ডিএমপির পরবর্তী কমিশনার হাবিবুর রহমান, চলতি সপ্তাহেই প্রজ্ঞাপন

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পরবর্তী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মানবিক ও সমাজকল্যাণমূলক কাজ করে ব্যতিক্রমী এই পুলিশ কর্মকর্তা ৩৬তম ডিএমপি কমিশনার হচ্ছেন। চলতি সপ্তাহেই এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিএমপির পুলিশ কমিশনার হিসেবে হাবিবুর রহমানকে পদায়নের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছেন। সেই নথি পুলিশ সদরদপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর ডিএমপির বর্তমান কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের চাকরি মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এরপর তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাবেন। নানা কারণে বর্তমান ডিএমপি কমিশনারের চুক্তির মেয়াদ আর বাড়াতে চাচ্ছে না সরকার। তবে গোলাম ফারুক তার চাকরির মেয়াদ ছয়মাস বাড়াতে বিভিন্নভাবে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বেশ তোড়জোড় চালান। কিন্তু গতবছর ডিএমপি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পেলেও তেমন কোনো সফলতা দেখাতে পারেননি গোলাম ফারুক। একারণেই সরকারের উচ্চমহল তার চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি থেকে সরে আসে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে ঢাকা টাইমস জানতে পেরেছে, ডিএমপির কমিশনার হিসেবে বেশ কয়েকজনের নাম পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। প্রধানমন্ত্রী পুলিশের চৌকস কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানকে কমিশনার করতে সম্মতি দেন। সেই নথি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এই সপ্তাহে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, নির্বাচনের আগে ও পরে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলাসহ নানা কারণে ডিএমপি কমিশনারের পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার রাজধানীর আইনশৃঙ্খলার ভার এমন কর্মকর্তার কাছে রাখতে চাচ্ছে, যিনি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারেন। সেই হিসেবে সরকারের বিশ্বস্ত ও শতভাগ আস্থার নাম হাবিবুর রহমান। তাকে একবাক্যে সবাই মানবিক ও ডায়নামিক পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে মেনে নেন। তার পেশাদারি মনোভাব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি শতভাগ আনুগত্য ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার ধরন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বলে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে স্বীকার করেন সরকারি, বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন মহল।
হাবিবুর রহমানের ওপর যে দায়িত্বই অর্পিত হয়েছে, তিনি সঠিকভাবে তা পালন করেছেন। মেধাবী এই কর্মকর্তা সর্বশেষ ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি ও অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান হিসেবে ব্যাপক প্রশংসিত হন ও সুনাম কুড়ান। অতীতে তিনি যেখানেই দায়িত্ব পালন করেছেন সরকারের শতভাগ আস্থার প্রতিক ছিলেন। পেশায় পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হলেও সময় পেলেই কাছে টেনে নেন সুবিধাবঞ্চিতদের।
পুলিশিসেবার বাইরে গিয়ে হাবিবুর রহমান মানবিক কাজ করতে সবসময় ভালোবাসেন। তিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া বেদে সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে বদলে দিয়েছেন। কাজ করছেন যৌনপল্লীর শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে। শুধু তাই নয়, ভালো কাজ করতে সহযোগিতার পাশাপাশি দেন দিকনির্দেশনাও। এজন্য খ্যাতি আছে ‘মানবিক পুলিশ অফিসার’ হিসেবে। পাশাপাশি লেখালেখির মতো সৃষ্টিশীল কর্মেও সমান সক্রিয় হাবিবুর রহমান।
গত ৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘চিঠিপত্র: শেখ মুজিবুর রহমান’ ও একই বইয়ের ইংরেজি সংস্করন ‘লেটারস অব শেখ মুজিবুর রহমান’ এর মোড়কও উম্মোচন করেন। এই বই দুটি সম্পাদনায় হাবিবুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. এনায়েত করিম।
ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ‘পুলিশ সপ্তাহ-২০২৩’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বই দুটির মোড়ক উম্মোচন করেন। এর আগে হাবিবুর রহমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে নিয়ে ‘নন্দিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান’ সম্পাদনা করেন।
‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’ নামে তার গ্রন্থিত আরেকটি বইয়ে প্রথমবারের মতো বিস্তারিত উঠে আসে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা। ২০১৮ সালে প্রকাশিত বইটি সম্পাদনায় মুন্সিয়ানাও দেখিয়েছেন হাবিবুর রহমান। এছাড়াও হাবিবুর রহমানের গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘ঠার’ আলোচিত। এই বইয়ে তিনি বেদে সম্প্রদায়ের বিলুপ্তপ্রায় ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত ১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জের চন্দ্র দিঘলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন হাবিবুর রহমান। নিজ গ্রামের মোল্লাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই তার প্রারম্ভিক শিক্ষাজীবন। এস এম মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করে গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৭তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে ১৯৯৮ সালে কর্মজীবন শুরু করেন। হাবিবুর রহমান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালীন বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেকে এনে মাত্র একশ টাকায় পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি দেন; যা নিয়ে তিনি অনন্য নজির স্থাপন করেন। সেসময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিনি ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে উচ্চ প্রশংসা পান।
২০১৬ সালে হাবিবুর রহমান অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পুলিশ সদরদপ্তরে পদায়িত হন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান। ২০১৯ সালে তিনি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজির দায়িত্ব পান। দীর্ঘ তিন বছর তিন মাসের বেশি সময় দায়িত্ব পালন শেষে গেল বছরের ১০ অক্টোবর হাবিবুর রহমান ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রধান হন।
পুলিশে অনন্য হাবিবুর রহমান:
কর্মক্ষেত্রেও উজ্জ্বল সাক্ষর হাবিবুর রহমানের। তার উদ্যোগে যুগান্তকারী নানা পদক্ষেপ পুলিশে এনেছে অনেক পরিবর্তনও। গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি দায়িত্ব সফলভাবে পালন করে আসা এই পুলিশ কর্মকর্তার পেশাগত সাফল্য তাকে নিয়ে গেছে ঈর্ষণীয় অবস্থানে। কর্মক্ষেত্রে ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে হাবিবুর রহমান তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও দুইবার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন। তিনি একজন ক্রীড়া সংগঠকও। কাজ করছেন দেশের কাবাডি নিয়েও।
হাবিবের একক প্রচেষ্টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে টেলিকম ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয় পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দায়বদ্ধতা থেকেই তার এ উদ্যোগ। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ এটি সর্বসাধারণের প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি জাতীয় পুলিশ সপ্তাহ ২০১৭-র উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই নবনির্মিত জাদুঘর ভবনের উদ্বোধন করেন।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি থাকা অবস্থায় হাবিবুর থানায়-থানায় সিসিটিভি লাগিয়ে তা নিজ দপ্তরে বসে মনিটরিংয়ের উদ্যোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য পুলিশের সেবাকে সহজ করেছিলেন। ফলে মানুষ থানায় সেবা পেয়েছে। যেমন, বাসে নারীদের হয়রানিরোধে ১০০ সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়।
হাবিবুর রহমানের হাত ধরে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’ এ ‘টেলিমেডিসিন সেবা’ চালু হয়। যেখানে বিনামূল্যে ২৪ ঘণ্টা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেবা দেয়া হয়।
(ঢাকাটাইমস/১৬সেপ্টেম্বর/এসএস/কেএম)

মন্তব্য করুন