অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যত চ্যালেঞ্জ

আলী রেজা
  প্রকাশিত : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০২
অ- অ+

অনেকেই মনে করছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলার সময় এখনো আসেনি। এ কথাটির যুক্তি আছে। তবে এ কথাও মানতে হবে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করেছেন। সিদ্ধান্তহীনতা কিংবা বিলম্বিত সিদ্ধান্তের কারণে অনেক ক্ষেত্রে জানমালের ক্ষতি হয়েছে। এখনো জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী অনেক ঘটনা ঘটছে। নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ না হওয়ার কথা শোনা গেছে খোদ উপদেষ্টাদের মুখ থেকেই। পুলিশ প্রশাসন ও সিভিল প্রশাসন এখনো সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। বিভিন্ন দপ্তরে রদবদল, বদলি, অপসারণ, পুনর্বাসন করা হচ্ছে। তবে মাঠ প্রশাসনের গতি ফিরিয়ে আনতে সময় লেগেছে। মাঠ প্রশাসন গতিশীল না হলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন।

সরকার নিজের তরফ থেকে সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সরকারের গতি অনেকটাই মন্থর বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। ফলে যত দ্রুত আশা করা হচ্ছিল তত দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরে আসছে না। সরকার পতনের দিন থেকেই মব জাস্টিস ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সারা দেশে ভাঙচুর ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষের বিজয়োল্লাসকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বলে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এর লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। ফলে এখনো মব জাস্টিসের শিকার হচ্ছেন অনেকে। অনেকে মব জাস্টিসের শিকার হওয়ার আশঙ্কায় আতঙ্কিত জীবনযাপন করছেন। এখন সবার আগে সরকারকে জনমনের এ আতঙ্ক দূর করতে হবে। আতঙ্ক শুধু জনমনে নয়, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরেও আতঙ্ক বিরাজমান। স্পষ্টতই এসব মব জাস্টিসের আতঙ্ক। সে কারণে মব জাস্টিস নিয়ন্ত্রণ করা এখন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ।

মব জাস্টিসের পাশাপাশি জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে বলা না হলেও সারা দেশে বিষয়টির পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করা প্রয়োজন ছিল। মাজার ভাঙচুর ইস্যুটিও জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ফলে সরকার পতনের পর স্বস্তি পাওয়া অনেকেই এখন বলতে শুরু করেছেন, যে রকম আশা ছিল সে রকম হচ্ছে না। তাদের ক্রমশ আশাহত হয়ে যাওয়ার কারণ হলো তারা সরকার ও প্রশাসনকে যেভাবে দেখার স্বপ্ন দেখেছিলেন সেভাবে দেখতে পাচ্ছেন না। এর জন্য অবশ্য নানা প্রতিকূলতাকে দায়ী করা চলে। আওয়ামী লীগ সরকার যে প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করেছিল সে প্রশাসনিক কাঠামোয় দাঁড়িয়ে কাজ করা বর্তমান সরকারের পক্ষে সহজ নয়। ফলে অনেককিছুই ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন হয়েছে। তবে ‘বিগত সরকার সবকিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে’ এ ধরনের আম বয়ান আবেগতাড়িত অবস্থায় পুরোপুরি সমর্থন করা গেলেও আবেগ কেটে গেলে পুরোপুরি সমর্থন করবেন না অনেকেই। ফলে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রসঙ্গ উঠলে অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরঙ্কুশভাবে সমর্থন করেন এমন অনেকেই তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন।

জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে কথা উঠেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ সে কথার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। সারা দেশে মাজার ভাঙার তাণ্ডব, ভিন্ন মতাবলম্বিদের হেনস্থা করা বর্তমান সরকারের এজেন্ডা নয়। বর্তমান সরকার এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও এসব চলছে। কেউ এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস করছে না। এর কারণ মব জাস্টিসের ভয়। মব ট্রায়াল বা মব জাস্টিস একটি দেশের বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল ও ভঙ্গুর হিসেবে প্রতিপন্ন করে তোলে। জনগণ যখন বিচারের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয় তখন প্রচলিত বিচারব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ে। মব জাস্টিসের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো এখানে গুজবে কান দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত থাকার সম্ভাবনা থাকে। এখানে সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না কিংবা সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির হওয়ার আগেই বিচার হয়ে যায়। মব জাস্টিস বা জনতার বিচার তাই একটি দেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থাকে আস্থাহীনতার জায়গায় নিয়ে যায়। সব দেশেই বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের পর ব্যাপক আকারে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে, যা নিয়ন্ত্রণ করা বিপ্লব পরবর্তী সরকারের জন্য একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে খুব দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসে যেত। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সফলভাবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি বলেই মনে করছেন সুধীসমাজ। আর একটি কথা মানতেই হবে যে, যাদের দ্বারা এ নিয়ন্ত্রণের কাজটি করার কথা সেই পুলিশ বাহিনীই ৫ই আগস্ট ও তৎপরবর্তী সময়ে সবচেয়ে নৃশংস মব ট্রায়ালের শিকার হয়েছে। এখনো পুলিশ বাহিনী পুরোপুরি সে ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে থানাগুলো স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করেছে বটে, কিন্তু মানুষ এখনো কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে না। ৫ই সেপ্টেম্বর থেকে সেনাবাহিনী মাঠে আছে এবং গত ১৮ই সেপ্টেম্বর থেকে দুই মাসের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পেয়েছে। শুরু থেকেই সেনাবাহিনীকে এ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো বেশি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল। একটু দেরিতে হলেও সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার ফলে আশা করা যায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি ঘটবে। মব জাস্টিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও এ পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বিগত সরকারের ন্যায় বর্তমান সরকারের কাছেও জনগণের প্রত্যাশা হলো দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। বাজার সিন্ডিকেটের কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়- অতীতে এমন কথা শোনা গেছে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে। বর্তমান সরকার বাজার সিন্ডিকেটের কালো হাত ভেঙে দিয়েছেন বলেই জনগণ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায়ীরা অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছে। অনেকে গ্রেফতার হয়েছে। এতে করে জনগণ আশা করেছিল খুব দ্রুতই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য কমে যাবে। কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী দ্রব্যমূল্য কমেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা বেড়েছে বলেও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হতে দেখা গেছে। অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যাওয়া দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে দেড় মাস খুব কম সময় নয়। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বর্তমান সরকার যত তাড়াতাড়ি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে ততই জনদুর্ভোগ কমে আসবে। সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার সবচেয়ে বড়ো উপায় হলো দ্রব্যমূল্য, বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের মূল্য কমিয়ে আনা। বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য আর একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ।

রাষ্ট্র সংস্কার বর্তমান সরকারের একটি প্রধান এজেন্ডা। শুধু সরকারের নয়, ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষাও এটি। এ কারণেই জনপ্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার ইতোমধ্যেই ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। এতে সরকারের কাজের একটি রোডম্যাপ পরিষ্কার হয়েছে। শুরু থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের কাছে এ ধরনের একটি রোডম্যাপ আশা করছিল। ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠেনের ফলে ছাত্র-জনতার দাবি অনুসারে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি শুরু হলো বলা যায়। তবে এর পরিধি বাড়াতে হবে বলে মনে হয়। যে ছয়টি ক্ষেত্রে কমিশন গঠন করা হয়েছে সেগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র আছে যেগুলোর সংস্কার জরুরি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে কমিশন গঠনের দাবিও উঠেছে। সে অনুযায়ী আরো কিছু কমিশন গঠন করা যেতে পারে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন তিন মাসের মধ্যে কমিশনগুলো সংস্কার কাজের রিপোর্ট পেশ করবেন। এখন সারা দেশের মানুষ সেদিকেই তাকিয়ে থাকবে। এই বেঁধে দেওয়া তিন মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রসমূহে প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা বর্তমান সরকারের জন্য আরো একটি চ্যালেঞ্জ।

আশার কথা হলো দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও সূধীসমাজ- সবাই এই সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে রাজি আছে। তার মানে এই সরকারের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রত্যাশার জায়গাগুলো আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। সংস্কার কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য কমিশন গঠনের পাশাপাশি উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সংখ্যাও বাড়ানো যেতে পারে। সরকারের যতগুলো মন্ত্রণালয়/বিভাগ আছে ততজন উপদেষ্টা নিয়োগ করা হলে সামগ্রিকভাবে কাজের গতি বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে কাজের গতি থমকে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত- প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষা কার্যক্রম থেমে গিয়েছিল। প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ ব্যাপকভাবেই পদত্যাগ করেছিলেন। সেসব পদে প্রক্রিয়া অনুযায়ী নিয়োগ সম্পন্ন করতে সময় লেগেছে। অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়নি।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা ছিল একটি কঠিন কাজ। বর্তমান সরকার সে বিষয়টি দক্ষতার সঙ্গেই করতে পেরেছেন বলা যায়। দেশের প্রধান অর্থনৈতিক খাত পোশাক কারখানায় অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছিল। দফায় দফায় অনেক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পোশাক শিল্পের সে অচলাবস্থাও কাটিয়ে উঠেছে সরকার। তবে সম্ভাব্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। পোশাক শিল্পের উৎপাদন চলমান রাখাও বর্তমান সরকারের জন্য একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান মানুষের মনে নতুন স্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছে। এ স্বপ্নকে বাস্তবরূপ দিতে হলে সরকারকে যুগান্তকারী কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে রদবদল ও পুনর্বাসন করেছে। এ প্রক্রিয়া চলমান রাখাটা জরুরি। পেশাজীবীদের অনেক দাবি সামনে চলে এসেছে। এসব দাবির যৌক্তিকতা যাচাই করে যতটুকু পূরণ করা সম্ভব তা করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের ফসল হিসেবে বর্তমান সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা এই সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার যোগ্যতা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে- এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।

আলী রেজা: কলাম লেখক, কলেজ শিক্ষক ও গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
যানজটে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা, পায়ে হাঁটা ও সাইকেল চালানো হতে পারে সমাধান
বন্ধুর চিকিৎসা করাতে গিয়ে চিকিৎসকের ছুরিকাঘাতে কলেজ ছাত্রের মৃত্যু 
বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় শীর্ষে ঢাকা, বায়ুমান কেমন রাজধানীর?
দেশের সাত অঞ্চলে সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ের আভাস
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা