‘আগুনে হামার সংসারডা পুইড়া গ্যাছে’
‘আগুনে পুইড়া হামার সংসারডা পুইড়া গেছে, হামার দুই মাসের মাইয়া সিনথিয়ারে লইয়া হামি বাইর হইতে পারছি। আমি মাইয়ারে কোলে লইয়া ঘুমে ছিলাম, মাইয়ার কান্দন হুইনা হামার ঘুম ভাঙে। চোক (চোখ) মেইলা চাইয়া দেহি হামার উপরে আগুন দাউদাউ কইরা জ¦লে। এক চিৎকার দিয়া কোনোরহম মাইয়াডারে লইয়া বাইর হইছি। সংসারডারে হবায় মনের মতো কইরা সাজাইছালাম।’ কথাগুলো টলমলে চোখে বলছিলেন, তেজগাঁওয়ে বিএফডিসির পাশে মোল্লাবাড়ি বস্তিতে আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ নাজমা।
নাজমা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অনেক কষ্ট কইরা আমি এই বস্তিতে আমার সংসারডা সাজাইছেলাম। আমি আর আমার জামাই কাম কইরা টাহা জমাইয়া আলমারি, সুকেজ আর টিভি কেনছেলাম। হামার সাজানো সংসারডা কেডা আগুন লাগাইয়া ফুইরা (পুড়ে) দিল। কত কষ্ট কইরা না খাইয়া থাইকা টাহা জমাইছেলাম। কত জিনিস দিয়া ঘরডারে সাজাইছেলাম। আইজ আমার দুই মাসের মাইয়াডা লইয়া এই শীতের মদ্যে (মধ্যে) রাস্তায় পইড়া রইছি। আল্লাহ গরিবের কপালেই সব কষ্ট লেইখা রাখছে।’
নাজমা জানান, তার বিয়ের বয়স দুই বছর হয়েছে। স্বামীর সাথে একসঙ্গে কাওরান বাজারে মাছ কাটার কাজ করেন তিনি। রাতে দুই মাসের মেয়ে সিনথিয়াকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিলেন। স্বামী তখন বাজারে ছিলেন। রাত আনুমানিক দুইটার দিকে মেয়ে সিনথিয়ার কান্নায় ঘুম ভাঙে নাজমার। তখন বাইরে চিৎকারের শব্দ আর মাথার ওপর আগুন দেখতে পেয়ে মেয়েকে নিয়েই কোনোমতে বাইরে আসতে পারেন নাজমা।
এমন অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনার বাস্তবিক গল্প এই মোল্লাবাড়ি বস্তিতে। বস্তিতে থাকা প্রায় ৩শ পরিবার এখন খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করছেন। সহায় সম্বল হাড়িয়ে সেখানখার মানুষগুলোর অসহায়ত্বের কথা যেন কারোই ভাববার সময় নেই। খেয়ে না খেয়ে শীতের মধ্যে পরিবারগুলো রাস্তায়, রেল লাইনের পাশে কখনো দাঁড়িয়ে আবার কখনো বসে সময় পার করছেন।
কাওরান বাজারে মাছ কেটে ৯ জনের পরিবারের দায়িত্ব নাসিমার কাধে। অসুস্থ বাবা, মা, ও সন্তানদের নিয়ে মোল্লাবাড়ি বস্তিতে থাকতেন তিনি।
নাসিমা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘৬ হাজার টাকা ভাড়া দিয়া আমরা এই বস্তিতে থাকতাম। ছোট থেইকাই এইহানে আমি বড় হইছি। আগুনে পুইরা আমাগো ঘরের সব ছাই হইয়া গ্যাছে। ঘরের একটা মালামালও বাইর করতে পারি নাই। কয়েক মিনিডের মধ্যে আগুন ছড়াইয়া পড়ছিল। কোনোরহম ঘরের সবাই দৌড়াইয়া বাইর হইছিল। তয় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আমাগো সবাই বাইচা আছে।’
কাঁচামালের ব্যবসায়ী মনির ঢাকা টাইমসকে জানান, কাচামাল কেনার জন্য ভোর রাতে বের হন। রাত দুইটার পর শব্দ শুনে বের হয়ে দেখেন আগুন ধেয়ে আসছে। কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে পালান তারা।
মনির বলেন, ‘আগুন দেখে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার ৫ মিনিটের মধ্যেই তাদের ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সারাদিন তেমন খাওয়া হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে একটি কম্বল আর এক বস্তা চাল দিয়ে গেছে। তবে এই শীতে থাকতে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে।’
মোল্লাবাড়ি বস্তির ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, কনকনে শীতে তারা সবাই খোলা আকাশের নিচে এক কাপড়ে কোনোমতে বসে আছেন। অনেকেই সকাল থেকে কিছু খাননি। আর কেউ সহায়তার জন্য আসেনি। তবে তারা আশা করেন সরকার তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন।
ছালমা নামের এক নারী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি মানষের বাসায় কাম কইরা আমার মাইয়াডারে পড়ালেহা করাই। আগুনে আমাগো ঘরের সব কিছুই পুইড়া গেছে। পরনের কাপর ছাড়া আমি আর আমার মাইয়া কিছুই লইয়া বাইরাইতে পারি নাই। মাইয়াডার সব বই আর গাইড পুইরা গেছে। মনে হয় মাইয়াডার পরালেহা বন্ধ হইয়া যাইবো।’
তিনি বলেন, ‘শীতের মধ্যে মাইয়াডারে লইয়া রেল লাইনের পাশে বইসা আছি। দুপুরে একলোক আইশা খিচুরি দিয়া গেছিলো। রাইতে হুনছি খিচুরি খাওয়াইবো। তয় খোলা আকাশের নিচে ক্যামনে এই শীতের মধ্যে থাকুম মাইয়াডারে লইয়া। সরকার চাইলে আমাগো একটা ব্যবস্থা কইরা দিতে পারে।’
(ঢাকাটাইমস/১৪জানুযারি/এইচএম/এসআইএস)