বোধোদয়: ১৯৪৭-১৯৭১

নুসরাত জাহান শেফা
 | প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৩৩

শীতের ছুটিতে গ্রামে গিয়েছিলাম। ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে দুঃসম্পর্কের এক আত্নীয়ের বাড়িতে যাই। সেখানে বাড়ির কর্তা (বৃদ্ধ) আমাদের সাথে তার জীবনের অনেক গল্প করল। তিনি আশির দশকে মেম্বার ছিলেন। তার এই এলাকায় ভালো নাম-ডাক আছে। পৈত্রিকসূত্রে সে অনেক সম্পদের মালিক এবং এই এলাকার উন্নয়নে সে অনেক ভূমিকা রেখেছে। তার দেশের প্রতি আলাদা একটা দায়িত্ববোধ কাজ করে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সে হারুন মেম্বার নামে পরিচিত। ঠিক সেই মুহূর্তে যার সঙ্গে এসেছিলাম, সে উঠে চলে যায়। কিন্তু আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম এবং সে তখন থেকে এখন পর্যন্ত গ্রামের সকল প্রকার বিচার-আচারসহ অনেক উন্নয়নমুলক কাজ করে যাচ্ছে। আমি মুগ্ধতার সাথে তার কথা শুনছিলাম। তার প্রতি সম্মান এবং মুগ্ধতা বেড়েই চলছিল।

বেড়ানো শেষে বাড়ি ফেরার পথে আমার বেড়ানোর সঙ্গীকে বলছিলাম এমন মানুষদের সাথে কথা বললে নিজ দেশের মাটির প্রতি দায়িত্ববোধ এবং তীব্র টান অনুভব করি।

সঙ্গী হেসে বললো- মানুষের সব কথায় বিশ্বাস করতে নেই।

আমি প্রশ্ন করলাম কেন? সে কি মিথ্যে বলছে?

তার উত্তর শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। সে বললো- হারুন মেম্বার ১৯৭১ সালে এই এলাকার নামকরা একজন রাজাকার ছিল। ওই সময় তার বন্ধু ছিল একই গ্রামের সিগদার কমান্ডার। সে ছিল পাকিস্তানি কমান্ডার এবং শান্তিসংঘের সদস্য। সে এই দেশরক্ষাকারী মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করতে মেতে উঠেছিল এক নির্মম খেলায়। মুক্তিযোদ্ধাদের যারা সাহায্য করত তাদেরকেও সে ছাড় দেয়নি এবং নিপীড়নের এক জঘন্য কালো অধ্যায় আছে সিগদার কমান্ডারের নামে। আর হারুন মেম্বারের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল তার কাজে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের খবর দিতেন এবং সিগদার কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধাদের হানাদারের হাতে তুলে দিত। হারুন প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের বর্বর শাসন ব্যবস্থা সমর্থন করত। দেশ স্বাধীনের পর সিগদার কমান্ডারকে মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলে। হারুন মেম্বার কোনো এক কারণে বেঁচে যায়। বেঁচে যাওয়ার পর সে তার কালো অতীত ঢাকতে ধর্মীয় বেশভূষা ধারণ করেন এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। গ্রামের লোক দ্রুতই তার অতীত ভুলে যায় এবং তাকে মেম্বার হিসেবে ভোট দেয়। আমি বড়োদের থেকে আরও শুনেছি বিচার আচারে সময় সুযোগ পেলেই অবিচার করেন এবং আত্মীয়-স্বজনের সম্পদ আত্মসাৎ করার অনেক প্রমাণ আছে হারুন মেম্বারের নামে।

আমি খুব অবাক হলাম। আর ভাবতে শুরু করলাম, আমার সোনার বাংলা..., যে বাংলাকে বাংলাদেশে পরিণত করতে এক লক্ষ নয়, দুই লক্ষ নয় ৩০ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। আমরা কীভাবে পারি তাদের রক্ত মাড়িয়ে এসব কপট লোককে ক্ষমতা সম্মানের আসনে বসাতে। আমরা ভুলে যাই ত্যাগী মানুষগুলোর ইতিহাস।

বর্তমান পরিস্থিতি আরো বিরূপ; নতুন প্রজন্ম জানেই না বাংলাদেশের ইতিহাস। আজকের লেখাটা তাদের জন্য।

শুরু করবো ১৯৪৭ সাল থেকে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়। দুটি রাষ্ট্র গঠন হয়। হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে গঠন হয় ভারত এবং অপরটি মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে গঠন হয় পাকিস্তান। তৎকালীন সময় পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল দুটি ভাগে; একটি পূর্ব পাকিস্তান অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। দুটি অঞ্চলের মধ্যে দুরত্ব ছিল পনেরো কিলোমিটার। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই দুটি অঞ্চলের ধর্ম ইংরেজি ভাষা ছাড়া তাদের কোনো প্রকার মিল ছিল না। ভাষা, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি সকলদিকে ছিল বিস্তর ফারাক। বলা যায়, এতসকল মৌলিক পার্থক্য এবং এত দূরত্ব পর্যালোচনা করে দুটি দেশ একসাথে নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করা অসম্ভব। কিন্তু এত বড়ো দুর্বলতা দেশভাগের সময় সকলের চোখ এড়িয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাকর্মীরা ধীরে ধীরে মুসলিমলীগকে প্রহসনের দিকে নিয়ে যায়। যার ফলস্বরূপ পূর্ব-পাকিস্তানের সাধারণ জনতা চরম নির্যাতন এবং নিপীড়নের শিকার হয়। প্রহসনের নায়ক ছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। জিন্নাহর বিভিন্ন উক্তি এবং স্বেচ্ছাচারিতায় পূর্ব পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার প্রয়াস পায়। তার প্রথম প্রয়াস ছিল বাংলা ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ১৯৪৮ সালে ২৪শে মার্চ সমার্বতন অনুষ্ঠানে ঘোষনা দেন- একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সাধারণ ছাত্রজনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং কার্জন হলে না, না শব্দে তীব্র প্রতিবাদ জানাতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের ধরনের মনোভাব এবং অবিচার দেখে পূর্ব-পাকিস্তানের নেতারা সোচ্চার হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৯ সালে ২৩শে জুন টিকাটুলিতে গঠন করা হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ- যার সভাপতি নির্বাচন হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক এবং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। জিন্নাহ ১৯৪৯ সালে সেপ্টেম্বরে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার ঘোষণার পর থেকে তর্ক-বিতর্ক চলমান ছিল। তার মৃত্যুর পর নতুন গভর্নর নিযুক্ত হন খাজা নাজিমুদ্দিন এবং ১৯৫১ সালে অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এক আক্রমণকারীর হাতে নিহত হন। এরপর তার আসন গ্রহণ করেন নাজিমুদ্দিন। ১৯৫২ সালে ৩০শে জানুয়ারিতে তিনি ঢাকায় এক জনসভায় আবারও ঘোষণা দেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।এরপর বিশ্ব দেখেছিল এক নতুন সংগ্রামী জাতির উত্থান। সংগ্রামী জাতি ২১শে ফেব্রুয়ারি হরতাল, ধর্মঘট, বিক্ষোভ এবং সমাবেশের ডাক দেন। ২০শে ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে পাকিস্তান সরকার সারা দেশে ১৪৪ ধারা জারি করেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী পূর্ব বাংলার ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। সেই মিছিল কোনো সাধারণ মিছিল ছিল না, সেটা ছিল জনসমুদ্র। সেই জনসমুদ্রের স্লোগান ছিলরাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই সারা বিশ্বের টনক নড়ে যায়। প্রতিবাদী মিছিল যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনার অতিক্রম করছিল, ঠিক তখন পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে। সে স্থানে অসংখ্য ছাত্র-জনতা আহত হয় এবং শহিদ হন সালাম, রফিক, বরকত জব্বারসহ আরো নাম না জানা অনেকে। ২২শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ধর্মঘটের ডাক দেন। ছাত্র, শিক্ষক জনতা রাস্তায় নেমে পড়ে এবং চরম আন্দোলন শুরু করে। সেদিনও পুলিশের গুলিতে নিহত হন শফিকুর রহমান, আব্দুল আউয়াল অহিউল্লাহসহ আরো কয়েকজন। তারপরও আন্দোলন চলতে থাকে। এমতাবস্থায় পাকিস্তান সরকার দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। পৃথিবীতে এমন একটি জাতির উদ্ভব হলো যারা মাতৃভাষায় কথা বলার দাবি আদায়ে জন্য প্রাণ দিয়েছিল।

পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের পূর্ব বাংলার প্রশাসনিক বিভাগে অসমতা দুর্নীতি এবং অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বৈষম্য দেখে প্রথমে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, পরবর্তীতে সাধারণ মানুষ আওয়ামী মুসলিম লীগের দিকে ঝুঁকে পরে এবং ধীরে ধীরে মুসলিম লীগ গ্রহনযোগ্যতা হারাতে থাকে। ১৯৫৩ সালে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল। তখন সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন আইয়ুব খান। তিনি গণতন্ত্র হত্যার দিকে অগ্রসর হন। শুরু করেন এক স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা। পূর্ব পাকিস্তান ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, সে সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে, পূর্ব বাংলাকে নিঃশেষ করতে মত্ত হয়ে ছিলেন। শোষণমূলক শাসন ব্যবস্থা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে চরম চাপ সৃষ্টি করেন। ক্ষমতাসীনদল মুসলিম লীগের বিপক্ষে জয়লাভের উদ্দেশ্যে সকল দল এক হয়ে মওলানা ভাসানী, কে ফজলুল হক হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃতে ১৯৫৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন এবং নির্বাচনের ইশতেহারে ঐতিহাসিক ২১ দফা পেশ করেন। ২১ দফার উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, সকলের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন ব্যবস্থাগ্রহণ করে বন্যা দুর্ভিক্ষ রোধ, কৃষি শিল্পখাতের আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং আন্তর্জাতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। এককথায় দেশকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। চাপের মুখে পরে ১৯৫৪ সালে মুসলিমলীগ নির্বাচনের ঘোষণা করে এবং যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল নৌকা এবং মুসলিম লীগের প্রতীক ছিলহারিকেন নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেরে বাংলা কে ফজলুল হক মনোনীত হন। কিন্তু পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টের ক্ষমতায়ন বানচাল করতে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভা বাতিল করেন। সংগ্রামী নেতা শেখ মুজিবসহ আরো অনেককে জেলে বন্দি করে। কিন্তু বাঙালি নেতারা দমে যায়নি, আন্দোলন চলছিল এবং বাঙালির মুক্তির খসড়া এঁকেছিল। ১৯৫৫ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়- যাতে করে হিন্দুরাও দলে যোগ দিতে পারে এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আন্দোলন বা যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে।

১৯৬২ সালে ভারতের সাথে চীনের যুদ্ধ হয়, সেখানে ভারত পরাজিত হয়। তখন জেনারেল আইয়ুব খান ভারতকে দুর্বল মনে করে এবং এই সুযোগে কাশ্মীর দখল করতে সামরিক বাহিনীকে ভারতে পাঠিয়ে দেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। ১৭ দিনের এই যুদ্ধ কাশ্মীরের চরম ক্ষতি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তান জনসংখ্যার দিক থেকে বেশি ছিল। আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ভারত এই যুদ্ধে জয় লাভ করে।

এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের চোখ খুলে যায়। যুদ্ধ চলাকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা শুরু থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সুরক্ষার কথাই ভাবছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ছিল অরক্ষিত। সেসময় চাইলেই ভারত পূর্ব পাকিস্তানের উপর আক্রমণ করে তাদের দখলে নিতে পারত, কিন্তু তারা তা করেনি। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের পরে পশ্চিম পাকিস্তান তাদের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করতে, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পাচার করে নিতে থাকে। এতে করে পূর্ব বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সেসময় পূর্ব বাংলার সাথে ভারতের একটি সুসম্পর্ক তৈরি হয়।

এমন অবস্থা চলতে থাকায় ১৯৬৬ সালে লাহোরে একটি সম্মেলনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের অনুরোধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অংশগ্রহণ করেন এবং সেখানে গিয়ে তিনি দফা পেশ করেন।

দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ছয় দফার উদ্দেশ্য ছিল স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা। দুটি অঞ্চলের মধ্যে সামাজিক অর্থনৈতিক দূরত্ব কমিয়ে সমতা রক্ষা। ছয় দফা পেশ করা ছাড়া তখন আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগণ, পূর্ব পাকিস্তানের উর্বর জমিতে জন্মানো ফসল রক্ষণাবেক্ষণের অজুহাতে পশ্চিম পাকিস্তানে কল-কারখানা নির্মাণ করে, পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত অর্থ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বড়ো বড়ো স্কুল-কলেজ শিল্পকারখানা নির্মাণ করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি সামরিক বাহিনীসহ সকল ধরনের উচ্চপদস্থ চাকরিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সুযোগ দেয়া হতো। সকল জায়গায় বঞ্চনা লাঞ্ছনার শিকার হতো বাঙালিরা। শুধু তাই নয় পাকিস্তানের দুটি অঞ্চলের রাজধানী স্থাপনের জন্য বরাদ্দ ২০০ কোটি টাকার মধ্যে আইয়ুব খান ২০ কোটি টাকা ইসলামাবাদের রাজধানী স্থাপনের উন্নয়নের জন্য খরচ করেন এবং ঢাকায় রাজধানী স্থাপন উন্নয়নের জন্য খরচ করেন কোটি টাকা। এই ছয় দফাকে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা পত্রিকাগুলো বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান থেমে থাকার পাত্র নন। তিনি ঢাকায় এসে সাংবাদিকদের এক সাক্ষাৎকারে আবারও দফা পেশ করেন এবং এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেন।

আইয়ুব খান খুব ভালোভাবেই টের পেয়েছিল দফা স্বাধীনতার পূর্ব প্রস্তুতি। তাই সে এই দাবি বানচাল করতে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে এবং আইনের বলে সে বঙ্গবন্ধুসহ নেতাকর্মীদের গ্রেফতারও করে।

কিন্তু আইয়ুব খান যা ভেবেছিল হয়েছিল সম্পূর্ণ উল্টো। গ্রেফতারের পর পূর্ব পাকিস্তানে গণআন্দোলনে রূপ নেয়। বঙ্গবন্ধুসহ নেতাকর্মীদের মুক্তি ছয় দফা দবিতে সারা দেশে হরতাল ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। অফিস-আদালত, কল-কারখানা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করে। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান আরও আট জনকে গ্রেফতার করেন এবং সকলকে হুশিয়ারী প্রদান করেন। কিন্তু ছাত্রজনতা রাজপথ ছাড়েনি, তারাও সাফ জানিয়ে দেয় সকল নেতাকে মুক্তি ছয়দফা দাবি না মানা হলে তারা রাজপথ ছাড়বে না।

আইয়ুব মোনেম মিলে ১৯৬৭ সালে আন্দোলন বন্ধ করার জন্য এক জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তারা বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেন এবং বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জন নেতাকর্মীর নামেআগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন এবং ট্রাইবুনাল গঠন করে। ভেতরে ভেতরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সাধারণ ছাত্রজনতা এই মিথ্যা মামলার পর বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধুসহ নেতাদের জীবন ঝুঁকিতে আছে। তারা বঙ্গবন্ধুসহ সকল নেতাকর্মীর জীবন নিয়ে সন্ধিহান হয়ে পরে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৬৯ সালে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করে।

১৯৬৯ সালে ২০শে জানুয়ারি মিছিল চলাকালীন পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। ঘটনাস্থলে আসাদুজ্জামান নামের ঢাকা বিশ্বদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক ছাত্র নিহত হয়। আসাদের রক্তমাখা জামা নিয়ে সহযোদ্ধারা মিছিল বের করে। এরপর আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আন্দোলনকে থামাতে মেতে ওঠে এক নতুন ষড়যন্ত্রে, তারা আগরতলা মামলার ১৭তম আসামি সার্জন্ট জহুরুল হককে বন্দি অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে। খবর ছাত্রজনতার কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথে ছাত্রজনতা ক্ষিপ্ত হয়ে, দুর্বার গতিতে আন্দোলন আরো জোরদার করে। প্রধান বিচারপতির বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এমতাবস্থায় উপায় না পেয়ে আইয়ুব খান মামলা প্রত্যাহার করে। মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রেসকোর্স ময়দানে গণ-সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তখনও আন্দোলন চলতে থাকে এবং স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়ে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া খানের হাতে সামরিক ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া ক্ষমতা হাতে নিয়ে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নতুন চাল চালেন। তিনি ১৯৭০ সালে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। ঘোষণাকে আওয়ামী লীগ সাধুবাদ জানায় এবং প্রস্তুতি গ্রহণ করে। প্রথমেই তারা সকল দলকে একত্র করে একটি দলে পরিণত করে এবং একই উদ্দেশ্য একই মতামত স্থাপন করে। কারণ ১৯৫৪ সালে নির্বাচন বিলুপ্তির মতো কোনো সুযোগ যাতে পাকিস্তান শাসকগণ না পায়।

কিন্তু ১৯৭০ সালে ১২ই নভেম্বর নির্বাচনের আগে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণবঙ্গে ঘটে যায় এক মহাদুর্যোগ। ভয়াবহ বন্যা-জলোচ্ছ্বাসে দশ থেকে পনেরো লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং বিপুল পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়। এত বড়ো ক্ষয়ক্ষতির জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়। কারণ জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস পাওয়ার পরও সরকারকর্তৃক কোনো প্রকার দুর্যোগ মোকাবিলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দুর্যোগের পরও সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য সহযোগিতার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। শাসকবর্গের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অনীহা উদাসীনতা দেখে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ কৃষক, জেলে, দিনমজুর, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পাকিস্তান সরকারের উপর থেকে সকল প্রকার আস্থা হারিয়ে ফেলে। সকলে আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই দুর্যোগের কারণে নির্বাচন স্থগিত হয়। কিন্তু শেখ মুজিব আর এক মুহূর্তের জন্য পাকিস্তানের এই কার্যকলাপ সহ্য করতে রাজি নন। তিনি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার তাগিদ দেন আর তারিখ ঘোষণা না করলে বিপ্লবের হুশিয়ারি দেন। অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার ৭ই ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে আর মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪৪ আসনের মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পিপলস পার্টি ৮৮ ভোটে জয়লাভ করে। জয়ের পর ভুট্টো দুটি অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করার প্রয়াস করেন এবং বাঙালির স্বায়ত্তশাসনেরছয় দফা দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। দফায় দফায় বেঠক হয় কিন্তু পূর্ব বাংলার ক্ষমতা হস্তান্তর হয় না। পাকিস্তানি শাসকবর্গ পূর্ব বাংলায় দাঙ্গা বাঁধিয়ে, বৈঠক বানচাল করে। পূর্ব বাংলায় এসে ক্ষমতা দেওয়ার নামে তালবাহানা শুরু করে, তারিখের পর তারিখ দেয়। দেশের মধ্যে অরাজকতা সৃষ্টি করে এবং ভুট্টো হুমকি দিতে থাকে। হঠাৎ করে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান অর্নিদিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিত করেন।

তারপরই শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল। অল্প সময়ের মধ্যে পুরো দেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে এবং ২রা ৩রা মার্চ হরতালের ডাক দেয়। ২রা মার্চ কারফিউর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদয়ালয়ের কলা ভবনে বিশাল জনস্রোতের সামনে ঢাকসু ভিপি আবদুর রব সর্বপ্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তলন করেন।

৭ই মার্চ ঢাকার রেসর্কোস ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আঠারো মিনিট ভাষণ দেন। সেই ভাষণে বাঙালি জাতির মুক্তির মানচিত্র এঁকেছিল বঙ্গবন্ধু। বাঙালি বুঝতে পেরেছিল তাদের কী করতে হবে। সকলে দেশকে মুক্ত করতে বদ্ধপরিকল্প হয় এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। বিরূপ অবস্থা দেখে ইয়াহিয়া খান ১০ই মার্চ ঢাকায় সম্মেলনের আহ্বান জানান। ছাত্র-সাধারণ জনগণের উপর সামরিক বাহিনী প্রকাশ্যে গণহত্যা চালায়। তাদের এই বর্বরতার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ সম্মেলন প্রত্যাখান করে। ১৫ই মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকায় আসেন, ভুট্টো ইয়াহিয়া টানা ১০ দিন বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনার নামে সময় অতিবাহিত করেন। এই আলোচনার সময় গোপনে ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী এক বড়ো আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। যার নাম ছিলঅপারেশন সার্চলাইট ইয়াহিয়া ২৫শে মার্চ হঠাৎ আলোচনা শেষ না করে, নীরবে পাকিস্তানে চলে যান। যাওয়ার আগে সামরিক বাহিনীকে অপারেশন সার্চলাইট-এর আদেশ দিয়ে যান। ২৫শে মার্চ রাতে সামরিক বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক বুদ্ধিজীবীদের ঘুমন্ত অবস্থায় হলে বাসায় গিয়ে গণহত্যা চালায়। ইতিহাসের পাতায় অপারেশন সার্চলাইট একটি জঘন্য অধ্যায়। নিরস্ত্র সংগ্রামী বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়নার দল।

সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু খবর পেয়ে, অনুধাবন করেছিলেন তার হাতে সময় কম তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। সেই মুহূর্তে সে বাঙালি জাতির উদ্দেশে পত্র লিখে স্বাধীনতার ডাক দেন। পত্রে লেখাছিলআজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। যার যাকিছু আছে তাই নিয়ে শত্রু মোকাবিলায় নেমে পড়ো ২৫শে মার্চ দিবাগত-রাতে অথ্যাৎ ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতারে দুপুর দেড়টায় এম হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। পরেরদিন ২৭শে মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার পত্রটি পাঠ করে শোনান।

ঘোষণার পরপরই সংগ্রামীজনতা অর্থাৎ সকল শ্রেণির মানুষ সকল বাধা ভেঙে স্বাধীনতার সংগ্রামে নেমে পড়ে। শুরু হয় নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের সময় পাশের দেশ ভারত সর্র্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ভারতের সেনাবাহিনী মিলে যুদ্ধকে জোরদার করার লক্ষে যৌথ বাহিনী গঠন করে। ভারত সরকার কোটি বাস্তুহারা মানুষের থাকার এবং খাদ্যের ব্যবস্থা করে। যুদ্ধের সময় অস্ত্রে জোগান দেয় এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করে। ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। এদিকে পাকিস্তান সরকার যুদ্ধে জয়লাভের জন্য পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের কিছু সংখ্যালঘু দোসরকে নিয়ে তৈরি করে শান্তিসংঘ সংখ্যালঘু বেইমানরা মুক্তিযোদ্ধাদের সকল তথ্য হানাদার বাহিনীদের পৌঁছে দিত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুরু করে গণহত্যা, গ্রাম লুট, ধর্ষণসহ শত শত গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধারাও প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যায়। গণযুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করে। ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধারা একটু একটু করে দেশকে হানাদারমুক্ত করতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র তীব্র নিন্দা জানায়। সোভিয়েত রাশিয়া বাংলাদেশকে সমর্থন করে, পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধ করার চাপ দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা একের পর এক ঘাটি মুক্ত করতে থাকে। এতে করে পাকিস্তানি বাহিনী ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পরে এবং আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি পূর্ব বাংলার কমান্ডার অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে নিয়াজি ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে যৌথবাহিনীর কমান্ডার জগজিৎ সিং আরোরার সামনে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামের নতুন একটি দেশের জন্ম হয়

৩০ লক্ষ শহিদের রক্তধারায় যে স্বাধীনতার জন্ম হয়েছিল, বিশ্ব মানচিত্রে যে রক্তিম সবুজ ভূখণ্ডের জন্ম হয়েছিল আজ অর্ধশত বছর পেরিয়ে সেই ভূখণ্ডের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক,

সামাজিক সাংস্কৃতিক মুক্তি কতটুকু ঘটেছে সেই হিসাব না হয় নাই হলো। আজ ৫২ বছরে

হয়তো বদলেছে অনেককিছু, মানুষের চিন্তাধারা বদলেছে, শুধু মুক্ত আকাশে আমার সোনার বাংলার লাল সবুজের পতাকাটা একই আছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :