যেসব পানীয় ডায়াবেটিসের মহৌষধ, নিয়ন্ত্রণে থাকবে সুগার
সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস খুব প্রচলিত রোগ। মানব দেহে বিভিন্ন কারণে ডায়াবেটিস রোগ হতে পারে। যদি মানব দেহের রক্তের সাথে প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত ইনসুলিন নামক হরমোন সরবরাহ করতে পারে না, তখন রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকেই ডায়াবেটিস বলা হয়। কারো ডায়াবেটিস হলে রক্তে গ্লুকোজ অত্যধিক মাত্রায় বেড়ে যায়। ডায়াবেটিস দুই ধরনের হয়। টাইপ-১ ডায়াবেটিস - যার কারণ হল, প্যানক্রিয়াসের ইনসুলিন উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়া, যা রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস - এই ক্ষেত্রে শরীর ইনসুলিনের প্রভাবে সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেয়, যা ইনসুলিন অসংবেদনশীলতা হিসেবেও পরিচিত।
ডায়াবেটিসের মতো জটিল একটি অসুখকে বশে রাখা খুবই জরুরি। অন্যথায় ধীরে ধীরে কার্যক্ষমতা হারাতে থাকবে কিডনি, চোখ, স্নায়ু সহ দেহের একাধিক অঙ্গ। এমনকী পিছু নিতে পারে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের মতো অসুখ। তাই টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ে একবারে ছেলেখেলা করা চলবে না।
ডায়াবেটিস রোগ এবং রোগের লক্ষণগুলো প্রতিরোধ করতে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। আর সেই সঙ্গে এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন সুষম ডায়েটের। সুগার রোগীদের এমন কিছু পানীয় খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, যার মধ্যে ক্যালরি থাকে না বা খুব কম পরিমাণে থাকে। প্রাকৃতিক উপায়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে যেসব পানীয় তা দেখে নিন। তারপর এগুলোকে ডায়েটে করে দিন জায়গা।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চায়ের শরণাপন্ন হন। কারণ ডায়াবেটিসকে বশে রাখার কাজে চায়ের জুড়ি মেলা ভার। কারণ, এই পানীয়ে রয়েছে অত্যন্ত উপকারী কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। আর এই উপাদান ইনসুলিনের কার্যকারিতা কিছুটা হলেও বাড়াতে পারে। যার দরুন নিয়ন্ত্রণে থাকে সুগার। এ ক্ষেত্রে সাধারণ চা পানের পাশাপাশি ক্যামোমাইল টি, হিবিসকাস টি, আদা চা এবং গ্রিন টি নিয়মিত পান করুন। তাহলেই উপকার পাবেন হাতেনাতে।
ডায়াবেটিসের মহৌষধি কফি। সেরার সেরা একটা পানীয় হলো কফি। এতে রয়েছে ক্যাফিনের ভাণ্ডার। আর এই উপাদান সুগার স্পাইক বা এক ধাক্কায় গ্লুকোজ লেভেল বাড়ার আশঙ্কা কমাতে পারে। তাই তো বিশেষজ্ঞরা ডায়াবিটিসে ভুক্তভোগীদের নিয়মিত কফি খেতে বলেন।
তবে এই পানীয় খেয়ে উপকার পেতে চাইলে এতে চিনি বা দুধ মেশাবেন না। বরং চেষ্টা করুন নিয়মিত ব্ল্যাক কফি পান করার। তাতেই শরীর থাকবে সুস্থ-সবল। এমনকী ডায়াবিটিসকেও অনায়াসে বশে রাখতে পারবেন।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করতে চাইলে দুধের সঙ্গে পাতান বন্ধুত্ব। বিশেষজ্ঞদের কথায়, দুধ হলো একটি সুষম পানীয়। এতে রয়েছে প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন ও খনিজের ভাণ্ডার। যেই কারণে নিয়মিত দুধ খেলে শরীরে পুষ্টির ঘাটতি মিটিয়ে ফেলা যায়। সেই সঙ্গে ব্লাড সুগার লেভেলকে বশে রাখার কাজেও এই পানীয়ের জুড়ি মেলা ভার। তবে অনেকের পেটে দুধ সহ্য হয় না। আপনারা চাইলে বাড়িতে তৈরি টক দই খেতে পারেন। কিংবা ভরসা রাখতে পারেন পনির বা ছানার উপর। তাতেই উপকার পাবেন হাতেনাতে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে লেবুর রসের নেই জুড়ি। এক গ্লাস ঠান্ডা জলে একটা গোটা পাতিলেবুর রস মিশিয়ে নিন। পারলে এতে কিছুটা জিরে, জোয়ান গুঁড়ো মিশিয়ে পান করুন। তাতেই সুগারকে বশে রাখতে পারবেন। সেই সঙ্গে দেহে ভিটামিন সি-এর চাহিদাও মিটে যাবে। যার দরুন কাছে ঘেঁষতে পারবে না ছোট-বড় একাধিক সংক্রামক অসুখ। তবে ভুলেও আবার এই পানীয়ে মিষ্টি বা নুন মেশাবেন না। এই ভুলটা করলে উপকার তো মিলবেই না, উল্টে শরীরের ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল হবে।
ডায়াবেটিসে ভুক্তভোগীরা অনায়াসে সবজি বা চিকেন দিয়ে তৈরি স্যুপ খেতে পারেন। তাতেই দেহে পুষ্টির ঘাটতি মিটে যাবে। দূরে থাকবে সুগার। এছাড়া প্রতিদিন পাতে রাখুন এক বাটি ডাল। এতে উপস্থিত ফাইবারও সুগার নিয়ন্ত্রণে দারুণ কাজ করে।
ডায়াবেটিস রোধে করলার জুস ম্যাজিকের মতো কাজ করে। কারণ করলাতে ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি এর সাথে প্রচুর আয়রনও রয়েছে। করলার রসে রয়েছে পলিপেপটাইড-পি, যা ইনসুলিনের মতো কাজ করে এবং শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। করলা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়।
তরমুজের রস প্রোটিন, ফাইবার এবং কার্বোহাইড্রেটসহ অনেক পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। এটি ভিটামিন এ এবং ভিটামিন সি এর একটি ভাল উৎস। তরমুজ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতা কমাতে সাহায্য করে। এটি ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতা বাড়ায়, বিপাক বাড়ায় এবং ত্বকের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। এটি শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে পালং শাকের জুস পান করতে পারেন। পালং শাকের জুসে স্টার্চ ছাড়া সবুজ শাকসবজিতে কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স থাকে, যার কারণে ব্লাড সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। পালং শাক খনিজ, ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, ফাইবার এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন সমৃদ্ধ। এটি পটাসিয়ামের একটি ভাল উৎস, যা হৃদরোগ, রক্তচাপ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। স্বাদে মিষ্টি, কিন্তু সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
নিয়মিত গাজরের জুস পান করলে সুগার লেভেল বাড়ে না এবং শরীর অনেক উপকার পায়। এছাড়া গাজরে বিভিন্ন খনিজ, ভিটামিন এবং ক্যারোটিনয়েড রয়েছে, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে এবং চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। তবে এই জুস অতিরিক্ত খাওয়া উচিত নয়।
আদার রস ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বেশ কার্যকর। এটি আপনার চিনির স্তরকে দীর্ঘ সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। শুধু এটিই নয়, এটি ডায়াবেটিসের কারণে চোখের ক্ষতি থেকেও আপনাকে রক্ষা করে। এর জন্য যা করতে হবে তা হল, গরম পানির সঙ্গে লেবু ও আদার রস করে পান করতে হবে। এই পানীয় ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণের পক্ষে উপকারী হবে।
ডাব বা নারিকেল পানি ডায়াবেটিসের সময় বেশ উপকারী হতে পারে। নারকেল পানিতে কেবল ৯৪ শতাংশ পানি রয়েছে। এটি একটি কম ক্যালোরিযুক্ত পানীয়। এতে পটাশিয়াম, বি ভিটামিন, ইলেক্ট্রোলাইটস, অ্যামিনো অ্যাসিড, এনজাইম এবং অন্যান্য পুষ্টি রয়েছে। ডায়াবেটিস রোগীরা ডাব বা নারকেল পানি খেতে পারেন।
আমলার জুস সুগারের জন্য খুবই উপকারী । আমলা ভিটামিন সি এর একটি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এটি ক্রোমিয়ামেরও একটি ভাল উৎস। এই খনিজটি কার্বোহাইড্রেট বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে এবং চিনির মাত্রা বৃদ্ধি রোধ করে। আমলার রস হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং হজমে সাহায্য করে। এটি লিভার এবং কিডনির স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।
ডায়াবেটিসের জন্য দুই চামচ আপেল সিডার ভিনেগার পানি খুবই উপকারী। কারণ আপেল সিডার ভিনেগারে একটি অ্যান্টিগ্লাইসেমিক প্রভাব রয়েছে। এগুলো ছাড়াও এতে অ্যাসিটিক অ্যাসিড রয়েছে যা লিভারে উপস্থিত গ্লাইকোলাইসিস পরিবর্তন করতে পারে। আপেল ভিনেগারের এই বৈশিষ্ট্যগুলো ডায়াবেটিসে আপনার জন্য উপকারী।
তবে শুধু ডায়েট করে ডায়াবেটিসকে বশে রাখতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম হলো মাস্ট। এই সময়টুকু বাড়িতে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে পারন, সাইকেল চালাতে পারেন কিংবা পারেন হাঁটতে। তাতেই অনেক উপকার পাবেন।
(ঢাকাটাইমস/৭ সেপ্টেম্বর/আরজেড)