বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা দর্শন

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
  প্রকাশিত : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৪৪| আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১৩:৩৫
অ- অ+

" আমার সবচেয়ে বড় শক্তি- আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি, সবচেয়ে বড় দূর্বলতা- আমি তাদেরকে খুব বেশী ভালোবাসি "- বঙ্গবন্ধু।

ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন দর্শনের গভীর ভাববিশ্লষণ করলে একটা বিমূর্ত অনুভূতি ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হতে থাকে। তিনি যেন দৈবনির্দিষ্ট হয়ে সাধারন মানুষকে ভালোবাসতেই জন্মেছিলেন। শৈশব থেকে সর্বস্ব উজাড় করে শোষিত, বঞ্চিত মানুষদের নিখুঁত ভাবে ভালোবেসে গিয়েছেন আমৃত্যু। নিগৃহীতের অধিকারের দাবীতে তিনি যেমন সর্বত্র বজ্রকন্ঠী, অার্তের আকুতির সামনে তেমনি তার সিংহহৃদয় মুহূর্তে করুনায় বিগলিত। মহাকালের সাক্ষী হয়ে যেন পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দায়ভার নিয়ে বাংলার মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই ঈশ্বরনির্দিষ্ট ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। শৈর্যে,বীর্যে,শরীরী ভাষায়,কন্ঠে এই তেজোদীপ্ত মহানায়ক সর্বাত্মক ভাবেই ছিলেন একজন পরিপূর্ণ স্বপ্নদ্রষ্টা। চিন্তা, চেতনা ও মননে কালের উর্দ্ধে গিয়ে বারবার ভবিষ্যতকে তিনি নখদর্পনে প্রত্যক্ষ করেছেন কোনও এক আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে। তার জীবনী ও যুগান্তকারী কর্মকান্ডের সার্বিক তাৎপর্য বিশ্লেষণে এই ভাবনাটাই বারবার সাধারন মানুষের চিন্তায় প্রকট হয়ে ওঠে।

বঙ্গবন্ধুর প্রবর্তিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি

২৮'শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭১ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের সন্মানে আয়োজিত সংবর্ধনা সভার বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন -

" আমরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। তবে তা বিপ্লবের মাধ্যমে নয়,গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিবর্তনের মাধ্যমেই অর্জিত হবে।... জয় বাংলা আন্দোলন কেবলমাত্র রাজনৈতিক শ্লোগান নয়। এটা বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের প্রতীক। এই আন্দোলন চলবেই। সেই সঙ্গে হবে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমের আন্দোলন। "

জাতির পিতার সমাজতান্ত্রিক আদর্শের মূল উপজীব্য বিষয়গুলো ছিল প্রতিটি সাধারন মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, অসাম্প্রদায়িক পরিমন্ডলে সুষ্ঠ সামাজিক বিন্যাস, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ভাবধারায় বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদের মূল কাঠামোকে প্রজন্মগত ভাবে প্রবাহমান রাখা এবং একটি গণবান্ধব প্রশাসনিক অবকাঠামো। বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গী ও সমাজদর্শন এতটাই স্বতন্ত্র ছিল যে, তিনি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারটি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে নবগঠিত বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করেন। তিনি জানতেন, সমাজব্যবস্থাই একটি রাষ্ট্রের মূল অবকাঠামোকে ধরে রাখে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে যখন এক কোটি বিদেশ ফেরৎ উদ্বাস্তু, স্বদেশের বুকে দু 'কোটি গৃহহীন মানুষ, নিশ্চল কারখানা, নির্বাপিত বিদ্যুৎ, অসংখ্য বেকার, অপরিমিত অরাজকতা, বিশৃঙ্খল বাণিজ্যিক সরবরাহ ব্যবস্থা,ভগ্ন সড়ক, সেতু ও বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, দারিদ্রতা, খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি এবং অকর্ষিত ভূমি এমন অগুনিত পর্বততুল্য সমস্যার সামনে দাঁড়িয়ে, তখন শুধুমাত্র সমগ্র জাতীর একাত্মতা ও গভীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া উত্তোরন অসম্ভব। ১৯৭২ সালের ২৬'শে মার্চ জাতীয়করণের নীতি ঘোষণা উপলক্ষ্যে বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেছিলেন- " আমি আশা করব, অতীতে আপনারা যেভাবে দুর্জয় সাহসে বুক বেঁধে ইয়াহিয়ার সামরিক যন্ত্রকে পরাভূত করেছিলেন, গভীর প্রত্যয় ও সাহস নিয়ে তেমনি বর্তমান সংকটের মোকাবিলা করবেন। আমরা পুরাতন আমলের জীর্ণ ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে নতুন সমাজ গড়ে তুলবো।... আমার সরকার আভ্যন্তরীণ সমাজবিপ্লবে বিশ্বাসী। পুরাতন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অবাস্তব তাত্ত্বিকতা নয়, আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের বাস্তব প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামোকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে। শোষণ ও অবিচারমুক্ত নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলবো। "

এই কাজ সাধারনের জন্য সহজসাধ্য নয়, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু, যে অধিমানব ঈশ্বরের দূত হয়ে এসেছিলেন অসহায় মানুষের স্বপ্ন পূরনের জন্য, কোনও বাধাই তাকে পরাভূত করতে পারে না। ১৯৭২ সালের ৯'ই মে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানের এক বিরাট জনসভায় জাতির পিতা জানিয়ে দেন-

" সমাজতন্ত্র ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারবে না। সেইজন্য সমাজতন্ত্র কায়েম করার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছি। আপনারা নিশ্চই জানেন, বড় বড় ব্যাংক ছিল। ভূঁড়িওয়ালাদের ব্যাংক। আল্লাহর মর্জি, ঐ ব্যাংক এখন সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ব্যাংক। বীমা কোম্পানি আর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়- সাড়ে ৭ কোটি মানুষের। সেই আইন আমি পাস করে দিয়েছি। "

হ্যাঁ, মাত্র সাড়ে তিন বছরের রাষ্ট্রবিনির্মাণ কালে তিনি এই অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছিলেন কোনও এক অলৌকিক ক্ষমতাবলে।

কৃষি ভাবনা এবং সমষ্টিগত উন্নয়ন পরিকল্পনা

" খাদ্যের জন্য অন্যের উপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। আমরা কেন অন্যের কাছে খাদ্য ভিক্ষা চাইব? আমাদের উর্বর জমি, অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদ, আমাদের পরিশ্রমী মানুষ, আমাদের গবেষনা সম্প্রসারনের কাজে সমন্বয় করে আমরা খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করব। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। "- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সদ্য স্বাধীনতা লাভ করা একটি নদীমাতৃক দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি অবশ্যই কৃষিকাজ, এই বিবেচনায় জাতির পিতা দেশ জুড়ে সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১৩'ই জানুয়ারী মন্ত্রীপরিষদের প্রথম বৈঠকেই তিনি এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাংলার কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হয়। তিনি দরিদ্র কৃষকদের জন্য সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করেছিলেন। ভূমিস্বত্ব আইন জারি করে পরিবারপ্রতি ভূমিমালিকানা ৩৭৫ একর থেকে কমিয়ে সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা করা হয়। ১৯৭২-৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম বার্ষিক বাজেটে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দকৃত ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১০১ কোটি টাকা কৃষি উন্নয়নের জন্য রাখা হয়। কৃষি উন্নয়নের ভবিষৎ যাত্রাকে মসৃণ ও ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, যেমন- কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা কাউন্সিল, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সী, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশন সহ বহু প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। কৃষিভিত্তিক গ্রামীন বহুমুখী সমবায় পরিকল্পনার রূপরেখা দিয়ে তিনি বাংলার হতদরিদ্র সাধারন মানুষ তথা কৃষকদের উন্নতির বীজ বপন করে গেছেন নিজের হাতে।

" আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে-এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন। " হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন তার বাংলা একদিন সত্যিকারের সোনার বাংলা হয়ে পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করবে। শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, স্বপ্নের বাস্তবায়নের নিশ্চিত ক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসই তাকে পৃথিবীর অন্যান্য সকল রাষ্ট্রনায়কের চেয়ে আলাদা করে রাখে। তিনি জানতেন একক ভাবে কোনও নির্দিষ্ট অংশের উন্নতি দিয়ে সমষ্টিগতভাবে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিন্তু, দেশের অর্থনীতি যেহেতু কৃষি নির্ভর, তাই কৃষি সংশ্লিষ্ট সকল ক্ষেত্রগুলোকে সক্ষম করে তুলতে পারলে দেশের খাদ্যসমস্যা ও অর্থনৈতীক সীমাবদ্ধতার প্রাথমিক সমাধান অবশ্যই হবে। তাই, প্রথমেই বঙ্গবন্ধু সার কারখানাগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পুনরায় উৎপাদনমুখী করার উদ্যোগ নেন। বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নতমানের বীজ সংগ্রহ করে বাংলার কৃষকদের মাঝে বন্টন করেন। খাজনা মওকুফ করা, বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা, ভূমিস্বত্ব আইন জারী করে কৃষিজমির পরিমান বাড়ানো, গ্রামীন সমবায় পরিকল্পনা ইত্যাদি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে তার নিজের স্বপ্নের পথে যাত্রায় প্রতিটি পদক্ষেপকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করতে থাকেন। যেন, একটি ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে কুড়িয়ে নেওয়া আবর্জনা দিয়ে অপার্থিব দক্ষতায় কি নিপুন ভাবে অনুপম সৌন্দর্যময় একটি শিল্পকর্মকে একটু একটু করে ফুঁটিয়ে তুলছেন কোনও এক ঐশ্বরিক প্রতিভাধর শিল্পী। ঠিক এখানেই তিনি সমসাময়িক বিশ্বনেতাদের চেয়ে স্বতন্ত্র।

বঙ্গবন্ধুর সাংস্কৃতিক দর্শন

৩১'শে ডিসেম্বর ১৯৭০ ঢাকার হোটের পূর্বাণীতে ইত্তেফাক গ্রুপ অব পাবলিকেশানস্ এর আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদান কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন-

" শিল্পী, সাহিত্যিক এবং কবিদের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই প্রতিফলিত করতে হবে। তারা তাদের মানুষ, মাতৃভূমি ও সংস্কৃতির জন্য শিল্পচর্চা করবেন। জনগণের স্বার্থে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য সাহিত্যিকদের প্রাণ খুলে আত্মনিয়োগ করার আবেদন জানাচ্ছি আমি। আমি তাদের আশ্বাস দিচ্ছি, কবি ও সাহিত্যিকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের যে কোনও অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে। আজ আমাদের সংস্কৃতির সামনে কোনও চক্রান্ত নেই, শাসন বা নিয়ন্ত্রণের বেড়াজাল নেই। সাহিত্যিকরা আর মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের জন্য সংস্কৃতিচর্চা করবেন না। দেশের সাধারন মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তর সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখকে শিল্প- সাহিত্য- সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।"

প্রকৃতই বঙ্গবন্ধুর দর্শনে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে অপরিহার্য অংশটি ছিল বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতি। মূলত, বাংলার অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশের জন্য শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চাই অন্যতম প্রধান মঞ্চ, এই উপলব্দি থেকেই তিনি শিল্প ও সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ওপর জোর দেন। তিনি নিজেই ছিলেন সাহিত্যরসিক। বিশেষত, রবীন্দ্রসাহিত্য তাকে দারুন প্রভাবিত করেছিল। এক নিবিড় গনসংযোগের মধ্য দিয়ে অক্লান্ত ভাবে একের পর এক আন্দোলনকে তিনি যেভাবে ফলপ্রসূ করতে পেরেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় ধর্মীয় বিভাজনে বিভক্ত বাংলার সুবৃহৎ জনসাধারনকে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত এক সম্মোহনী শক্তি দিয়ে বাংলা সংস্কৃতির সেই অবিভক্ত মূল স্রোতে প্রবাহিত করেছিলেন সফল ভাবে। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার সাক্ষী ছিলেন তিনি। সমাজে ধর্মের নামে হানাহানি এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে ধর্মের অপব্যবহার ও তার প্রভাব খুব কাছ থেকেই প্রত্যক্ষ করে এসেছিলেন। তার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে এই সহিংসতা থেকে মুক্ত রাখতে তিনি সাংবিধানিক ভাবে যেমন অসাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তেমনি তা বাস্তবায়নের নিমিত্তে সাধারনের মননের বিকাশের জন্য শুদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃতির অবাধ চর্চার ক্ষেত্রটিকেও প্রসারিত করে গেছেন। আর এভাবে তিনি নিজেই পরিনত হয়েছেন 'রাজনীতির কবি ' হিসেবে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিশ্বনেতাদের আর কেউ একই সাথে মাতৃভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও শিল্প-সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনা করা এবং সফল হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন নি। বিশ্বনেতৃত্বের ইতিহাসে ঠিক এখানেই আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি স্বকীয় অধ্যায়।

ভবিষ্যত বাংলার গঠনতন্ত্র ও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন

১৫'ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭১ এ ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আওয়ামী লীগ দলীয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে আয়োজিত এক অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন -

" আমি সেদিনও বলেছিলাম, আজও বলছি- গণ অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমরা নিরলস ভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাব।.... দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যোগ্যতা আওয়ামী লীগের থাকলেও আমরা সবার সহযোগীতা ও বন্ধুত্ব চাই।.... সহকর্মী ভাইয়েরা আমার, আপনাদের দায়িত্ব অপরিসীম। জনগন অনেক আশা, অনেক আস্থা নিয়ে আপনাদের নির্বাচিত করেছে। চরম মূল্যের বিনিময়ে হলেও সেই আশা ও আস্থার মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। যেদিন আপনারা বাংলার মানুষের এই ভালোবাসা ও আস্থার অমর্যাদা করবেন, সেদিনই আপনাদের মুজিব ভাইয়ের, আপনাদের এবং আপনাদের প্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগের মৃত্যু হবে। "

পৃথিবীর আর কোনও রাষ্ট্রনায়কই এতটা আলোকিত হয়ে জনগনের মধ্যে থেকে, জনগনের জন্য স্বপ্ন দেখে, জনগনকে সাথে নিয়ে সেই স্বপ্ন পূরনের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন নি। মহান সৃষ্টিকর্তার আর্শীবাদ যেন সদা সর্বদা তার শরীরী ভাষায়, তার কন্ঠে, অভিব্যক্তিতে, চলনে, মননে উজ্জ্বল আলোকপ্রভার মত বিকশিত হত। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ জয় করার জন্য সংগঠিত হয় নি। বরং বাংলার মানুষের স্বাধিকার আদায়ের লক্ষে ও শোষণমুক্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যতদিন পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ টিকে থাকবে, ততদিনই এই দুটি সংগঠন সোচ্চার থাকবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ বিশ্লেষণ করলে তার যে অন্যতম বৈশিষ্টগুলো প্রাধান্য পায়, তা হল- সর্বোচ্চ ত্যাগ, প্রশ্নাতীত সততা, স্পষ্টবাদীতা, নিখুঁত জনসম্পৃক্তি, দেশ ও জনগনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, সিদ্ধান্তে অবিচল থাকার দৃঢ়তা, দুর্জয় সাহস এবং অসীম মানবতাবোধ। স্রষ্টাপ্রেরিত পুরুষ ছিলেন বলেই ব্যাক্তি শেখ মুজিব ও জননেতা শেখ মুজিবের কোনও আদর্শিক দ্বন্দ ছিলোনা। তিনি যেন নেতা হয়েই জন্মেছিলেন। ব্যাক্তি জীবনে নিজের মননে যে আদর্শ তিনি ধারন ও পালন করতেন, সেই আদর্শই তাকে বাংলার জনগনের মুখপাত্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিত করেছিল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রনায়ক রূপে। সেই একই আদর্শ তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার সংগঠনের কর্মীদের চেতনায়, যে সংগঠন তার অবর্তমানে তার সোনার বাংলাকে ভবিষ্যতে পরিচালিত করবে সফল ভাবে। মাত্র সাড়ে তিনবছরের ক্ষুদ্র পুর্নগঠনকালের সময়সীমার মধ্যেই তিনি একটি যুদ্ধবিদ্ধস্থ ধ্বংসস্তূপকে একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের সফল রূপরেখা দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। একটি যথার্থ সংবিধান প্রয়োগ করে এবং খাদ্য, সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্প ও বাণিজ্য, শিক্ষা, উৎপাদন, প্রশাসন, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসা ইত্যাদি প্রায় সকল অপরিহার্য বিষয়ে একের পর এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে, আইন প্রণয়ন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই একটি সার্বিক অবকাঠামো তৈরী করে দিয়ে গেছেন। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীত্ব চান নি। বরং, স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশকে সোনার বাংলা রূপে পৃথিবীর মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে। ঘাতকের বুলেটের আঘাত তার চেতনাকে হত্যা করতে পারেনি, তার আদর্শ কে মুছে দিতে পারে নি। আরও শত-সহস্র বছর পরেও সারা পৃথিবী মনে রাখবে বাংলার এই শ্রেষ্ঠতম সন্তানকে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের একটি বড় অংশ জেলখানায় বন্দী হয়ে ছিলেন। শোষকের দল তার শরীরকে আটকে রাখতে পারলেও, যে চেতনা, যে উদ্দীপনা, যে সাহস তিনি বাংলার জনগনকে দিয়েছিলেন, সেই প্রভাবকে আঁটকে রাখতে পারে এমন জেলখানা পৃথিবীর কোথাও ছিল না। শেখ মুজিব শুধু একটি ব্যাক্তি বা একজন মহান রাষ্ট্রনায়কের পরিচিত নয়, একটি চেতনার প্রতীক। ৭১ এর ৭'ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তার কন্ঠে যে মহাকাব্য উচ্চারিত হয়েছিল, তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক অবিশ্বাস্য রূপকথা হয়ে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। কোনও মানুষ কি করে এমন তেজস্বী,বাগ্মী, স্বপ্রতিভ হতে পারে! হ্যাঁ, তিনি সাধারন কেউ ছিলেন না। ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ২১ বছর নিষিদ্ধ ছিল ৭'ই মার্চের সেই ভাষণ। অনেকেই তা প্রচার করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন, এমন কি প্রাণ ও দিয়েছেন। আজ সেই ভাষণ ১২ টি বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদিত হয়ে সারা পৃথিবীতে প্রচারিত হয়। তার সেই অমর বাণী কোনও নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমায় আবদ্ধ হয়ে থাকেনি। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে যখনই শোষণের বিরুদ্ধে আমজনতার আন্দোলন হয়েছে, তখনই সেখানে ধ্বণীত হয়েছে সেই দৈব বাণী-

" এবারের সংগ্রাম - আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,

এবারের সংগ্রাম - স্বাধীনতার সংগ্রাম। "

লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আ.লীগকে নিষিদ্ধ করলে ভালো হতো: জামায়াত আমির
জামালপুরে মাদ্রাসায় ছাত্রী ভর্তিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ২০
ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে ডিএনসিসির কর বকেয়া ৩০ কোটি টাকা
শহীদ নিজামীর খুনিদের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে ইনশাআল্লাহ: রফিকুল ইসলাম 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা