কুয়াকাটায় হুমকির মুখে রাখাইনদের অস্তিত্ব

প্রণোদনার ঘর ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের হিড়িক

আব্দুল কাইয়ুম, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি
  প্রকাশিত : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭:১৫| আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭:২১
অ- অ+

পটুয়াখালীর পর্যটন নগরী কুয়াকাটায় রাখাইনদের মগন সম্পত্তিতে সরকারের দেয়া প্রণোদনার ঘর ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কুয়াকাটা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই নির্মাণকাজ চলছে একাধিক বহুতল ভবনের। এতে হুমকির মুখে পড়েছে কুয়াকাটার অলংকার খ্যাত রাখাইন ভাষা-শিক্ষাসহ ২৩০ বছরের পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাখাইনদের কাউকে কাউকে হাত করে এবং শেয়ারে প্রলুব্ধ করে কুয়াকাটার কেরানীপাড়ায় বহুতল ভবন নির্মাণ পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে প্রভাবশালীরা।

আদিবাসী রাখাইনদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পৃক্ত কুয়াকাটা কেরানীপাড়া। পর্যটকদের কাছে বিশেষ এক আকর্ষণ রাখাইন সম্প্রদায়ের জীবনচিত্র। প্রতিদিন শত শত পর্যটক কেরানীপাড়া দেখতে আসেন।

জানা যায়, ১৭৯৪ সালে লাখের বেশি রাখাইনের আগমন ঘটে পটুয়াখালীর উপকূল অঞ্চলে। সমুদ্রোপকূল কেন্দ্রিক বনাঞ্চল সাফ করে হিংস্র প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পেতে টংয়ের ঘর বানিয়ে বসবাস শুরু করেন তারা।

বন্য প্রাণীর সঙ্গে লড়ে বেড়ে ওঠা এই রাখাইন জাতি-গোষ্ঠী কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের জঙ্গল কেটে প্রথমে আবাদি জমির আত্মপ্রকাশ ঘটান বলে তাদের দাবি। তবে বর্তমানে কুয়াকাটা উপকূল এলাকার পার্শ্ববর্তী অন্যান্য পাড়ার আদি বসতিতে কিছুটা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও কেরানীপাড়া এখন পুরোপুরিভাবে দূরে সরে যাচ্ছে তাদের আদি সংস্কৃতি টংয়ের ঘর থেকে। তোলা হচ্ছে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন।

সরেজমিন জানা যায়, খালেদা জিয়ার সরকারের সময় কেরানীপাড়ায় রাখাইনদের উন্নত জীবনব্যবস্থার জন্য দেয়া হয় প্রণোদনার ঘর। এসব ঘর ভেঙে চলছে বহুতল ভবন নির্মাণ। যেসব ঘর এখনো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো নিয়েও পরিকল্পনা করছে বহুতল ভবন নির্মাণের। আর তাতে অচিরেই কুয়াকাটায় রাখাইনদের অস্তিত্ব বিলীনের আশঙ্কা করছে সচেতন মহল।

রাখাইন সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারের তরফ থেকে যেখানে নেয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ, সেখানে শেয়ারের নামে নির্মাণযজ্ঞ চলছে অসংখ্য বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। এ নিয়ে রাখাইনদের একাংশ, স্থানীয় বাসিন্দা এবং সচেতন মহলের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

রাখাইনদের অভিযোগ, কালের বিবর্তনে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে অনেক রাখাইন ইতোমধ্যে কুয়াকাটা উপকূল অঞ্চল ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এখন মাত্র কয়েক হাজার রাখাইন অঞ্চলে টিকে আছে। যেসব রাখাইন উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাস করছে তারাও নানা হুমকির মধ্যে রয়েছে।

কুয়াকাটা কেরানীপাড়ার রাখাইনদের ভাষ্যমতে, কেরানীপাড়ার আওতাধীন জমির দখল নিতে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা কতিপয় লোভী রাখাইনের সাথে মিলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই ২৩০ বছরের সংস্কৃতি-ইতিহাস বহন করা কুয়াকাটার রাখাইন সম্প্রদায়সহ কেরানীপাড়া নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

তারা আরও বলছেন, প্রতিদিন শত শত পর্যটক কেরানীপাড়া দেখতে আসেন। এই পাড়া বিলুপ্ত হলে প্রভাব পড়বে কুয়াকাটার পর্যটনে।

রাখাইনরা কেন দূরে সরে যাচ্ছে তাদের আদি সংস্কৃতি থেকে, জানতে চাইলে স্থানীয় রাখাইন মংওয়েং (৬৪) বলেন, ‘এই পাড়া থেকে রাখাইনদের বিতাড়িত করার জন্য একটি প্রভাবশালী চক্র তৎপরতা চালাচ্ছে। বিশেষ করে কুয়াকাটার প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় এখানে জমির গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এসব জমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিজের দখলে নেওয়ার জন্য কতিপয় লোভী রাখাইনকে ফাঁদে ফেলছে।’ সময়ের ব্যবধানে এসব বিনিয়োগকারী মগন সম্পত্তিতে তোলা বহুতল ভবনের বিনিময়ে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে রাখাইনদের এই পাড়া থেকে বিতাড়িত করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

মংওয়েং বলেন, ‘তবে আমাদের মগন সম্পত্তিতে পাড়াপ্রধান এবং পাড়ার সবার সমন্বিত পূর্বানুমতি ছাড়া কোনো স্থাপনা নির্মাণ করার বিধান না থাকলেও এসব বহুতল ভবন তোলা হচ্ছে। আমাদের রাখাইনদের এসব আদি নিদর্শন, ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ উদ্যোগ নিলেও তা এখন অতিলোভী কতিপয় রাখাইনের কারণে ভেস্তে যেতে বসেছে।’

বিষয়ে কেরানীপাড়ার রাখাইন জনগোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলন কর্মী লুমা মগনী আক্ষেপ করে বলেন, ‘পাড়ার এই জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অনেকে পেটের দায়ে আপস করছে। তবে আমাদের পাড়ার সম্পত্তিতে অনেক প্রভাবশালী ভুয়া কাগজ বানিয়ে এমনকি নিজস্ব জমিতেও গেড়ে বসেছে। কুয়াকাটা কেরানীপাড়ার আদিবাসী রাখাইনদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।

এ অঞ্চলে রাখাইনদের আগে আর কারও পা পড়েনি বলে দাবি করেন কেরানীপাড়ার রাখাইন নেতা উচাচিং মাতুব্বর। বলেন, বর্তমানে হাতেগোনা কিছু রাখাইন থাকলেও তাও এখন নানা জটিলতায় জর্জরিত।

উচাচিং মাতুব্বর বলেন, কুয়াকাটা উপকূলের এই এলাকার সম্পত্তি একসময় রাখাইনদের মালিকানায় থাকলেও এখন মাত্র সামান্য জমির আওতায় কেরানীপাড়াটি দৃশ্যমান রয়েছে। তবে আমাদের বিধানে বহুতল ভবন নির্মাণের সুযোগ না থাকলেও রুটি-রুজির তাগিদে বাধ্য হচ্ছি।’

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘রাখাইনদের এই আদি বসতিটি পর্যটকদের জন্য এবং পর্যটন শিল্পের জন্য একটি ব্যতিক্রমী সংস্কৃতির জীবনধারা ছিল। সম্প্রতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, ওই পাড়ার রাখাইনদের জমিগুলোতে বিধি বহির্ভূতভাবে চুক্তি করে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। উপজেলা, জেলা প্রশাসন কিংবা বিভাগীয় প্রশাসনের কোনোরূপ অনুমতিও নিচ্ছে না। ইতিমধ্যে তাদের দুটি নোটিশ করা হয়েছে। সেখানে বহুতল ভবন কিংবা হোটেল-মোটেল করার অনুমতি আছে কি না তা সাবমিট করতে বলা হয়েছে।’

(ঢাকাটাইমস/২৫সেপ্টেম্বর/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
গাজীপুরে হাসনাত আব্দুল্লাহর গাড়িতে হামলা, আটক ২ 
পল্লবীতে বিশেষ অভিযানে পেশাদার ছিনতাইকারীসহ ২৬ জন গ্রেপ্তার
হাসনাত আব্দুল্লাহর ওপর হামলার প্রতিবাদে বাংলামোটরে এনসিপির বিক্ষোভ
দীর্ঘস্থায়ী রোহিঙ্গা সংকট অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে পারে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা