অবহেলিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: আমরা কবে মানুষ হবো জানি না!

অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ
| আপডেট : ০৩ জুলাই ২০২৩, ১১:৫৩ | প্রকাশিত : ০৩ জুলাই ২০২৩, ১০:১৩

প্রতিদিন কান্নার রোল কার শুনতে ভালো লাগে! আমরা অসহায়! সকালে নাশতা- পানি না খেয়ে অফিসে যেতে হয়। এবং না খেয়ে ফিরতে হয় কারণ পথে যাতে কোনো সমস্যা না হয়। সাভার থেকে ঢাকা ৩০ কিলোমিটার। গাবতলী পর্যন্ত সমস্যা নেই। গাবতলী থেকে নিউ মার্কেট সময় লাগে ৩ ঘন্টা। আমাদের উন্নয়নের সুখী মানুষেরা দামি দামি গাড়ি নিয়ে পথে নামেন। আমাদের পরিবহন শ্রমিকরা আমাদেরকে বুড়োআঙ্গুল দেখান , আমাদের ছাত্ররা কথায় কথায় রাস্তা বন্ধ করে দেন। এভাবে আর কতকাল চলবে জানিনা ! মানুষ নিরুপায়। মানুষ এমন এক জীবন যাপন করে তা বর্ণনাতীত!

আমাদের হাসপাতালে চলছে এক লুটপাটের রাজত্ব। রোগী পেলে ফাঁদ পাতেন একটি মহল। সেই ফাঁদে পড়ে হয় দেউলিয়া অথবা জীবনটাকে শেষ করে চলে যান পরপারে। “Water, water, everywhere,/ And all the boards did shrink;/ Water, water, everywhere,/ Nor any drop to drink, ”Samuel Taylor Coleridge এর 'The Rime of the Ancient Mariner' কবিতাটি আমাদের শিক্ষা ও চিকিৎসার বেলায় প্রযোজ্য। গ্রাম থেকে শহর স্কুল , মাদ্রাসা , কলেজ , বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরপুর। আবার শহর থেকে গ্রাম - ডাক্তার আর ক্লিনিক কিন্তু কোথাও আস্থা নেই কারও মনে। মানুষ একজন ডাক্তার থেকে একজন ঔষুধ বিক্রেতাকে বিশ্বাস করে। সে কোনো ফি না নিয়ে রোগের বিবরণ শুনে চিকিৎসা দিয়ে দেন। মানুষ সেটা বিশ্বাস করে বেঁচে আছে।

এখন আনাচে কানাচে মেডিকেল কলেজ। অনুমোদন না নিয়ে মেডিকেল কলেজ খুলেছেন কেউ কেউ রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে। পাস্ করে বিপদে আছেন সেই সব মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সাত কলেজ নিয়ে এক শিক্ষার্থীর অভিমত -" সর্বাঙ্গে ব্যাথা। " সেদিন নীলক্ষেতে গিয়ে ছিলাম একটি বই খুঁজতে। অবাক হলাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বইয়ের সিরিজ দেখে। সেই বই শুধু জাতীয় নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়েন। কয়েকদিন আগে একটি টিউটোরিয়াল পরীক্ষার খাতা দেখছিলাম। জনাপাঁচেক বাদে সকলেই একই ভুল করেছেন। অনুসন্ধান করে ভারতীয় এক লেখকের বইতে সেই ভুলটি পেলাম। এভাবেই চলছে আমারদের শিক্ষা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন অনলাইনে এমফিল পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভ প্রকাশ করে। কৌতূহল বশতঃ কয়েকটা অভিসন্ধর্ভ পড়লাম। এক সময় আমরা বিদেশ থেকে ডিগ্রী করা শিক্ষকদেরকে খুবই মর্যাদা দিতাম। কিন্তু তাদের হাত দিয়ে পাশ করা থিসিস দেখে আমি নির্বাক থাকতে পারিনি। কিভাবে তারা এরকম কাজ করতে পারছেন জানতে চাই। তিনি বিদেশ থেকে যে ডিগ্ৰী টি পেয়েছেন তা অনেক কষ্ট করে অর্জন করেছেন। অথচ এতো সস্তায় তিনি একটি ডিগ্রী দিয়ে দিচ্ছেন কি ভাবে ?

আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেমন শিক্ষা নেই তেমনি শিক্ষার জন্য কারও আগ্রহ নেই। বিসিএস কিভাবে পাশ করা যাবে সেটাই মুখ্য। আমাদের সহকর্মীরা বলেন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন তারা নাকি বিসিএস পাশ করবে না। এমন একটি তুলনা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক করেন তখন আমলাদের পাল্লা ভারী হবে এটাই সত্য।

আমরা এখন আমলাদের বেড়াজালে। তারা দয়াকরে যাকে খুশি যা চান দিতে পারেন। একজন ভালো প্রার্থীকে হারিয়ে দিতে পারেন আবার একজন অয্যোগ প্রার্থীকে নির্বাচিত হতে সকল প্রকার সহযোগিতা দিতে পারেন। তাদের স্বাক্ষরেই বিদেশে যাচ্ছে ডলার। দোষটা যাচ্ছে রাজনীতিবিদের কাঁধে।

আজকে নির্বাচন নিয়ে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে সেটাও ওই আমলাদের সৃষ্টি করা। সিন্ডিকেট ওই আমলাদের সৃষ্টি করা। তারা সবচে ক্ষমতাধর। আমলার আর সরকারি কর্মকর্তা কিন্তু এক নয়।

আমাদের উন্নয়নের মডেলে ছিল কর্মসংস্থান , অবকাঠামো নির্মাণ , বিদ্যুৎ প্রভৃতি। আমরা পদ্মা সেতু , বঙ্গবন্ধু টানেল পেয়েছি। ঈদের সময় আর লঞ্চডুবি নেই। আমাদের মেট্রোরেল আছে , আমাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। আমাদের পাকা ঘর আছে। কিন্তু জীবনটা ষোল আনা মিছে যদি না জানো সাঁতার। আমাদের শিক্ষার অভাব আছে। সেখানে নেই শৃংখলা। সেখানে নেই মান। বিদেশিরা আমাদের সেই জায়গায় পরনির্ভর করে রেখেছে। আমরা শ্রমিকের জাতিতে পরিনিত হয়েছি। আমাদের আদালতের উকিল সাহেবরা কেমন উকিল যদি জানতে চান তবে সেই পুরনো উত্তর : বট তলার উকিল। আমাদের উপাচার্যরা কেমন ? সেই কলের গান বাদক। এনালগ মানুষ দিয়ে ডিজিটাল যেমন সম্ভব নয় তেমনি কেবল স্মার্ট বাংলাদেশ শ্লোগান দিয়ে স্মার্ট বানানো যাবে না। স্মার্ট বাংলাদেশ বানাতে সকল প্রকার শিক্ষা প্ৰতিষ্ঠানের প্রধানকে হতে হবে প্রকৃত শিক্ষিত। মাথা যদি ভালো হয় তবে তো কিছু ভালো হবে।

সৃষ্টিকর্তার এক অন্যতম দান বাংলাদেশ। নদী নালায় পানি , মুষলধারে বৃষ্টি , মাটিতে বীজ ফেললেই ফসল। সেই সুন্দর দেশটাকে উন্নয়নের নামে আমরা বুড়িগঙ্গাকে বানিয়েছি পচা গলার প্রবাহের ড্রেইন, আর কংক্রিটের জঙ্গল। এখানে এখন সকলকে হাইব্রিড মিনিকেট বা বোরো চাল খেতে হয় , মাছে ভাতে বাঙালি এখন ব্রয়লার আর সোনালী মুরগির গোশত খেয়ে বেঁচে আছেন। চাষের পাঙ্গাশ , রুই , তেলাপিয়া আমাদের খেয়ে বাঁচতে হয়। গ্রামে গঞ্জে বোতলজাত ড্রিংকস, প্যাকেটের চিপস নিত্যদিনের খাবার। আমরা বদলে গেছি। আমরা মানবিক না হয়ে হিংস্র হয়েছি গণতান্ত্রিক না হয়ে ক্ষমতার দাপট দেখাই। আমাদের বিমানবন্দর ঈদের আগে পরে প্রচন্ড ভিড় থাকে। দুবাই -ব্যাংককক সিঙ্গাপুর আমাদের ঈদ আনন্দের জায়গা। আমাদের দেশে বিদেশিরা বিনিয়োগ করে আর আমাদের দেশের টাকা দিয়ে বিদেশে ধনকুব তালিকায় স্থান পাই !

আমাদের যেটা নেই সেটা হলো শরম বা লজ্জা। তাই যেখানে সেখানে যা খুশি তাই করে ফেলি ! আমাদের শরম নেই তাই তোষামোদ করি। আমাদের লজ্জা নেই তাই রাজাকার -আলবদর দের সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করি। আমরা অবলীলায় মিথ্যাচার করি। আমরা এখনও জানিনা আগামী নির্বাচন সঠিকভাবে হবে কি না ! কারণ আমাদের প্ৰভু ঠিক করবে কিভাবে নির্বাচন হবে আশায় বসে থাকি। হারিয়ে গেছে আমাদের গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ , স্বাধীনতার স্বপ্ন। আমরা ১২ লক্ষ রোহিঙ্গাকে স্থান দিতে পারি কিন্তু আমরা বলতে পারিনা - আমরা অর্থ পাচার করছি না, আমরা ব্যাংক সাবাড় করছিনা। এসব অপ্রচার -অসত্য। কেন পারি না ? কেন আমাদের দেশপ্রেমে ঘাটতি ? উত্তর জানা আছে এমন কোনো বুদ্ধিজীবী আছেন কি ?

আমার এক বন্ধুর অফিসে গিয়েছিলাম চা খেতে। সে প্রায় ৩০ বছর আগে। সেখানে একজন বিদেশী পরামর্শকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন আমাদের দার্শনিক নেই। হয়তো তাই। আর সেজন্য আমাদের উন্নয়ন টেকসই হয় না। আজ বঙ্গবন্ধু নেই। তাই পরিবর্তনের ডাক দেয়ার মতো কেউই নেই। দামি দোকানের খাবারে পচন ধরলেও সেই সততা নেই যে পঁচামাল বেচা থেকে বিরত থাকবে। আমাদের শিক্ষকরা বলতেন ওই ভারতীয় বইগুলো পড়োনা। কারণ সেখানে ভুল আছে। আজ সেসব বলবার মতো শিক্ষক নেই। বরং আমরা চিকিৎসার জন্য ধনী -দরিদ্র সকলেই ভারতে ছুটি। কি ভয়ানক মানসিকতা , কি ভয়ানক দৈনতা আমাদের। আমরা কবে মানুষ হবো জানি না !

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :