ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না বহুরিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসে

নানা অনিয়ম ও ঘুষ লেনদেনের মধ্য দিয়ে চলছে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার বহুরিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিস। জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও চাহিদা মতো ঘুষের টাকা না দিলে সে কাগজপত্র গ্রহণই করা হয় না। নামজারি, ডিসিআর ও দাখিলায় লাগে অতিরিক্ত টাকা। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে কয়েক একর সরকারি সম্পত্তি বন্দোবস্ত দেয়ার অভিযোগও রয়েছে এই অফিসের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বহুরিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা মো. ফরহাদ আলী নিজেকে টাঙ্গাইল জেলা উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তাদের সভাপতি দাবি করে সেবা গ্রহীতাদের বলেন, টাকা দিলে ছেঁড়া দলিলেও কাজ হবে, না দিলে কাজ হবে না।
জানা গেছে, বহুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা ফটিক মিয়ার ছেলে কৃষক জুলহাস মিয়া গ্রামের ৭৮৯ দাগের ৬১ শতাংশের কাতে সাড়ে ৩০ শতাংশ, ৪৪৪৫ দাগের ২২ শতাংশ ও পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ৩৮ শতাংশসহ ১৪০ শতাংশ জমির নামজারি (খারিজ) করতে যান ওই ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। এজন্য ইউনিয়ন উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা ফরহাদ আলী তার কাছে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। জুলহাস ১০ হাজার টাকা দিতে চাইলে ফরহাদ আলী দাবিকৃত ৩০ হাজার টাকার কমে খারিজের আবেদন গ্রহণ করেননি। এত টাকা না থাকার কথা জানিয়ে বার বার ওই উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে অনুরোধ করলেও তিনি আবেদন গ্রহণ করেননি। এ সময় উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা ফরহাদ আলী ৩০ হাজার টাকা দিলে খারিজ হবে, না দিলে কাগজপত্র নিয়ে আলমারিতে তুলে রাখার পরামর্শ দেন। স্যারদের নাকি টাকা দিতে হয়। এছাড়া উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা সমিতির জেলার সভাপতি হিসেবে তিনি যে টাকায় যেভাবে খারিজ করে করে দেন সেটাই টাঙ্গাইল জেলার নিয়ম বলে ওই কর্মকর্তা জুলহাস মিয়াকে জানিয়েছেন বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান।
বহুরিয়া ইউনিয়নের কামারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ভ্যান চালক তারা মিয়া বলেন, তার দুই শতাংশ বসত বাড়ির নামজারি (খারিজ) করতে গেলে ওই উপসহকারী ভূমি কমকর্তা ১০ হাজার টাকা দাবি করে বলেন, টাকা দিলে এক মাসের মধ্যে খারিজ হয়ে যাবে। চাহিদা মতো অনেক কষ্ট করে ১০ হাজার টাকা তিনি উপসহকারী কর্মকর্তাকে দেন। কিন্তু অতিরিক্ত আরও টাকা দাবি করে খারিজ না দিয়ে তাকে ঘুরাতে থাকেন। পরে বহুরিয়া গ্রামের তার এক আত্মীয়কে নিয়ে ভূমি অফিসে গিয়ে টাকা ফিরত চান। কিন্ত টাকা ফেরত না দিয়ে রাগারাগি করে কয়েক মাস পর গত পনের দিন আগে তাকে সেই খারিজ দেন ভ্যান চালক তারা মিয়া জানিয়েছেন। এছাড়া খাস জমি বন্দোবস্তো দেয়ার ক্ষেত্রেও ওই উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা ফরহাদ আলী লাখ লাখ টাকা আদায় করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, বহুরিয়া ভূমি অফিসের পশ্চিম পাশে ১৫ শতাংশ জমিতে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া বাড়িতে বসবাস করেন আমজাদ সিকদার, আজাবর সিকদার তার ভাতিজা শাকিল সিকদার। কিন্তু বিএস পর্চায় ওই বাড়ির জমি সরকারি খাস সম্পত্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা ফরহাদ আলী ও তার স্থানীয় দালাল বহুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদের ছোট ভাই সানোয়ার হোসেন ও তার বন্ধু আমজাদ হোসেন তাদের কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করেন। এ টাকা দিলে ওই বাড়ির জমি তাদের নামে বন্দোবস্ত দেয়া হবে বলে তারা জানান। পরে চাহিদা মতো টাকা দেয়ায় আমজাদ সিকদার ও তার স্ত্রী আলেয়া বেগমের নামে ৫ শতাংশ ও ভাতিজা শাকিল সিকদার এবং তার স্ত্রী তাহমিনার নামে ৫ শতাংশ জমি বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্ত দরিদ্র আজাবর সিকদার চাহিদা মতো টাকা দিতে না পারায় তার ৫ শতাংশ জমি খাস হিসেবেই রয়ে গেছে বলে তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। চাহিদা মতো টাকা দিয়ে জমি বন্দোবস্ত পেয়েছেন বলে আমজাদ হোসেন সাংবাদিকদের নিকট স্বীকার করেছেন।
বহুরিয়া ইউনিয়নের গোহাইল বাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ও বহুরিয়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের কমান্ডার ফজলুল হক ফজলু জানান, টাকা ছাড়া ওই ভূমি অফিসে কোন কাজ হয় না। এরকম অনেক অভিযোগ তিনিও প্রতিনিয়ত পেয়ে বা শুনে থাকেন।
বহুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের তিন বারের নির্বাচিত ইউপি সদস্য বীরমুক্তিযোদ্ধা শাজাহান মিয়া জানান, ওই অফিসের উপ সহকারী ভূমি কর্মকর্তার চিহ্নিত কয়েকজন স্থানীয় দালাল রয়েছে।
কাগজপত্র সঠিক থাকলেও সঠিক নেই বলে দালালদের কাছে পাঠিয়ে কথা বলতে বলেন। পরে চাহিদা মতো টাকা পাওয়ার পর তিনি কাজ করে থাকেন বলে ওই বীরমুক্তিযোদ্ধা জানান।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বহুরিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তা মো. ফরহাদ আলী অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কাগজপত্র সঠিক থাকলে তার অফিসে কোনো টাকা পয়সা লাগে না। এছাড়া তার অফিসে কোনো দালাল নেই। দেড় শতাধিক ভূমিহীনকে তিনি জমি বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এরমধ্যে অনেকের পেছনে তার পকেটের ৮-১০ হাজার টাকা করেও খরচ হয়েছে বলে তিনি সাংবাদিকদের জানান।
মির্জাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুচী রানী সাহা বলেন, ওই উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা তার নাম ভাঙিয়ে অনেকের কাছ থেকে টাকা আদায় করে থাকেন বলে শুনেছি। তার বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে সত্যতা পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
(ঢাকাটাইমস/০৭সেপ্টেম্বর/এআর)

মন্তব্য করুন