করে বন্দর গড়ে তোলা হবে। সমুদ্র পথে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও এগিয়ে নিতে শেখ হাসিনার সরকারের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে। এই সমুদ্রবন্দরটি নির্মাণের জন্য কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা শেষ করেছে জাপানের প্যাসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল (পিসিআই)। গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জিটুজি) পদ্ধতিতে এ বন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান দিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে দিন বদলের সনদ, ভিশন-২০২১ ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। এর পর ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করে তারা। টানা তিন মেয়াদের এ্ই সরকারের প্রথম মেয়াদেই দৃশ্যমান হয় ডিজিটাল বাংলাদেশ।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ শাসন করে শেখ হাসিনা প্রমান করেছেন শাসক হিসেবে তিনি যেমন দেশনন্দিত, তেমনি গণতন্ত্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনেতার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। তাঁর শাসনামলে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে হতদরিদ্র মানুষের মাঝে খাদ্য ও অর্থ বরাদ্দ এবং অন্যান্য সহযোগিতা মানুষকে অসহায়ত্ব থেকে রক্ষা করেছিল। দেশকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলে তিনি দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্রের কষাঘাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে ভাগ্যোন্নয়নের পথে দাঁড় করিয়েছেন। কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষকদের ঋণ প্রদান, কৃষি সামগ্রীর মূল্যহ্রাস এবং সহজ প্রাপ্যতাও ছিল বিরাট অবদান।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপিতে বিশ্বে ৪১তম। গত এক দশকে দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এ সময়ে মাথাপিছু আয় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সর্বকালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে।
গত এক দশকে আর্থ-সামাজিক খাতে ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ২৩ দশমিক ৬৭-এ কমে এসেছে। প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃ মৃত্যুর হার ১৭৩-এ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে উন্নয়ন, অগ্রগতি আর সমৃদ্ধির পথে হাঁটছেন। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিগত ১৩ বছরে সর্বক্ষেত্রে যে সফলতা অর্জিত হয়েছে তার পথ ধরে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছানোর অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।
টেকসই অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনার সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সরকারের উন্নয়ন ভাবনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়নের ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অথচ একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দেশের এই অগ্রযাত্রা থমকে দাঁড়ায়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। আবার দুর্নীতির চক্রে নিপতিত হয় দেশ। হাওয়া ভবনের নামে তারেক জিয়া চালাতে থাকে লুটপাট। দুর্নীতিতে বাংলাদেশ শীর্ষে অবস্থান করে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকের প্রায় সবগুলোতে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে আমাদের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। বিগত ১৪ বছরে সহস্রাদ্ধ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজিএস) অর্জনে আমাদের ঈর্ষণীয় সাফল্য দক্ষিণ এশিয়াসহ উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
লেখক: পরিচালক, বিজিএমইএ; শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ

মন্তব্য করুন