সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

প্রখর রোদে হাওরে পুরুষের সঙ্গে ধান শুনানোয় ব্যস্ত ঘরের ঘরের নারীরা

সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে পুরোদমে চলছে কৃষকের কষ্টে ফলানো পাকা সোনার ধান ঘরে তোলার কাজ। শ্রমিক দিয়ে মাঠ থেকে ধান কেটে বাড়ির পাশে খলায় এনে করা হয় মাড়াইয়ের কাজ। আবার আধুনিক প্রযুক্তির কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিনে ধানকাটা ও মাড়াইয়ের পরে চলে শুকানোর কাজ।

পুরুষের সঙ্গে ধান শুকানো, চিটা ছাড়ানো, গোলায় তোলা, খড় শুকানোসহ অনেক ভারী কাজ করছেন কৃষক পরিবারের নারীরা।

সারা বছর হাওরের অবলা, ঘরকুনো ও অসহায় গৃহস্থ পরিবারের এই নারীরা খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হলেও বৈশাখের সময়ের চিত্র উল্টো।

ধানের মায়ায়, জীবিকার টানে সংসারের উন্নতির জন্য হাওরের খলায় চলে আসেন সবাই। কাজ করেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কারণ এই ধানের ওপর নির্ভর করে আগামী দিনগুলোতে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, বিয়ে-শাদী, সংসার খরচসহ সবকিছুই। এভাবেই যুগ যুগ ধরে ঘরের মেয়েরা পুরুষের সঙ্গে সমান তালে কাজ করে বদলে দিচ্ছেন হাওরের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, কৃষি, সেই সঙ্গে দেশকে।

হাওরে কৃষির বিকল্প কর্মসংস্থান নেই বললেই চলে। যার ফলে কৃষিই একমাত্র জীবনের চালিকাশক্তি। তাই পুরুষের শ্রম-ঘামে গড়ে ওঠা হাওরে সংসার আর সন্তান পালনকারী নারীদের হাতেই গড়ে উঠছে হাওর। কৃষি সঞ্জীবনী লাভ করছে নারীর হাতের ছোয়ায়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খলায় কাজ করছেন। তাদের শ্রমের জন্য হয়ত কোনো মূল্য দেওয়া হয় না। তাদের সংখ্যাটা কত এই পরিসংখ্যানও নেই। তবে কৃষি বিভাগ বলছে হাওরে যত শ্রমিক কাজ করে তার অর্ধেকই নারী। এই নারীরা হাওরের কৃষির চাকা সচল রেখেছেন কৃষকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুগ যুগ ধরে। তবে পারিশ্রমিক নিয়ে দরিদ্র পরিবারের কিছু নারী অন্যের কাজ করেন। তাদের হিসাব জানা নেই কারও। তবে এই শ্রম বিপ্লবে প্রায় তিন লাখ কৃষক পরিবারের নারী রয়েছেন।

হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে এমন তথ্য।

জেলার মাটিয়ান হাওর পাড়ের কৃষানী জামেলা বেগম কাজ করছেন নিজেদের ধান শুকানোর খলায়। তিনি জানান, পরিবারের একমাত্র কৃষিই সংসার চলার হাতিয়ার। তাই সংসারের অন্য কাজের মতোই কৃষি কাজ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আর এর মাধ্যমে সংসারে কিছুটা আর্থিক উন্নতি হয়। তার জন্য খুব বেশি একটা সমস্যা হয় না। শুধুমাত্র বাচ্চা-কাচ্চাদের দিকে ঠিকভাবে খেয়াল রাখা কষ্ট হয়ে যায়।

জামেলা বলেন, ‘নিজের জন্যই আমরা ধান শুকানো থেকে শুরু করে গোলায় তোলা পর্যন্ত কাজ করি।’

জেলা কৃষি অফিসার জানান, এ বছর সুনামগঞ্জের ১৩৭টি হাওরে ২ লাখ ২৩ হাজার ৪০৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। আবাদকৃত জমি থেকে ১৩ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিকটন ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।

তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ হাসান উদ দোলা জানান, শহরাঞ্চলে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বা অন্য ফ্যাক্টরি থাকলেও হাওরাঞ্চলে তা নেই। এখানকার নারীরা কৃষিকাজে নিজের জন্যই কৃষককে সহযোগিতা করেন।

হাসান উদ দৌলা বলেন, ‘কৃষি সম্পর্কে জানাতে ও কৃষি কাজে আগ্রহ বাড়াতে কৃষিভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কৃষি প্রদর্শনীতে হাওরের নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছি।’

কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, ‘হাওরে হতদরিদ্র পরিবারের খুব অল্প নারী শ্রমিক আছেন— যারা মজুরিতে কাজ করেন। কিন্তু সচ্ছল ও অসচ্ছল কৃষক পরিবারের অনেক নারী সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাওরের খলায় থাকেন। ধান তুলতে তারা অনেক কষ্ট করেন।’

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘হাওরে কাজ করা প্রায় তিন লাখ নারী– কৃষক পরিবারের সদস্য কিংবা স্বজন। তারা কোনো পারিশ্রমিক ছাড়া কাজ করছেন। তবে পারিশ্রমিক নিয়ে দরিদ্র পরিবারের কিছু নারী কাজ করেন।’

বিমল চন্দ্র বলেন, ‘এবার হাওরে বাম্পার ফলন হয়েছে। আশা করছি আগামী মাসের প্রথম সাপ্তাতেই হাওরের সম্পূর্ণ ধান কাটা শেষ হবে। ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকার ধান উৎপাদন হবে এবার এই জেলায়।’

(ঢাকাটাইমস/২৭এপ্রিল/এসআইএস)