জঙ্গিদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে সিটিটিসি: আসাদুজ্জামান

সিরাজুম সালেকীন, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ৩০ জুন ২০২৪, ২২:৩২
অ- অ+

কোনো না কোনোভাবে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাওয়াদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে কাজ করছে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি)। ডি-রেডিকালাইজেশনের আওতায় দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ৫৪ জনকে এরইমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই সমাজের মূলধারায় ফিরে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। সিটিটিসি সরকারের সহায়তায় তাদেরকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে।

সিটিটিসি বলছে, মাঠ পর্যায়ে জঙ্গিবাদী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাদের বেশি সক্রিয়তা এখন ‘সাইবার স্পেসে। রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং সবই অনলাইনে হচ্ছে। আর এসব পর্যবেক্ষণে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

রাজধানীর গুলশানে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও নৃশংস জঙ্গি হামলার কালো দিবস ১ জুলাইকে সামনে রেখে রবিবার সিটিটিসিপ্রধান মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা টাইমস।

তার কাছে জানতে চাওয়া হয় হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনা নিয়ে সিটিটিসির ভূমিকার ব্যাপারে

ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘২০১৬ সালে ১লা জুলাই দেশের ইতিহাসে ট্রাজেডির দিন। নৃশংসভাবে এদিন হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলার পর গুলশান থানায় যে মামলা হয়েছিল তার দায়িত্ব পায় সিটিটিসি। আমরা সফলতার সঙ্গে মামলার তদন্ত কাজ শেষ করি। ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত পাঁচজন 'অপারেশন থান্ডারবোল্ট' অপারেশনে নিহত হন। পরে হামলার সব মাষ্টারমাইন্ডসহ জড়িত সবাইকে শনাক্ত করা হয়। ঘটনার পর অনেকে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানে নিহত হন এবং আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল।

অনলাইনে জঙ্গিদের দাওয়াতি কার্যক্রম বাড়ছে। সেই কার্যক্রম কতদূর যাচ্ছে বলে মনে করেন। এমন প্রশ্নে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘নব্য জেএমবির সদস্যরা হলিআর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়েছিল। জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। এই জঙ্গি সংগঠন অনেক জায়গায় ছোটখাটো হামলা চালিয়েছিল। সিটিটিসি তাদের নেটওয়ার্ক বিধস্ত করে দিতে সক্ষম হয়েছে। তাদের আস্তানা শনাক্ত, অভিযান পরিচালনা সবই আমরা করেছি। এই সংগঠনটির (নব্য জেএমবি) সর্বশেষ আমির মাহাদী হাসান জন গতবছর তুরস্কে গ্রেপ্তার হন। যার তথ্য দিয়েছিল সিটিটিসি। বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে নব্য জেএমবি। তারপরেও তারা থেমে নেই। তাদের যারা গ্রেপ্তার হয়নি বা বাইরে ছিল তারা সংগঠনটিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। মাহাদী হাসান জনের পর আবার যিনি সংগঠনকে সক্রিয় করার চেষ্টা করেছিল তাকেও আমরা গ্রেপ্তার করেছি। এর বাইরে আনসার আল ইসলাম সংগঠিত হবার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা রিক্রুটমেন্ট করার চেষ্টা করছে। নেত্রকোনায় তাদের যে আস্তানা পাওয়া গেছে; সেখানে অভিযানকালে মনে হয়েছে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে সংগঠিত হওয়ার আগেই আমরা তাদেরকে শনাক্ত করছি। এই মুহূর্তে জঙ্গিবাদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।

২০২১ সালের পরে দেশে কোনো জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেনি। যা আন্তর্জাতিক ভাবেও স্বীকৃত জানিয়ে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ‘জঙ্গিদের নতুন করে হামলা বা সংগঠিত হওয়ার সক্ষমতা এখন নেই। তবে তাদের বেশি সক্রিয়তা ‘সাইবার স্পেসে। সেখানে তাদের রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং সবই অনলাইনে হচ্ছে। এটাকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। আমাদের অনলাইন সার্ভিলেন্স আছে- সেখান থেকে তথ্য নিয়ে আমরা তাদের আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হচ্ছি। বর্তমান যে নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি তাতে মনে করি জঙ্গিবাদ আরও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

জঙ্গিবাদে যারা জড়িয়ে তাদের কী পরিমাণ জঙ্গিবাদ থেকে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে? এমন প্রশ্নে ডিএমপির এই ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনারা জানেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের একটা প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন। যা বাংলাদেশ পুলিশের সন্ত্রাস দমন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ প্রতিরোধ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। যার অন্যতম উদ্দেশ্য দেশব্যাপী জন-সচেতনতা কার্যক্রম তৈরি করা। আরেকটি হলো- ডিরেডিকালাইজেশন। ইতিমধ্যে আমরা এই দুটি কাজ শুরু করেছি। এরইমধ্যে ৫৪ জনকে ডিরেডিকালাইজেশনের আওতায় আনা হয়েছে। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। যারা জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে, প্রাথমিক তথ্য মিলছে তাদেরকে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আনা হচ্ছে। এছাড়া যারা আটক হয়েছে তারা জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় অতীতের আদর্শে অথবা যারা সাজা খেটে বের হচ্ছেন তাদেরকে ডিরেডিকালাইজেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। জেলখানায় দুইটি ব্যাচকে ডি-রেডিকালাইজেশন করা হয়েছে। কাশিমপুর কারাগারে আটজন আটজন করে ১৬ জনকে এই প্রোগ্রামের আওতায় এনেছি। হয়ত জামিন পাবেন বা সাজার মেয়াদ শেষ হতে আরও দুই-একবছর লাগবে তাদেরকেও নিয়ে প্রোগ্রাম করেছি। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি- ইসলামের ভুল ব্যাখা দিয়ে তরুণ যুবকদের বেপথে আনা হচ্ছে। একারণে আমরা প্রথমে ইসলামিক স্কলার্স দিয়ে একটি টিম করেছি। তারা ধর্মের প্রকৃত ব্যাখা দিচ্ছেন। তারা একসময় ভুল বুঝতে পারেন। সবার ক্ষেত্রে আমরা যে শতভাগ সফল হয়েছি তাও না। জঙ্গিদের যারা ধর্মীয় উগ্রোবাদে বিশ্বাস করে তাদের প্রধান সমস্যা দেশের কালচার। তারা মনে করে কালচারকে যদি ধ্বংস করতে পারে তাহলে তারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে তারা কাজ করছে সেটা দ্রুত সফল হবে। যদি জঙ্গিদের হামলার ইতিহাস পর্যালোচনা করা যায় তাহলে দেখা যায়, দেশের প্রথম জঙ্গি হামলা হয়েছিল উদিচির অনুষ্ঠানে। এছাড়া পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে, যাত্রাপালার প্যান্ডেলে, সিনেমা হলে হামলা হয়েছিল। এক্ষেত্রে আমরা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের নিয়ে জঙ্গিদের কাউন্সিলিং করি। জঙ্গিরা দেশের প্রচলিত আইনকে মানতে নারাজ; চ্যালেঞ্জ করে। তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য হলো নিজেদের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করা। তাই কারাগারে শিক্ষা, আইনি বিষয়েও কাউন্সিলিং করা হচ্ছে, যাতে আইনের বাস্তবতা তুলে ধরা হয়।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সর্বশেষ জঙ্গিদের সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিং নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। তারা নিজস্ব বিশ্বাস নিয়ে দিনযাপন করছে। নিজেদের মধ্যে একটা বিশ্বাস ধারণ করেছে। তাদের যেকোনো চিন্তা বাস্তবায়ন করতে ঝুঁকি নিয়ে প্রস্তুত। ত্যাগ, নিজের আত্মহুতি দিতে পিছপা হয় না। একারণে আমরা সাইকোলজিস্ট নিয়োগ করে কাউন্সিলিং করছি। এই সব ধাপগুলো পার হওয়ার পর কাউন্সিলররা সিদ্ধান্ত নেন একজন জঙ্গি ডি-রেডিকালাইজড হয়েছে না আগের মতাদর্শ ধারণ করছে।

আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যারা ডি-রেডিকালাইজড হয়েছে তাদের পুনর্বাসনের জন্য ৫৪ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কাউকে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার ট্রেনিং, দর্জি হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। জীবিকা নির্বাহের জন্য গাড়ি, সিএনজি, ইজিবাইক বা কাউকে কম্পিউটার সেন্টার করে দেওয়া হবে। একজন জঙ্গিকে এই সমাজ ভালোভাবে রিসিভ করেনি। তাদেরকে যদি সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে পারি তাহলে বর্তমানে জঙ্গিবাদ যে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেই ধারা অব্যাহত থাকবে।

অ্যাপস ব্যবহার বিভিন্ন অপরাধ হচ্ছে। সিটিটিসি কি তাদের শনাক্ত করার মতো সক্ষমতা রাখে—জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। নিত্য নতুন অ্যাপস তৈরি হচ্ছে। তারপরেও তো আমরা কাজ করছি।

আদালত চত্বর থেকে ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গির বিষয়ে কোনো আপডেট আছে কি-না জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান বলেন, আমরাই পূর্বে তাদের গ্রেপ্তার করেছিলাম। তাদের অবস্থান শনাক্ত ও ধরতে কাজ করছি। ইতিমধ্যে জঙ্গিদের দুই-একটি আস্তানা শনাক্ত করেছি। তবে দুর্ভাগ্য অভিযানের পূর্বেই তারা স্থান ত্যাগ করেছে। তবে তারা দেশেই আছে, ধরাও পড়বে।

(ঢাকাটাইমস/৩০জুন/এসএস/ইএস)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
দলের জয়ের পর মায়ের মৃত্যুর খবর পেলেন খালেদ আহমেদ
ঘন কুয়াশায় পাটুরিয়ায় ফেরি চলাচল বন্ধ, মাঝ নদীতে আটকা চারটি
ভেঙে পড়েছে গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, পুনর্গঠনে প্রয়োজন ১০ বিলিয়ন
গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নাই : টুকু
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা