ক্যানসারের ঝুঁকি কমে প্রতিদিন চা পান করলে
সারা বিশ্বে প্রতিদিন ৩৭০ কোটি মানুষ কাপ চা পান করেন। সকালে এক কাপ চা না খেলে দিনটি যেন ভালোই কাটে না। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে কাজের ফাঁকে কিংবা অবসর কাটাতে এক কাপ চা না হলে ঠিক মানায় না। শীতে উষ্ণতা পেতে এক কাপ গরম চায়ের তুলনা নেই। মানসিক চাপ হোক বা কাজের চাপ, বিধ্বস্ত লাগলেই চায়ের প্রতি ভরসা করেন অনেকে।
চা পান করা দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যার জন্য একটি টনিকের মতো। সবুজ, সাদা বা কালো চা কিংবা দুধ চা হোক, এই সতেজ পানীয়টির বেশ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য রক্ষা থেকে শুরু করে হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি সবই করতে পারে চা। চা পান কয়েকটি নির্দিষ্ট ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে এবং সেই কারণে এটিকে ক্যানসার-বিরোধী পানীয় হিসাবেও অভিহিত করা হয়। কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে নিয়মিত চা পান করেন যারা তাদের নির্দিষ্ট ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি কম থাকে।
চা মূলত: তৈরি করা হয় ক্যামেলিয়া সিনেসিস নামের চিরহরিৎ গুল্ম থেকে। এই ছোট গাছের পাতা এবং পাতার কুঁড়ি সংগ্রহ করে এর থেকে চা উৎপাদন করা হয়। সচরাচর ব্ল্যাক টি বা র' চা, গ্রিন টি বা সবুজ চায়ের মতো বিভিন্ন ধরনের নাম শোনা গেলেও তা মূলত এই উদ্ভিদ থেকেই ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে, পদ্ধতিতে বা পরিস্থিতিতে চাষ করা হয়ে থাকে।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় লক্ষ্য করেছেন, কম মাত্রায় ব্ল্যাক টি সেবন করলে মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যারা দিনে ২-৩ কাপ চা পান করেন তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা, যারা একদমই চা পান করেন না তাদের থেকে ৯-১৩ শতাংশ কম। এই গবেষণাটি মূলত যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথের একটি শাখা, ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।
গবেষকরা দেখেছেন যে, যারা দিনে ২-৩ কাপ চা পান করেন তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা, যারা একদমই চা পান করেন না তাদের থেকে ৯-১৩ শতাংশ কম। আবার অতিরিক্ত পরিমাণে চা পান করলে কার্ডিও ভাস্কুলার সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার সাথে ইস্কেমিক হার্টের সমস্যা এবং স্ট্রোকও হতে পারে।
অ্যানালস অফ ইন্টারনাল মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত এই সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই নিয়মিত চা পান করেন। তবে যারা মূলত ব্ল্যাক টি সেবন করেন তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।
চা পানের ফলে জেনেটিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মেটাবলিজম হারও প্রভাবিত হয়। এনআইএইচ-র সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, চা তৈরীর সময় প্রয়োজনমত তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা, চায়ের সাথে দুধ বা চিনি মেশানো ইত্যাদি মানবদেহে ক্যাফিন মেটাবলিজমের হারকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে।
আমাদের শরীরে সব সময় নানা রকম রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছে, যা বিপাক বা মেটাবলিজম নামে পরিচিত। এটা অভ্যন্তরীণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই বিপাক ক্রিয়ার ফলে অথবা দূষিত রাসায়নিক পদার্থ, গুরুপাক খাদ্য, ধূমপান, পরোক্ষ ধূমপান প্রভৃতি কারণে অস্থিতিশীল একক অক্সিজেন পরমাণু তৈরি হয়। এরা হলো ‘মুক্তমূলক’ বা ফ্রি র্যাডিক্যালস। এই অক্সিজেনমূলক বা ফ্রি র্যাডিক্যালগুলো দেহের ভেতর কিছু উপকারী ভূমিকা পালন করে, কিন্তু যদি এদের সংখ্যা খুব বেড়ে যায়, তাহলে শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। কারণ, এদের উপস্থিতিতে দেহের কোষ বিনষ্টকরণের হার বেড়ে যায়। তখন দেখা দিতে পারে নানা রকম অসুস্থতা। এগুলোর মধ্যে ক্যানসার একটি। তাই দরকার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। চায়ে আছে পলিফেনল, যা অতি উৎকৃষ্ট মানের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে (পৃ. ১১৩-১১৪)। ফ্রি র্যা ডিক্যালগুলোকে প্রশমিত বা নিষ্ক্রিয় (নিউট্র্যালাইজ) করতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলো কাজ করে।
গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে জারণের ফলে ফ্রি র্যাডিক্যাল দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত কোষসমূহের মাধ্যমেই ক্যানসার সৃষ্টি হয়। এক হিসাবে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে মানবদেহেও একটি কোষের ডিএনএ প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার জারণ-আঘাত (অক্সিডেটিভ হিটস) প্রাপ্ত হয়। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এসব আঘাতের ফলে ক্ষতির আশঙ্কা কমিয়ে ক্যানসারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
চায়ে আছে এপিগ্যালোক্যাটেচিন-গ্যালেট (ইজিসিজি) নামের এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, যা খুব কার্যকর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। ভিটামিন সি এর চেয়ে ১০০ গুণ বেশি ফলদায়ক। এটা কোষের ডিএনএকে এমনভাবে সুরক্ষা দেয়, যেন ক্যানসারের প্রভাবে এর রূপান্তর না ঘটে।
প্রতিদিন এক-দুই কাপ কালো চা বা সবুজ চা পান করি, তাহলে ক্যানসারের আশঙ্কা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। অন্য অনেক উপকার তো আছেই।
চায়ে আছে ফাইটোকেমিক্যালস। এটি হাড় শক্ত করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যারা চা পান করেন না তাদের তুলনায় চা পানকারীদের হাড় বেশি মজবুত থাকে। গ্রিন টি দাঁতের জন্য ভালো। এতে আছে ফ্লুরাইড ও ট্যানিন নামক উপাদান। এটি দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে।
চায়ের উপাদানগুলোর মধ্যে ৭ শতাংশ আছে থিওফাইলিন ও থিওব্রোমিন। শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির জন্য এগুলো অনেক উপকারী। চা এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হলেও এতে রয়েছে ক্যাফেইন নামক উত্তেজক পদার্থ। সাধারণত এক কাপ চায়ে রয়েছে প্রায় ৩০-৪০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন। ক্যাফেইনের কারণেই ঘুম কম হওয়া, হজমে ব্যাঘাত ঘটা ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তবে এই ক্যাফেইনের কিছু ভালো দিকও রয়েছে। এটি হৃৎপিণ্ড ও দেহের অন্যান্য পেশি সতেজ রাখতে সহায়তা করে।
চায়ের মধ্যে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, এবং সাথে সুস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি উপাদান এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকে। ফলে চা পান করলে স্নায়ু আরাম পায়। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আমরা যে ‘স্ট্রেস কন্ডিশন’ বা মানসিক চাপে পড়ে যাই সেখান থেকে আমাদের শরীরের ভেতরে অক্সাইডস নামের এক ধরনের উপাদান সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে, চায়ের মধ্যে থাকে এন্টিঅক্সিডেন্ট। চায়ের মাধ্যমে শরীরে এন্টিঅক্সিডেন্ট প্রবেশ করলে তা অক্সাইডসগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে ব্যক্তি মানসিক চাপ থেকে রেহাই পায় । এছাড়া চা মনকে চাঙ্গা করে, শরীর সতেজ করে এবং কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
চা যে মানুষের স্নায়ুকে শান্ত করে সে বিষয়টি বেশ কিছু গবেষণাতেও পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ভেষজ চা পানকারীদের তুলনায় নিয়মিত চা পানকারীরা তুলনামূলক শান্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়।
এছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন যারা অন্তত তিন কাপ চা পান করেন তাদের হতাশার ঝুঁকি চা পান না করা ব্যক্তিদের তুলনায় ৩৭ শতাংশ কম থাকে। চা মনকে চাঙ্গা করে, শরীর সতেজ করে এবং কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
চা যে কেবল মানসিক চাপ কমায়, তা-ই নয়। বিভিন্ন গবেষণায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও চা পানের উপকারিতার দিকটি উঠে এসেছে।
২০০৯ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিদিন কয়েক কাপ চা পানের ফলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে যায়। চায়ে উপস্থিত অন্যান্য পুষ্টি উপাদানগুলো বিপাকে সাহায্য করে, যা কি না শরীরের ইনসুলিনকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে রক্তের গ্লুকোজকে দক্ষতার সঙ্গে সামলায়। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, রং চা গ্রহণের পর শরীরের কোষ থেকে ১৫ গুণ বেশি ইনসুলিন বের হয়। আর ইনসুলিন পর্যাপ্ত পরিমাণে নির্গত হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
চা পানের আরেকটি উপকারিতা হলো হৃৎপিণ্ডের সুরক্ষা। নেদারল্যান্ডের ১৩ বছরব্যাপী এক গবেষণায় দেখা গেছে, চায়ের মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় এটি কিছু পরিমাণে হৃৎপিণ্ডকেও সুরক্ষা দিয়ে থাকে। প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে নিয়ে করা গবেষণাটিতে দেখা গেছে, দিনে ছয় কাপের বেশি চা পান করা ব্যক্তিদের হৃদরোগের শঙ্কা এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমে যায়।
প্রতিদিন কয়েক কাপ চা পানের ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি সম্ভব। যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালে পাঁচ লাখ চা পানকারীদের নিয়ে করা আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি চা পান করার সঙ্গে মৃত্যুর ঝুঁকি কিছুটা কমে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে।
গবেষণায় বলা হচ্ছে, যারা প্রতিদিন দুই কাপ বা তারচেয়ে বেশি চা পান করেন তাদের চা পান করেন না - এমন লোকদের তুলনায় যে কোনও কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি নয় থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত কম থাকে।