​ব্যবসায়ী সম্মেলন ঘিরে প্রতিহিংসার রাজনীতি

মো. সাখাওয়াত হোসেন
 | প্রকাশিত : ২৫ জুলাই ২০২৩, ১১:৫৫

গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্য হচ্ছে অন্যের মতামতকে সম্মান জানাতে হবে, প্রতিনিধিত্বকারীদের মর্যাদা প্রদান করতে হবে। এ দেশীয় সংস্কৃতিতে দেখা যায়, যারা সামনে থেকে প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন জানায় কিংবা কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে তাদের প্রতি বিরুদ্ধ মতবাদে বিশ্বাসীরা ক্ষমতায় এলে নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে। রাজনীতির মাঠে এমনটা কখনোই ঠিক নয়, তবে এ কাজটিই কিন্তু হয়ে থাকে। যারা প্রকৃত রাজনীতিবিদ তারা কিন্তু এ ধরনের প্রকাশ্যে সমর্থনকে সাধুবাদ জানায়, প্রকাশ্যে সমর্থনকারীদের ব্যাপারে তাদের সুবিদিত ফ্রেমওয়ার্ক থাকে। অর্থাৎ প্রকাশ্য সমর্থনকারীদের কারণেই বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী রাজনীতিবিদদের কাজের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ সহজতর হয়ে থাকে। কিন্তু বিপরীত ক্ষেত্রে যাদের রাজনীতির মাঠে অভিজ্ঞতা তুলনামূলক বিচারে কম, রাজনীতিতে ত্যাগ ও শ্রম নেই তারা কিন্তু প্রকাশ্য সমর্থনকারীদের ব্যাপারে হঠকারী হয়ে উঠেন।

কিছুদিন পূর্বে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো এবং সেখানে দেশের সবকটি ব্যবসায়ী সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীকে পুনরায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় দেখতে চাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ব্যবসায়ীদের এ মন্তব্য শুনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ব্যবসায়ীদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বক্তৃতা দিয়ে ব্যবসায়ীদের হুমকি দেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারকে অবৈধ ব্যবসায়ীদের সরকার বলে অবান্তর দাবি করেন। অথচ সম্মেলনে বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন এবং শীর্ষ নেতৃবৃন্দও বক্তৃতাতে সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করেন।

ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চান দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতেই আগামীতেও শেখ হাসিনার সরকার দরকার। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্যবসায়ীদের করণীয়’ শীর্ষক সম্মেলনে শনিবার দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা ও শিল্পোদ্যোক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, আগামী মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে চান তারা। কেউ কেউ পরোক্ষভাবে তা বলেছেন। কয়েকজন স্লোগানে স্লোগানে একই দাবি জানান। সম্মেলনে কয়েকজন ব্যবসায়ী ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যার কথাও তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, শেখ হাসিনাকে আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ব্যবসাবান্ধব সরকার। প্রধানমন্ত্রী তাঁর আমলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের তথ্য ও পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।

মির্জা ফখরুল যদি একজন বুদ্ধিদীপ্ত ও উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হতেন, তাহলে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে ভিন্ন বার্তা দিতে পারতেন। যে বার্তায় তারা ক্ষমতায় এলে ব্যবসায়ীদের জন্য যে ধরনের সুবিধা রাখবেন, ব্যবসার সম্প্রসারণে যে বিশেষ বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন প্রভূত বিষয় সম্বন্ধে বিস্তারিত তুলে ধরতেন। কিন্তু তা না করে তিনি ‍উল্টো ব্যবসায়ীদের হুমকি দিয়ে রাখলেন। অর্থাৎ তারা যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে ব্যবসায়ীদের জন্য করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে। অবশ্য মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের পরবর্তী পর্যায়ে ব্যবসায়ী নেতাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ব্যবসায়ীরা কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির একটি বড় অংশ। ব্যবসায়ীদের দমিয়ে রেখে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি আনয়ন করা সম্ভব হবে না। তবে যারা পণ্য মজুদ করে, পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করে তাদের বিষয়ে ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সংকট সৃষ্টিকারীদের যদি মির্জা ফখরুল ভর্ৎসনা করতেন, হুমকি প্রদান করতেন তাহলে সাধারণ জনতাও তাকে ধন্যবাদ জানাতো। ব্যবসায়ে যারা সিন্ডিকেট তৈরি করে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে জনসাধারণকে ভোগান্তিতে ফেলে তাদের ব্যাপারেও কঠোর পদক্ষেপ গৃহীতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে জনসাধারণ সাধুবাদ জানাতো। কিন্তু তিনি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে হুমকি দিলেন, প্রকারান্তরে যারা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন তাদেরকে দেখে নেওয়ার বিষয়ে হুমকি দিয়ে রাখলেন। বিষয়গুলো অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং অবমাননাকর। কেননা যে সব ব্যবসায়ী সম্মেলনের আয়োজন করেছে সরকার পরিবর্তন হলেও তারাই কিন্তু ব্যবসায়ী সমাজকে নেতৃত্ব দিবে, ব্যবসায় নেতৃত্ব দিবে। তাদেরকে বাদ দিয়ে সরকার অর্থনৈতিক খাতকে কখনোই সমৃদ্ধ করতে পারবে না।

যারা হুমকি দিয়েছে ব্যবসায়ীদের, তারা যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে তাহলে স্পষ্টত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তাদের একটি দূরত্বের সৃষ্টি হবে। দূরত্বের কারণে অর্থনৈতিক সেক্টরে পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে যাবে এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় তীব্র সংকট তৈরি হবে। এ ধরনের বিস্ফোরক মন্তব্য রাজনীতিতে আপনাকে অনেক পেছনে ঠেলে দিবে। কারণ জনতা ব্যাপক সচেতন এবং ব্যালট বাক্সে সিল প্রদানের পূর্বে বিভিন্ন হিসাব নিকাশ করেই তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সে জায়গায় একটি দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে ব্যবসায়ী সমাজ সম্বন্ধে এ ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য দলটিকে জনগণের মাঝে প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দেয় যার প্রভাব পড়ে ভোটের মাঠে। এ ধরনের মন্তব্য যত বেশি আসবে ক্ষমতাসীন দলের ভোটের হিসাবে উতরে যাওয়ার সম্ভাবনা ততই প্রবল হবে।

সে জন্যই রাজনীতিতে অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই, অভিজ্ঞতা তখনই অর্জিত হবে যখন দীর্ঘ সময় আপনি রাজনীতিতে সময় দিবেন, জনগণের সঙ্গে একই কাতারে মিশে যেতে পারবেন। তখনই আপনি নেতা হয়ে উঠবেন, যখন জনগণ আপনাকে বিশ্বাস করবে, ভরসা করবে এবং দলের নেতাকর্মীরা আপনার ওপর দায়িত্ব অর্পণ করবে। কিন্তু কোনো কাউন্সিল ব্যতীত দলীয় প্যাডে স্ক্যান সিগনেচারের মাধ্যমে আপনাকে যখন দলের পদে অধিষ্ঠিত করা হয় তখন কিন্তু আপনি পরিপূর্ণ নেতা হয়ে ‍উঠতে পারেননি। এই নমুনায় চলছে বাংলাদেশের কতিপয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে এবং মূলত তারাই বেফাঁস কথাবার্তা বলে রাজনীতির পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তোলে।

কাজেই রাজনীতিতে দূরদর্শী না হলে, রাজনৈতিকভাবে সচেতন না হলে রাজনীতির মাঠে অবস্থান গ্রহণ দুরূহ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের নিয়ে মির্জা ফখরুলের সাম্প্রতিক বক্তব্য প্রকারান্তরে তার দলকে বিভ্রান্ত করেছে। অবশ্য ব্যবসায়ীদের নিয়ে তার দলের দৃষ্টিভঙ্গি এমন হলে সেটি ভিন্ন কথা। তবে রাজনীতিতে সহনশীল আচরণ করতে হয়, সজ্জন থাকতে হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সজ্জনকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের রাজনীতিতে সবসময়ই পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। প্রতিহিংসার রাজনীতি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, রাজনৈতিক সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক অপরাধের আবির্ভাব ঘটে। সে কারণেই আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে আসন্ন নির্বাচনকে উৎসবমুখর করে তুলবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :