বইমেলায় বৈমানিক মাহফুজুল আলমের ‘মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড আগে’

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৩:০৪

মাহফুজুল আলম, পেশায় একজন বৈমানিক। দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখির সঙ্গেও যুক্ত। লিখেছেন অসংখ্য গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ। এছাড়া উপস্থাপনা, আবৃত্তি ও একের পর এক প্রামাণ্যচিত্রে নেপথ্য কণ্ঠ দিয়েও শ্রোতাদের আকৃষ্ট করেছেন চুম্বকের মত।

দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখি করলেও কখনো বই প্রকাশ করেননি মাহফুজুল আলম। এবারই প্রথম অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম গল্প সংকলন ‘মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড আগে’। বইটি প্রকাশ করেছে শাহজী প্রকাশনী। পাওয়া যাচ্ছে মেলার ৪৪৯ নং স্টলে।

১৮টি ছোট গল্প নিয়ে একটি গল্প সংকলন ‘মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড আগে’। বইটিতে টক-ঝাল-মিষ্টি ধাঁচের। মাহফুজুল আলম তার বৈমানিক জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এই বইয়ে। সঙ্গে আছে প্রেম আর খুনসুটিতে ভরা ভালোবাসার খন্ডচাঁদ। শিক্ষকের মর্যাদা, বন্ধুত্বের পুরু সীমানার টান, দেশপ্রেম, প্রবাস জীবন, শেকড় এবং পরিবার নিয়ে থাকবে তোলপাড় করা গাঢ় কালির কাব্যরূপ বহরতা।

এছাড়া থাকবে আমেরিকা জীবনের অভিজ্ঞতার এক ভিন্নকথা। আরও না বলা বহু কথার এই বইটি সংগ্রহ করলে পাঠক যে কোনোমতেই চমকে যাবেন না, তা বলতে পারবেন না বলে জানালেন নবীন লেখক মাহফুজুল আলম।

গল্প সংকলন ‘মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড আগে’ বইটি সম্পর্কে এই লেখক বলেন, ‘কখনো দ্রাঘিমাংশের শেষ নীলোৎপল দেখতে বৈমানিক হয়ে ককপিটের ইয়োক ধরেছি। আমেরিকার সুদূর আকাশ থেকে তাকিয়ে থেকেছি মনের গহীনে জমে থাকা শৈশবের বালুচরে। মূল পেশার চেয়ে লেখক হিসেবে পরিচয় পেতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ‘মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড আগে’ গল্প সংকলনটির প্রতিটি গল্প আমার নিজের কিংবা আমার জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু মানুষের হুবহু বাস্তব ঘটনা।’

তিনি বলেন, ‘মাটির মানুষকে আকাশের কবি হতে সেকেন্ড লাগে না। আর আকাশের ইন্সট্রুমেন্টাল মানুষ (বৈমানিক) হয়ে মাটির মানুষের কাছে ফিরে যেতে যথেষ্ট মেধা, ধৈর্য, চৌকস, সময়ের সিদ্ধান্ত ও স্বপ্নহীন একটা বাস্তবিক মাথা ও কলিজা লাগে। কারণ আকাশ চিরে তাকে চলতে হয়। তাই কলমের ছোঁয়ায় সাহিত্য ও টেকনোলজির একটা মিলন আনার চেষ্টা করেছি মাত্র।’

মাহফুজুল আলম বলেন, ‘খড়গের কান ঘেষে খরতার নিঃশেষে পেচিয়ে ওঠা স্বপ্নেরা নিঃশেষ হয়, কিন্তু সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের প্রয়োজন ফুরায় না। আমার কলম ধরার জাদুকর আমার বাবা মো. আমীর হোসাইন শিকদার ও ছটফট করা ভালোবাসার ডাকনাম আমার জন্মদাত্রী মা, যাঁদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। যাঁর কথায় সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি, তিনি আমার বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক শ্রী কবিকূসুম রায় চক্রবর্তী।’

তিনি আরও বলেন, ‘বেড়ে বেড়ে কখনোই অসাধারণ হতে চাই না বরং মিহি হয়ে মিলিয়ে থাকতে চাই সবার সঙ্গে সাধারণ হয়ে। সম্মোহিত জন্মভূমির ঋণ শোধ দেওয়ার অনুভূতি নিয়ে একে একে কলমের আঁচড়ে কাগুজে মলাটে রূপ দিলাম। যে কলমে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুজন নিঃস্বার্থ রক্তীয়জনার ঝরাবাক্যের কথা কয়, যে কলমে মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের চোখে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার দাবি আওড়ায় এবং সেই কলমে দীর্ঘ সময়ে জমে থাকা ডজনখানিক পাণ্ডুলিপির প্রথম এই প্রকাশটি যদি পাঠকপ্রিয়তা পায় তবে কথা দিলাম, ধারাবাহিকতায় আবারও কলম বাড়াবো। আশা করি, বইটি ভালো লাগবে। আর আমার ভালো লাগবে যদি পাঠকদের উৎসাহে আমার মনে কাঁপন ধরে।’

মাহফুজুল আলম ১৯৭৭ সালের ৭ জুলাই বাবার চাকুরিসূত্রে বর্তমান নরসিংদী জেলার পলাশের বাসায় জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক বাড়ি ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থানার বুড়াইচ গ্রাম। তবে বেড়ে ওঠেন আলফাডাঙ্গা উপজেলা সদরের বাড়িতে। তার পিতার নাম শিকদার মো. আমীর হোসাইন এবং মাতা ফিরোজা বেগম। তার শৈশবের শিক্ষা শুরু হয় ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আরিফুজ্জামান সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে।

বর্তমান পেশা বৈমানিক হলেও শুরুতে যোগ দেন বিমান বাহিনীর মেইনটেন্যান্স শাখায়। তিনি সস্ত্রীক আমেরিকা প্রবাসী হন ২০১০ সালে। বর্তমানে তিনি তিন পুত্রসন্তানের জনক। প্রবাসে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রথম যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশি প্রথম বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক হিসেবে আমেরিকার মাটিতে গড়ে তোলেন পাইলট প্রশিক্ষণ একাডেমি। নিজের দেশেও খুলেছিলেন এর একটি শাখা।

মাহফুজুল আলমের স্কুলজীবন থেকেই অভিনয়, কবিতা, আবৃত্তি ও লেখালেখির প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। তবে একটু লাজুক হওয়ার কারণে স্কুলজীবনে নিজ প্রতিভার আলো বিকশিত হতে দেননি। কিন্তু প্রতিভাকে তিনি ঢেকেও রাখতে পারেননি। বিমান বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তার লুকিয়ে থাকা প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে থাকে। ঘাটি পর্যায়ে কবিতা আবৃত্তি, উপস্থাপনা ও অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার পাশাপাশি একজন নিয়মিত আবৃত্তিকার ও উপস্থাপক হিসেবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে এবং বাংলাদেশ বেতারের ‘দূর্বার’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। প্রবাসী হওয়ার আগ পর্যন্ত এ ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। নিয়মিত আর্টিক্যাল লিখতেন পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘ঢাকা টাইমস’, মিলান বার্তা (ইউরোপ), বিডি ইউরোপ টোয়েন্টিফোর ডটকম (ইতালী), বাংলা স্ট্যাটমেন্টসহ (লন্ডন) আরও কিছু পত্রিকায়।

দূর প্রবাসে থেকেও জন্মভূমির জন্য মন কেঁদে ওঠে মাহফুজুল আলমের। স্মৃতির পাতায় বারবার ফিরে আসে দেশে থাকা স্বর্ণময় দিনের প্রতিচ্ছবি। শৈশবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সময়গুলো ফিরে পেতে চান সময়েরই ভিড়ে। এই ফিরে পাওয়ার আগ্রহ থেকেই সংযুক্তি ঘটে অনলাইন জগতের লেখালেখিতে। ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তায় তথ্যচিত্রের আড়ালে কণ্ঠ ও সঞ্চালক হিসেবে নিজেই গড়ে তোলেন ‘আলফাডাঙ্গা লেখক সমাজ’, পরবর্তীতে ‘শব্দধারা’র মত জনপ্রিয় ও স্বচ্ছ সাহিত্যচর্চার একটি অনলাইন প্লাটফর্ম। যা প্রবাস থেকে নিজেই পরিচালনা করে থাকেন।

প্রবাসে আড়ালে থাকা মানুষটি নিজ মাটির টান ও প্রতিভাগুণে হয়ে ওঠেন বাংলার সাহিত্য রসিক। লিখতে শুরু করেন স্কুল জীবনের বর্ণিল দিনের গল্প। তার লেখা পাঠকদের কখনো কাঁদিয়েছে, আবার কখনো মৃদু স্মৃতির ঝলকানিতে হাসিয়েছে। এ পর্যন্ত তার লেখা প্রবন্ধ সংখ্যা প্রায় পঁচিশটি। জনপ্রিয়তায় থাকা প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে ‘বাংলা বানানে প্রচলিত ভুল’, ‘বিশ্বাস করুণ আমার দাড়ি থাকলেও আমি জঙ্গি নই’, ‘চিত্তের সামনে বিত্ত যখন ভৃত্য’, ‘নিজে কী করছেন?’, ‘বেরসিক পাঠক ও সিঙ্গাড়ার গল্প’, ‘এঁটো হাতের পেছনের গল্প’ ইত্যাদি।

ছোট গল্পকার হিসেবে মাহফুজুল আলম সবচেয়ে সফল। প্রায় শতাধিক ছোট গল্প উঠে এসেছে তার কলমে। একাধিক জনপ্রিয় ছোটগল্পে তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন তার জনপ্রিয়তা। যার মধ্যে রয়েছে বকশিস, ভরা বর্ষার শ্রোতের, কোনো এক মায়ের খোঁজে, ছোট্ট হাতের অনামিকা, সখী ভালোবাসা কারে কয়?, কাকীমা, প্যাসেঞ্জার লাউন্সে, যে গল্পে প্রাণ ছিল, এক দিনের ছিন্নপত্র, বাবা একটি প্রশ্ন করবো?, এরপর যা হলো, একটি নিঃশব্দের গল্প, ছোট্ট হিরো, কাব্য জলসা নৈবেদ্য, প্রবাস জীবনের কান্না, এক জোড়া চুড়ির প্রতিবিম্ব, সে আবেদন পত্রে যা ছিল না, আমার আর ভালো হয়ে থাকা হলো না, অঙ্কুরিত বাবার চোখে, মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড আগে, শেকড় ইত্যাদি।

এমনকি সিরিজ আকারে গল্পতেও মাহফুজুল আলম প্রাণ দিয়েছেন সমান ভাবে। যেমন- আমার হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি (পর্ব ১ হতে ১৭), ভাইয়া (পর্ব ১ হতে ৪), আমারও তো দিন কেটে যায় (পর্ব ১ হতে ৪), বাবা (পর্ব ১ হতে ৩), সম্পর্ক (পর্ব ১ হতে ২৩ এবং চলমান..) ইত্যাদি।

মজার বিষয় হচ্ছে- তার কলমে গল্প, প্রবন্ধ বা যেকোনো লেখাই উঠে আসুক না কেন, সেটা সত্যি সত্যিই তার নিজের বা খুব কাছের কারও না কারও জীবনের হুবহু বাস্তব গল্প। তিনি বারবার প্রতিফলিত করেন তার জন্মভূমিকে ঘিরে থাকা সকল স্মৃতি।

কবিতা দিয়ে তার কলমের হাতেখড়ি হয়েছিল। তার লেখা অসংখ্য কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কবিতা যেমন- আঁচল, মুক্তি যুদ্ধোত্তর প্রজন্ম আমরা, প্রতিজ্ঞা, আমার সৃজন গাঁয়, একাকিত্বের সুখ, আমি যখন লাশ, কেবল পহেলা বৈশাখ, গ্রামের ছেলে, ছোট্ট প্রবাস, কাউকে তো বদলায়, কর্মজীবী নারী, না দেখা আভাসে, লক্ষী, অভুক্তের উৎসবে, ছুটি, ভ্রষ্টতার বিচারে, একদিন দেখবি, ধর্ম ভীরুর গান, নারীমঞ্চ, আমি মরিনি, বাবা আছে ইত্যাদি।

সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে তার কলমে উঠে এসেছে সংবাদ, জীবনী, সমসাময়িক বিষয়, বহির্বিশ্বের তথ্য, সমালোচনা ও প্রতিবেদন। আন্তর্জাতিক কলামে নিয়মিত শিরোনাম হয়ে উঠে এসেছে তার সে সকল লেখা। যেমন- রোহিঙ্গা সমস্যা ও বাংলাদেশ: সুস্পষ্ট অবস্থান (পর্ব আকারে), বিশ্ব রাজনীতির ত্রিমুখি সংঘর্ষ ও আমেরিকা, কাছ থেকে দেখা আমেরিকার নির্বাচন, ত্রিমাত্রিক সমীকরণ: বিশ্বযুদ্ধসহ বহু আলোচনায় থাকা বিশ্বচিত্র।

একই সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপটে লিখেছেন বিদ্যুৎ বিভ্রাটে সামাজিক জাগরণ চাই, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও সমাধান, হিন্দু ও মুসলিম কি কখনো ভাই হয়?, আমি নবীন মুখপাধ্যায়সহ জনসচেতনতামূলক অসংখ্য লেখা।

আমার ছোটবেলার খেলা, মরার আগে কয়ডা ভাত দে, প্রতিজ্ঞা, আঁচল, বাবা আছে এমন বহু স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি ও কবিতা সমগ্র ইউটিউবে দিয়েছে অনন্য রকম উপহার। ‘মরার আগে কয়ডা ভাত দে’ কবিতাটি নিজে আবৃত্তি করে মিলিয়নের অধিক ভিউয়ের মাধ্যমে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে গেছেন কয়েকদিনের মধ্যেই। এছাড়া তার স্বরচিত প্রচুর কবিতা আবৃত্তি রয়েছে অনলাইনে, যা শ্রোতামুগ্ধ হয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/০৮ফেব্রুয়ারি/এমআই/এজে)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :