ঢাকা টাইমসের সঙ্গে আলাপকালে কর্নেল অলি

সরকারকেই ভাবতে হবে দেশে কীভাবে শান্তি ফিরবে

জাহিদ বিপ্লব, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ১১:৩৩ | প্রকাশিত : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:১৪

সাবেক মন্ত্রী, বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বীর বিক্রম বলেছেন, ‘সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে, ১৫ বছর দেশ চালিয়েছে, অর্থনীতির কী অবস্থা হয়েছে সরকার সেটা জানে। আজকে ১০০ বিলিয়নের ওপরে এই সরকার বিদেশ থেকে ঋণ নিয়েছে। বর্তমান রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন। গার্মেন্টসের অবস্থা খুবই খারাপ।’

তিনি বলেন, ‘তারা যদি দেশপ্রেমিক হয় জনগণকে মেরে, অর্থনীতিকে ধ্বংস করে, সমাজকে পঙ্গু করে ক্ষমতায় আসার কোনো কারণ থাকতে পারে না। লোভ করা ভালো নয়।’

গতকাল শনিবার মহাখালীর ডিওএইচএসস্থ বাসভবনে ঢাকা টাইমসের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।

কর্নেল অলি আহমেদ বলেন, ‘সরকার সহনশীল নয়, ধৈর্যহারা হয়ে গেছে। অনিশ্চয়তায় ভুগছে। যার কারণে বিরোধী দলের কোনো কর্মকাণ্ড সহ্য করতে পারছে না। আমরা ভাঙচুরে নাই, অহিংস রাজনীতি করছি। কোনো ধরনের অন্যায় সংবিধান পরিপন্থি কোনো কাজে লিপ্ত নই। সুতরাং সরকারের এখানে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নাই। পুলিশকে তারা ইনস্ট্রাকশন দিলে হয়- যে যার মতো মিছিল করে যাবে। তারা যদি দেশের কোনো ক্ষতি না করে, জনগণের মালের কোনো ক্ষতি না করে তাদের বিরুদ্ধে যেন কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হয়। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি- বিএনপির এক কোটির ওপরে সদস্য ঘরে ঘুমাতে পারছে না।’

তিনি বলেন, ‘বিরোধী দলের অনেক নেতা ঘরে নাই। তারা বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে আছে। এভাবে দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে দেশের মঙ্গল হবে না। দেশকে ধ্বংসের দিকে তারা ঠেলে দিচ্ছে। সরকারের যতটুকু সহনশীল হওয়া দরকার ততটুকু সহনশীল নয়।’

কর্নেল অলি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে তারা যখন রাস্তায় মিছিল-মিটিং, হরতাল-অবরোধ করেছিল আমরা কিন্তু তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে সংসদে রাতে জেগে থেকে কেয়ায়টেকার সরকারের আইন প্রবর্তন করেছিলাম। তাদের উচিত হবে জনগণের সঙ্গে সংঘর্ষে না যাওয়া, কারণ বিরোধী দলের সমর্থক হচ্ছে শতকরা ৯০ জন। ৯০ জনের মতামতকে অবজ্ঞা করে কারোর পক্ষে সরকার পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সরকারের উচিত দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য, অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য, সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য, ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিরোধী দলের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে আলোচনায় বসে নির্বাচনের দিন-তারিখ ধার্য করা এবং কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করা।’

সাবেক এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘আমি একজন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। বিএনপিতে কোনো সন্ত্রাসী নাই। বিএনপিতে এমন কোনো সন্ত্রাসী নাই যে আইনের পরিপন্থি কাজ করবে। এটা সবাই জানে। ২৮ তারিখে পরিষ্কার হয়ে গেছে সমগ্র বিশ্বের কাছে, সমগ্র জাতির কাছে সরকারের কিছু অতি উৎসাহী ছাত্রলীগ-যুবলীগ যারা পুলিশে আছে তাদের নেতৃত্বে গাজীপুর থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় সমস্যাগুলো করেছিল। বর্তমানে যেগুলো করছে সেগুলো বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজানোর জন্য এ ধরনের বাস পোড়ানোর ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমার জানমতে বিএনপি কখনো জ্বালাও-পোড়াওয়ের সঙ্গে নাই। শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করতে চায়। আইনের পরিপন্থি কোনো কাজ করতে তারা অভ্যস্ত নয়।’

তিনি বলেন, ‘৭২ সালের নির্বাচন সম্পর্কে সবাই জানে কীভাবে নির্বাচন হয়েছিল। ’৯৬ সালেও কীভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের বের করে দিয়ে নির্বাচন করেছিল সেটাও জানে সবাই এবং কীভাবে তারা ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল। একসময় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিমের নেতৃত্বে হাইকোর্ট ভবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করেছিল। ২০০৬ সালে লগি-বৈঠা দিয়ে বিএনপি-জামায়াতের কয়েকজনকে হত্যা করেছিল। যে উকিল প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মেরেছিল তিনিও আজকে জজ। আরেকজন চিফ জাস্টিস ছিলেন, তিনি এখন বিদেশে। তাকে গুলির মুখে অস্ত্র ধরে বিমানবন্দর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। হেফাজতকে রাতে চারদিক থেকে ঘিরে হত্যা করেছিল। অনুরূপভাবে ২৮ তারিখে বিএনপিকে চারদিক থেকে ঘেরাও করে নিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল আরও হতাহত করার জন্য। নেতাকর্মীরা অলিগলিতে সরে যাওয়ায় জানে বেঁচে গেছে।’

এলডিপি প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে ১৫ বছর দেশ চালিয়েছে. অর্থনীতির কী অবস্থা হয়েছে সরকার সেটা জানে। আজকে ১০০ বিলিয়নের ওপরে এই সরকার বিদেশ থেকে ঋণ নিয়েছে। বর্তমান রিজার্ভ ১৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে। গার্মেন্টসের অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের মূল উৎস হচ্ছে তিনটি। রপ্তানি, গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স। তিনটিরই খুবই দুরবস্থা। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ পঙ্গু। সুতরাং সরকারকে বুঝতে হবে তারা যদি দেশপ্রেমিক হয় জনগণকে মেরে অর্থনীতিকে ধ্বংস করে, সমাজকে পঙ্গু করে ক্ষমতায় আসার কোনো কারণ থাকতে পারে না। লোভ করা ভালো নয়।’

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের এই যোদ্ধা বলেন, ‘যতদূর হয়েছে ততটুকুই শান্তিপূর্ণভাবে বিদায় নেয়াটা দেশের জন্য মঙ্গল ও তাদের জন্য মঙ্গল। অবশ্যই কেয়ারটেকার সরকার দিতে হবে। কারণ ইলেকশন কমিশনে যেসব দল গিয়েছিল তারা একবাক্যে বলেছে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নাই এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন। সবাই যখন বলছে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নাই, তখন সরকারকে ভাবতে হবে দেশে কীভাবে শান্তি ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।’

তিনি বলেন, ‘পৃথিবীতে যে দুই দেশের মধ্যে যখন সংলাপ হয় তখন একটা নির্দিষ্ট এজেন্ডা নিয়ে হয়। এজেন্ডা ছাড়া সংলাপ করা মানে সাঁতরে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেয়ার মতো। বিগত দিনে অনেকগুলো সংলাপ হয়েছে। ’৯৫ সালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমস্যা সমাধানের জন্য অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর স্যার নিনিয়ানকে পাঠিয়েছিল জাতিসংঘ। এরপর আমি নিজেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে একটা ছকের মধ্যে উভয়ে রাজি হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত বিএনপির কিছু নেতা সেদিন রাজি হয় নাই বিধায় সেই সংলাপটা সফল হয় নাই। এরপর বিএনপির আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার ও আওয়ামী লীগের আবদুল জলিলের মধ্যে দীর্ঘদিন সংলাপ হয়েছে। সেই সংলাপ ফলপ্রসূ হয় নাই। তারপর ১৩ সালে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে অস্কার ফার্নান্ডেজ তারানকো এসেছিল আলোচনার জন্য। ওই আলোচনার সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম না। দুটি আলোচনায় আমি সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম। আমি দেখেছি এজেন্ডা ছাড়া যদি কোনো কিছু আলোচনা হয় এটা কখনো সফল হয় না। অবশ্যই উভয়পক্ষের মধ্যে আদান-প্রদানের মাধ্যমে একটা প্রোগ্রাম সেট করতে হবে। অর্থাৎ আলোচনার বিষয়বস্তু ঠিক করতে হবে।’

সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ কী চাচ্ছে? আপনি কী চান? পুলিশ কী চায়? যারা বিভিন্ন সরকারি চাকরিজীবী আছে তারা কী চায়। আমরা যারা রাজনীতিবিদ আছি আমরা কী চাই? আমরা সবাই চাই আমরা যেন আমাদের নিজের ভোটটা প্রয়োগ করতে পারি। তারপর সরকারে কে আসবে না আসবে সেটা ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে। আমরা চাচ্ছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে। এটাতে রাজি না হওয়ার তো কোনো কারণ নাই। সরকার এত উন্নয়ন করেছে তাহলে ভয়ের কারণ কী। তাদেরকে যদি জনগণ ভোট দেয় তাহলে তারাই আবার ক্ষমতায় আসবে। আমরা তাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেব। অসুবিধা কোথায়? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন অবশ্যই নতুনভাবে করতে হবে। এটা হাইকোর্টেরও রায় ছিল। আগামী দুইবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে। সুতরাং এখানে না করার কোনো কারণ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই সরকার আমাদের শর্ত না মানা পর্যন্ত কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। জনগণের যে দাবি সেটা ইনশাআল্লাহ আমরা আদায় করে ছাড়ব। ২০১৪ ও ২০১৮ সাল আর কখনো বাংলাদেশে ফিরে আসবে না। জনগণের অধিকার এখন যদি আদায় না হয় তাহলে এটা উত্তর কোরিয়া-চায়না-রাশিয়ার মতো রাষ্ট্রে পরিণত হবে। জনগণের কোনো দাম থাকবে না। জনগণ স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারবে না। অধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারবে না। সাংবিধানিক অধিকার থাকবে না। ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। গরু-ছাগলের জীবিকা নির্বাহ করতে হবে।’

বর্ষীয়ান এই নেতা বলেন, ‘সংসদে প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে জানোয়ারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ এদেশের শতকার ৯০ ভাগ লোক জানোয়ার হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়।’

তিনি বলেন, ‘ক্রাইম অব সিন লাগানোর কথা ছিল প্রধান বিচারপতির বাসার সামনে, অথচ ক্রাইম অব সিন লাগানো হয়েছে বিএনপি অফিসের সামনে। এটা দুর্ভাগ্যজনক। কিছু পুলিশ অফিসার অতি উৎসাহী হয়ে যে কাজগুলো করছে এর থেকে সবাইকে বিরত থাকা উচিত। কারণ তাদের মা-বাবা ভাইবোন সবাই ভোটার। সবাইকে স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ দিতে হবে।’

অলি আহমেদ বলেন, ‘বিএনপির যিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আছেন তিনি পরিকল্পনা করেই কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। প্রথম সারির নেতারা অ্যারেস্ট হবে, দ্বিতীয় সারির নেতারা অ্যারেস্ট হবে, তৃতীয় সারির নেতারা অ্যারেস্ট হতে পারে। এগুলো তার চিন্তাচেতনায় আছে এবং আমরাও এগুলো চিন্তাচেতনায় রেখেছি। আসল শক্তি হলো আমাদের মাঠের কর্মীরা, দেশের জনগণ। বিভিন্ন মিছিলে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হচ্ছে। কারণ এই যুদ্ধ শুধু রাজনৈতিক দলের নয়, ১৮ কোটি মানুষের। এদেশে গণতন্ত্র থাকবে না, স্বৈরতন্ত্র কায়েম হবে সেটা চিন্তা করতে হবে সবাইকে। এটা যদি কেউ মনে করে কর্নেল অলি আহমেদের একার ফাইট ভুল হবে। ১৮ কোটি মানুষকে স্বাধীনভাবে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে। এবং সবাইকে এই সুযোগ আদায়ের জন্য নিজ নিজ জায়গা থেকে কর্মসূচিগুলো সফল করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।

(ঢাকাটাইমস/১২নভেম্বর/জেবি/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :