মাদক কারবারির কাছে ঘুষ দাবি: চারঘাটের সেই ওসিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পরামর্শ

আশিক আহমেদ, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৯:৩৩ | প্রকাশিত : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৯:৩১

মাদক কারবারির কাছে ঘুষ চাওয়ায় রাজশাহীর চারঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহবুবল আলমের বিরুদ্ধে চাওয়া দ্রুত সময়ের মধ্যে শাস্তির আওতায় আনা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। পুলিশের একজন সাবেক কর্মকর্তা ও অপরাধ বিজ্ঞানের একজন শিক্ষকের ভাষ্য, ন্যায় বিচারের স্বার্থে দ্রুত সময়ের মধ্যে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত। এতে পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জল হবে।

২০২৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে চারঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুবুল আলমের কোয়ার্টারের শয়নকক্ষে ডেকে নিয়ে জনৈক সাহারা বেগমের কাছে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। এ টাকা দিলে তাকে অবাধে মাদক কারবার করতে দেবেন বলে জানান ওসি মাহবুব। এ ঘটনায় সাহারা বেগম ১৬ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর পুলিশ সুপারের (এসপি) কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের সঙ্গে রেকর্ড করে রাখা ৬ মিনিটি ৫৩ সেকেন্ডের কথোপকথনের অডিও জমা দেওয়া হয়।

সাহারা বেগমের বাড়ি চারঘাট থানার চামটা গ্রামে। তার স্বামী আব্দুল আলিম কালু মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। কালু গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শলুয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সদস্য পদে নির্বাচন করেন। এর জের ধরে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে অভিযোগ সাহারা বেগমের।

সাহারা বেগমের ভাষ্য, ‘আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ ও র‌্যাবের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। চারঘাট এলাকায় তার সোর্সের মাধ্যমে অনেক মাদক র‌্যাব-পুলিশ জব্দ করেছে। গত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে তিনি সদস্য পদে নির্বাচন করেন। এরপর থেকে এলাকার মুক্তা, শুভ ও সাব্বিরের সঙ্গে আমার স্বামীর বিরোধ বাঁধে। এর জের ধরে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করায় তারা।’

সাহারা বেগম বলেন, ‘চারঘাটের চামটা গ্রামের মুক্তা, শিবপুর গ্রামের সাব্বির ও শলুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ শুভ আমার কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা না দিলে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেন। সেই অভিযোগ করতে থানায় গেলে ওসি সাত লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে আমাকে মাদকের ব্যবসা করতে বলেন। তাতে আমি রাজি না হলে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেন।’

এ ঘটনার পরে অভিযুক্ত মাহবুবুল আলমকে চারঘাট থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। তাকে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন উঠেছে দেশের সরকারপ্রধান যখন মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স দেখিয়েছেন সেখানে একজন পুলিশ কর্মকর্তা কীভাবে ঘুষ নিয়ে মাদক ব্যবসা করার অনুমতি দেন। এতে কি তিনি পুলিশের থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন কী না?

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ডেফিনেটলি আমি মনে করি, এ ধরনের কথা তো কোনভাবেই অ্যাকসেপটেবল না। এটা আনঅ্যাকসেপটেবল (অগ্রহণযোগ)। ল এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি যাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছে তাদের মুখে এ ধরনের কথা। আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি রক্ষক হয়ে ভক্ষক হওয়া। যাদেরকে প্রটেকশন দেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা যদি এই কাজ করে তাহলে তো সোসাইটির ল এনফোর্সমেন্টের যে ভূমিকা সেটাতো আর থাকে না। ল এনফোর্সমেন্টের ভূমিকা হচ্ছে মানুষের অধিকারকে রক্ষা করা, মানুষের সহিংসতা রোধ করা, ফ্রট প্রটেক্ট করা, ক্রাইম প্রটেক্ট করা। তো কাজেই এটা আনঅ্যাকসেপটেবল। এটার পক্ষে পজেটিভ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। ডেফিনেটলি এটা একটি বড় ধরনের অপরাধ।

অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, একটা অ্যাকটিভিসটের জায়গা থেকে বললে ইনিশিয়ালি, অবশ্যই কোনভাবেই এই কর্মকর্তা পুলিশে থাকার অধিকার নেই। কিন্তু পুলিশের যেহেতু একটা নিয়ম কানুন আছে। আইনের মধ্যে কিন্তু সবই আছে, কিন্তু আমরা আইনটা বাস্তবায়ন করি না। ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নাই’, সেরকম অবস্থা। এখন পুলিশেরও তো জবাবদিহিতা আছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তো সেই আইনের ভিত্তিতেই আমি মনে করি, যেটুকু শাস্তি তাকে দেওয়া দরকার, সেই আইনের ভিত্তিতে সেইটুকুই তাকে দেওয়া উচিৎ। এটাই হচ্ছে ন্যায় বিচার। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা মানে হচ্ছে আইনের শাসন। আর সেই শাস্তিটা দ্রুত দেওয়া উচিৎ। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিৎ। এটাকে ফেলে না রেখে দ্রুত শাস্তি দেওয়া উচিৎ। এতে পুলিশের ভাবমূর্তি ও পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা রক্ষা পাবে।

পুলিশের সাবেক আইজিপি নুর মোহাম্মদ বলেন, যে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ তো হতেই পারে। সেই অভিযোগের কতটুকু সত্য কতটুকু মিথ্যা এভাবে বোঝা যায় না। তবে আমি যেটা পত্রিকায়ও দেখলাম যে এটা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বক্তব্যে মনে হয়েছে যে ঘটনাটি সত্য। তবে এগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। কোনো অবস্থায়ই লেনিয়েন কিংবা দুর্বল ভিউ নেওয়ার সুযোগ নেই।

নুর মোহাম্মদ বলেন, পুলিশ একটা নিয়ম-কানুন বিধি-বিধান মোতাবেক চলে। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ হলে এটা সঠিকভাবে তদন্ত করে ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাকে চাকরিচ্যুতির বিষয়টি আসবে, নাকি অন্য কোনো শাস্তি হবে, না নিয়মিত মামলা হবে, না তাকে জেলে পাঠাবে, এটা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আসতে হবে। হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না ।

অডিওতে যা বলেছেন মাহবুবুল আলম

অডিও রেকর্ডে ওসি মাহবুবুল আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘নির্বাচন করতে মন্ত্রী আমাকে গাইবান্ধা থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন। আমি তার কথা ছাড়া কারও কথা শুনি না।’ চারঘাট এলাকায় গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে মামলা দেওয়ার কারণে জেলা ডিবি পুলিশের সমালোচনা করেন তিনি। এরপর বলেন, ‘দুই লাখ টাকা দেন, কালকেই ডিবির ওসিকে (পরিদর্শক আতিক রেজা সরকার) বদলি করে দেবো। এবার আপনার পরিবারের কাউকে ধরলে ১০ লাখ টাকার কমে ছাড়াতে পারবো না।’

এরপর মাহবুব বলেন, ‘এখনো তোমার গায়ে আঁচড় দেইনি। বহুত ফাঁকি দিয়েছো। কালকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে আসবা। এখন সেরকম সময় নয় যে কেউ পয়সা খায় না। সবাই পয়সা খাচ্ছে। এমন কেউ বাদ নেই যে পয়সা খাচ্ছে না। পুরো জেলা পয়সা খাচ্ছে। এখানে আমার থানা চালাতে মাসিক অনেক টাকা লাগছে। আমি স্যারকে কথা দিয়ে এসেছি। স্যারকে বলেছি, এখানে মাদক ছাড়া কিছু নেই।’

পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব বলেন, ‘মুক্তা (চারঘাটের মাদক সম্রাট নামে পরিচিত) অ্যাকশন নিতে পারবে না, শুভ (ছাত্রলীগ নেতা ও মাদক কারবারি) অ্যাকশন নিতে পারবে না। তোমরা পাঁচ লাখ টাকা দিতে পারবা? ধরে ওদের চালান দিয়ে দেবো। থাকি না থাকি ওদের সাইজ করবো। তোমরা বাইরে থেকে ব্যবসা (মাদক ব্যবসা) করবে।’ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আতিক রেজা সরকারের আবারও সমালোচনা করে মাহবুবুল আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘নির্বাচনের আগে শুভকে ধরতে পারবো না। কথা সব ভেঙে বলবো না। কথা সব হয়ে গেলো; যদি আতিকের বদলি চাও দুই লাখ টাকা দাও। কালকেই আতিকের বদলি হয়ে যাবে।’

মাহবুবুল আলম আরও বলেন, ‘পাঁচ লাখ আর দুই লাখ-সাত লাখ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করো। আতিক বাদ, ওই দুইজনকে (মুক্তা ও শুভ) ট্যাকেল দেওয়ার দায়িত্ব আমার। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরে মন্ত্রীকে বলে ওই দুইজনকে ধরে অ্যারেস্ট করে চালান করে দেবো। আমার সব ওপরের লাইন। যে টাকা দিবা এই টাকাই ওপরে কাজ করবে।’

বৃহস্পতিবার বিকালে রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. সাইফুর রহমান বলেন, মাহবুবল আলমকে থানা থেকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। তিনি এখনও পুলিশ লাইনে সংযুক্ত আছেন। আর তার বিরুদ্ধে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেবে। প্রতিবেদন দিলে তার বিরুদ্ধে সেই অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(ঢাকাটাইমস/২১সেপ্টেম্বর/এএ/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :