নারী শিক্ষায় বেগম আনোয়ারা গার্লস কলেজের পথচলার এক দশক

মো. মাকসুদুল হক খান মিরাজ
 | প্রকাশিত : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৩৮

ধামরাই উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত গ্রামের নাম রাজাপুর। এ গ্রামের আশপাশের প্রায় ২০ কিলোমিটারের মধ্যে নেই কোনো কলেজ। সেখানকার উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েরা শহরে বসবাস করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও পিছিয়ে ছিল হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েরা। তাই এ অঞ্চলে নারী শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে ওই গ্রামের কৃতী সন্তান, মেঘনা ব্যাংক লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আলীম খান সেলিম নিজস্ব অর্থায়নে তার মায়ের নাম অনুসারে রাজাপুর বেগম আনোয়ারা গার্লস কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ধামরাইয়ের চৌহাট ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকায় মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য কোনো কলেজ না থাকায় নারী শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ছিল।

অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যাতায়াত ব্যবস্থা এবং অর্থের অভাবে পিছিয়ে যেত এবং অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের বাল্য বিয়ে দেওয়া হতো। এসব হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েদের কথা ভেবেই শিক্ষানুরাগী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আলীম খান সেলিম কলেজটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।

ছায়া সুনিবিড়, শান্ত ও মনোরম পরিবেশে কলেজটি তিন একর জায়গার ওপর স্থাপিত। মানবিক ও ব্যবসা শিক্ষা শাখায় ১২৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল কলেজটি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির এক দশকের পথচলায় সেখানে প্রায় ৪০০ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। ধামরাই উপজেলার মধ্যে এটিই একমাত্র গার্লস কলেজ।

লেখাপড়ার সুবিধার্থে কলেজে রয়েছে আধুনিক সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম, সাধারণ কক্ষ, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, চার হাজার বই সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, সেমিনার রুম, অডিটোরিয়াম, মেয়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র। ছাত্রীদের নিয়মিত কলেজে যাতায়াতের জন্য রয়েছে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। কলেজ গেট সংলগ্ন রয়েছে ক্যান্টিন, লাইব্রেরি ও ডিপার্টমেন্টাল স্টোর যা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটায়।

এই ঐতিহ্যবাহী নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার এক দশকেই অভিভাবক, সুধী সমাজের প্রশংসা ও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। এখানে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষকমণ্ডলী এবং আধুনিক সুদক্ষ কলেজ প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ছাত্রীরা প্রকৃত শিক্ষা ও সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে। সর্বোপরি সন্ত্রাস ও ইভটিজিং মুক্ত নিরাপদ পরিবেশে ছাত্রীরা নির্বিঘ্নে যথাসময়ে প্রত্যেকটি পরীক্ষায় আশানুরূপ সাফল্য লাভ করছে। সার্বিক কৃতিত্বের স্বাক্ষর স্বরূপ বেগম আনোয়ারা গার্লস কলেজ বেশ কয়েকবার উপজেলা পর্যায়ে শীর্ষস্থান লাভ করেছে। কলেজ প্রশাসন কৃতী শিক্ষার্থীদের গোল্ড মেডেল দিয়ে সংবর্ধনাও জানিয়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বৃত্তির ব্যবস্থা।

শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি এ কলেজে মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চার উপযুক্ত ব্যবস্থা ও পরিবেশ রয়েছে। ছাত্রীদের দেশ-সমাজসেবামূলক কাজে উৎসাহ ও অংশগ্রহণের জন্য কলেজে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর ও রোভার স্কাউট চালু করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। খেলাধুলার জন্য রয়েছে বিশাল এক খেলার মাঠ। কলেজটিতে জাতীয় দিবসগুলো যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়ে থাকে। এছাড়াও বিতর্ক প্রতিযোগিতা, দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ, সাহিত্য আসর, বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম ও ইতিহাস সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করার ক্ষেত্রে কলেজটি বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ও বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ জামাতা প্রফেসর ড. শফিক সিদ্দিক, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম এমপি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ এইচ. এন আশিকুর রহমান এমপি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা বেনজীর আহমদ এমপি, একুশে পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান খান ফারুক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. নূরুল আলম, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. কামরুল আলম খান, প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও ভাষা সৈনিক প্রফেসর মুহাম্মদ লুৎফর রহমান মল্লিক, মুক্তিযুদ্ধের বেসামরিক বাতেন বাহিনীর অধিনায়ক ও সাবেক এমপি খন্দকার আবদুল বাতেন, সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ মালেক, প্রফেসর ড. আবদুল্লাহেল কাফি, প্রখ্যাত নজরুলসংগীত শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক প্রমুখ এ কলেজ ক্যাম্পাসে অতিথি হয়ে এসেছেন। তাদের সংস্পর্শে এ এলাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পড়েছে ইতিবাচক প্রভাব।

স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশে সীমিত আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে শিক্ষা বিস্তারের পথ অবারিত করেন। একই সঙ্গে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নিরক্ষরতা দূরীকরণের কর্মকৌশল নেন। বঙ্গবন্ধু দেশকে নিরক্ষরমুক্ত ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনের আলোকে বর্তমান শিক্ষাবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এর সার্বিক উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। গত সাড়ে ১৪ বছরে বিভিন্ন সময়োপযোগী কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে শিক্ষা খাতে প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা বিদ্যানন্দিনী দেশরত্ন শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ২০১৯ সালে বেগম আনোয়ারা গার্লস কলেজ এমপিওভুক্ত হয়েছে। বর্তমান সরকার ও কলেজ প্রশাসনের উদ্যোগে এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সংস্কার ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান রয়েছে।

মায়ের নামে বেগম আনোয়ারা গার্লস কলেজ প্রতিষ্ঠাতার বিষয়ে শিক্ষানুরাগী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আলীম খান সেলিম বলেন, ‘নারী শিক্ষার বিস্তার ব্যতীত টেকসই জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। নারীদের শিক্ষিত করার মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে নারীদের সম্পৃক্ত করতে পারলে তারা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এ এলাকার মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য ভবিষ্যতে এ কলেজটিকে অনার্স পর্যায়ে উন্নীত করার ইচ্ছা আছে।’ কলেজের অধ্যক্ষ এ টি এম জহির রায়হানের অভিমত, ‘এটি একটি আদর্শ নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এলাকায় নারী শিক্ষা বিস্তারে কলেজটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ও রাখবে। ডিগ্রি পর্যায়ে বিএ, বিএসএস, বিবিএস কোর্স চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি কলেজে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

লেখক: মো. মাকসুদুল হক খান মিরাজ, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :