কচি হিজড়ার খামারে জন্ম নিয়েছে এ কেমন নানাভাই!

কচি বেগম। সকলের কাছে কচি হিজড়া নামে অধিক পরিচিত। ২০১৩ সালে সরকার থেকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ স্বীকৃতি পাওয়া কচি বেগমের জীবনের বহু অজানা গল্প অনেকের মনে নাড়া দেবে। কীর্ত্তনখোলা নদীর পাড়ে ছেলের মতো দেখতে মেয়েলীসত্তা নিয়ে বেড়ে ওঠা সুদর্শন কচি ১৪ বছর বয়সে মনের কষ্টে পরিবার থেকে প্রথম আলাদা হন। এরপর প্রায় ৪ মাস পর আবার পরিবারের কাছে ফিরে যান। নিজেদের প্রিয় সন্তানকে কাছে পেয়ে পরিবার অনেক খুশি হলেও সমাজের রক্তচক্ষু কচির উপর থেকে সেই ভালোবাসা কেড়ে নেয়। পরিবারে আবারো তাকে নিয়ে শুরু হয় নানান কানাঘুষা। ও আবার বাড়ী আসছে কেনো? ও বাড়ী থাকলে আর কারো বিয়ে হবে না, ও আসলে এমন করে কেনো, ওর জন্য আমরা মুখ দেখাতে পারবো না, ও মেয়েদের মতো চলে কেনো? এসব প্রশ্নগুলো কচিকে প্রতিনিয়ত জর্জরিত করতে থাকে। কচি তার মনের অজানা কথাগুলো ও অব্যক্ত অনুভূতিগুলো শেয়ার করতে পারতেন না। আয়নায় যতবার নিজেকে দেখেতো ততবারই নিজেকে একজন সুন্দরী ও অপরাজিতা হিসেবেই আবিষ্কার করতেন। একটু সময় পেলেই ভাবতেন - ওদের কথায় আমি কেনো ছেলে হতে যাবো, আমিতো আর দশজন মেয়ের মতোই দেখতে সুন্দর। কিন্তু সব ভাবনাগুলোর কবর রচিত হতো কচির অবুঝ মনের মধ্যেই। অবশেষে পরিবার ও রক্তচোষা সমাজকে চিরমুক্তি দিয়ে নিজেকে একদিন বৃহহ্নলার ডেরায় স্থায়ীভাবে শপে দেন কচি। সেই থেকে কচি ওরফে কচি বেগম সকলের কাছে কচি হিজড়া নামে পরিচিত লাভ করেন।
৬১ বছর বয়সী কচি হিজড়া জীবনে বহু প্রতিকূল পরিবেশ দেখে দেখে বড় হয়েছেন, পাড়ি দিয়েছেন বন্ধুর পথ। এই সমাজের তুচ্ছমির কাছে তিনি নিজেকে কখনো ভেঙ্গে পড়তে দেননি। নিজের প্রবল ইচ্ছে শক্তির কারণে সমাজের অনেকের কাছে কচি হিজড়া এখন অনুকরণীয় একটি নাম। সব সময় নিজে নিজে কিছু করার চেষ্টা করে আসছেন তিনি। কখনো সফল হয়েছেন আবার কখনো ব্যর্থ হয়েছেন। তবে ব্যর্থ হয়ে তিনি কখনো দমে যাননি, বরং নতুন করে ঘুরে দাড়িয়ে আবার সফল হয়েছেন। মাত্র কয়েক বছর আগে উত্তরণ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তথা ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান বিপিএম(বার), পিপিএম(বার) এর সহযোগিতায় মাত্র ৩টি গরু নিয়ে শুরু করেন একটি কৃষি খামার। একটি পরিত্যক্ত জমিতে গড়ে তোলা খামারটিকে কচি হিজড়া ধীরে ধীরে বহুমূখী খামারে পরিণত করেন।
কিছুদিন আগে কচি হিজড়া’র জীবনে স্বপ্ন ভঙ্গের ঘটনা ঘটে। কর্তৃপক্ষ নিজেদের প্রয়োজনে খামারের জমিটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের জন্য নিজেদের দখলে নিয়ে নেন, বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উত্তরণ ফাউন্ডেশন এর মাধ্যমে কিছু ক্ষতিপূরণও দেন কচি হিজড়াকে। খামারে থাকা গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগী নিয়ে কচি হিজড়া পড়ে যান মহা বিপাকে। এই পরিস্থিতিতে এমন পিছুটানহীন যেকোনো মানুষই নিরাশ হয়ে পথে বসে যেতে পারতেন বা সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে একা একা নিজের পথে হাটতে পারতেন। কিন্তু কচি হিজড়া সেটা করেননি। তিনি নিজে কিছু করতে চান এবং সমাজের জন্যও কিছু অবদান রাখতে চান। তিনি আসলে স্বপ্নবাজ একজন উদ্যোক্তা। স্বপ্নকে জিইয়ে রাখতে চান এবং হাল না ছেড়ে তার হিজড়া কমিউনিটিকে সমাজের কাছে সম্মানিত করতে চান। এই প্রয়াসে কচি হিজড়া তুরাগ নদীর পাড়ে অর্থাৎ টঙ্গী ইজতেমার ঠিক অপর পাড়ে একটি জমি লিজ নিয়ে মাটি ভরাট করে আবারো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন ‘উত্তরণ ফাউন্ডেশন বহুমূখী খামার প্রকল্প’। পেয়ারাসহ নানা জাতের ফল ও তরতাজা সবজিতে পুরো খামারটি কি অপরূপ সাজে সেজেছে, ঠিক যেনো কচি হিজড়ার মতো পরিপাটি।
এই খামারে রয়েছে ৩ জন কর্মচারী যারা সার্বক্ষণিক খামারের দেখভাল করেন। খামারে রয়েছে মোট ১৩টি গরু, কিছুদিন পর এই সংখ্যা আরো বাড়বে। খামারে থাকা গরুর গোবর দিয়েই উৎপন্ন হচ্ছে বায়োগ্যাস যা অন্য খামারিদের জন্যও একটি উদাহরণ। গরু ছাড়াও খামারে রয়েছে বেশকিছু হাঁস-মুরগী ও কয়েকটি বড় সাইজের ভেড়া। সম্প্রতি একটি ভেড়ার কোল জুড়ে জন্ম নিয়েছে একটি ফুটফুটে বাচ্চা যাকে খামারের এক কর্মচারী ‘নানাভাই’ বলে ডাকেন। আর নানাভাই এই ডাকশুনেই ম্যা..ম্যা..করে কাছে এগিয়ে যায়, কোলে চড়ে বসে। অবলা পশুর প্রতি খামার কর্মচারীর এই ভালোবাসা আসলে উদ্যোক্তা কচি হিজড়ার অন্তরে লেগে থাকা ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ - যা খালি চোখে দেখে বুঝা যাবে না।
লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা

মন্তব্য করুন