চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি নিয়ে যা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা

মো. রাফিউল হুদা, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:৪৮| আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:৫৯
অ- অ+

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩৫ করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন চাকরিপ্রার্থীরা। তাদের দাবির মুখে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত এ-সংক্রান্ত কমিটি ছেলেদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ এবং মেয়েদের ৩৭ বছর সুপারিশ করেছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই সুপারিশ নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা। এই প্রতিক্রিয়াই কি শিক্ষার্থীদের মনের কথা? আসলে বয়সসীমা বাড়ানোর ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক নিয়ে কী ভাবছেন তারা?

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের ভাবনা ও প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন ঢাকা টাইমসের হাবিপ্রবি প্রতিনিধি মো. রাফিউল হুদা।

চাকরির বয়সসীমা ৩৫ করলে দেশের তরুণ সমাজের মেধা শ্রমের অপচয় এবং মানবসম্পদের বড় ক্ষতি হবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মুহিত হোসাইন সরকার। তিনি বয়সষীমা সর্বোচ্চ ৩২ করার পক্ষে।

মুহিত হোসাইন সরকার বলেন, বিভিন্ন দেশে চাকরির কোনো বয়সসীমা না থাকাটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে খাটে না। দেশের যে পরিস্থিতি তাতে বয়স বাড়ালে শুধু সরকারি চাকরির পেছনেই ছুটবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণ সমাজ। এতে যেমন একদিকে সরকারি চাকরিতে প্রচুর প্রতিযোগিতা হবে, অন্যদিকে অধিকাংশ তরুণসমাজ শুধু চাকরির পিছনে নিজেদের একটা বড় সময় নষ্ট করবে। সেটা সে অন্য কাজে ব্যয় করলে নিজের এবং দেশের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনতে পারত

আর সরকারি চাকরিতে নিয়োগ অত্যন্ত সীমিত। এই দেশের সিস্টেমে শুধু গুটিকয়েক চাকরি পাবে আর বাকিরা চাকরির জন্য বছরের পর বছর পড়ে থাকবে। এটা মেধা শ্রমের অপচয় এবং দেশের মানবসম্পদের বড় ক্ষতি বলে আমি মনে করি। তাই সব দিক বিবেচনায় চাকরিতে বয়স সর্বোচ্চ ৩২ থাকা উচিত।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ধরন আর সরকারি চাকরির আনুপাতিক হার হিসেবে ৩৫ বয়সসীমা দেশের জন্য মঙ্গলকর হবে না। এতে বেকারত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তরুণদের মানসিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটাবে। বলছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী বিকাশ চন্দ্র শীল।

বিকাশ চন্দ্র বলেন, দেশের সব তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন থাকে একটা সরকারি চাকরির মাধ্যমে দেশ জাতির একজন অংশীদার হয়ে কাজ করবেন। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ধরন আর সরকারি চাকরির আনুপাতিক হার হিসেবে ৩৫ বছর কখনোই দেশের জন্য মঙ্গলকর কিছু বয়ে আনবে না। এমনিতে দেশে বেকারের সংখ্যা অনেক, তাতে যদি আবার ৩৫ করা হয় তাহলে বেকারত্বের সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে! উন্নত দেশের সাথে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট এক না। আমাদের দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় সরকারি চাকরিতে বয়স ৩৫ করা হলে বেকারত্বের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসিক অবস্থারও অবনতি ঘটবে। তাই মনে করি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করা উচিত হবে না। একান্ত করতেই হলে সেটা ৩২ করা যেতে পারে।

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোরই পক্ষে নন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভাগের শিক্ষার্থী রিদওয়ান রাফি। কারণ এতে অসম প্রতিযোগতা ও বেকারত্বের হার বৃদ্ধি এবং গ্রাজুয়েশন শেষে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের তাগিদ কমিয়ে দেবে।

রিদওয়ান রাফি বলেন,আমি ব্যক্তিগতভাবে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির পক্ষে নই। বয়সসীমা ৩৫ বছর করলেও পদের সংখ্যা বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশে সরকারি চাকরি 'সোনার হরিণের' মতো। সুযোগ পেলে সবাই ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত চেষ্টা করবে। ফলে চাকরিপ্রত্যাশীর সংখ্যা প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে যাবে।

বয়সসীমা বৃদ্ধি পেলেই যে সবাই সরকারি চাকরি পাবে, বেকারত্ব কমে আসবে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। যাদের সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়েছে অথবা বয়স শেষের পথে, সাময়িকভাবে তারা হয়তো উপকৃত হবে আবেদনের উপযোগিতা পেয়ে। কিন্তু ভবিষ্যতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করা শিক্ষার্থী।

অন্যদিকে অবসরের সময়সীমা ৬৫ বছর করা হলে চাকরির পদগুলো খালি হতে অনেক সময় লাগবে। নতুনরা চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক তথ্যে জানা যায়, সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদ ১৯ লাখ ১৫১টি। এর মধ্যে শূন্য রয়েছে লাখ ৭০ হাজার ৪৪৭টি।

আমার মতে, চাকরির বয়সসীমা না বাড়িয়ে পিএসসিসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা দরকার। স্বল্প সময়ে উপযুক্ত পদ্ধতিতে মেধাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শূন্য আসনগুলো পূরণ করা গেলে এই সংকট থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু্টি দিকই দেখছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রবিউল ইসলাম। ইতিবাচক দিকটি হলো, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হবে; উচ্চশিক্ষা, প্রশিক্ষণ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যাবে, যা কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়াবে।

নেতিবাচক প্রভাব হলো, বেকারত্বের হার বেড়ে যেতে পারে। দেশে এখনো অনেক শিক্ষিত তরুণ চাকরির অপেক্ষায়। নতুনদের জন্য প্রতিযোগিতার হার বেড়ে যাবে, কারণ তাদের সঙ্গে মধ্যবয়সী তরুণরা আবেদন করবেন। এতে নতুনদের মধ্যে এক রকম হতাশার সৃষ্টি হতে পারে।

বয়সসীমা বৃদ্ধির ফলে নতুন প্রজন্মের চাকরির প্রতিযোগিতে বৃদ্ধি, সরকারের দীর্ঘমেয়াদী ব্যয় বৃদ্ধি, কাজের সময় কমে আসা, পেনশন সুবিধার চাপ ইত্যাদি অর্থনীতিতে একটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। অবস্থায় সরকারের উচিত পরিবর্তন বাস্তবায়নের আগে অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা, যাতে ভারসাম্যপূর্ণ প্রভাব নিশ্চিত করা যায় এবং একটি সূষম নীতির মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ অক্ষুণ্ন থাকে।

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি যৌক্তিক মনে করেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী রেজাউল করিম নিশাত। তবে তার মতে, ৩৫ নয় সর্বোচ্চ ৩২ বছর করা হলে ভারসাম্যপূর্ণ হবে।

বয়স ৩২ করার যুক্তি হিসেবে রেজাউল করিম নিশাত বলেন, তাতে উচ্চশিক্ষার দীর্ঘ সময় বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য সময় পাওয়া যাবে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে পড়াশোনায় যে ব্যাঘাত ঘটেছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য বয়সসীমা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

আবার তার আশঙ্কা, বয়সসীমা বাড়ালে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে, অধিক বয়সী প্রার্থীদের সঙ্গে তুলনায় নতুন গ্র্যাজুয়েটদের জন্য সুযোগ কমে যেতে পারে। তবে সামগ্রিকভাবে, অধিকাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন যে নীতিগতভাবে বয়সসীমা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ দ্রুততর হওয়া দরকার।

বয়সসীমা বৃদ্ধি চাকরিতে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করবে, তাই বর্তমান বয়সসীমা ৩০ রাখার পক্ষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফ বিল্লাহ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু এবং গবেষণা বা বিশেষজ্ঞ এমন বিভিন্ন পদের জন্য বিভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে।

আমার কাছে মনে হয় বয়সসীমা বাড়ালে চাকরি-পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে। এদিকে চাকরি পাওয়ার আশায় বছরের পর বছর শিক্ষার্থীরা অপেক্ষা করবেন। ফলে রাষ্ট্রে বেকারত্বের হার বেড়ে যাবে। এ ছাড়া নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ কমে যাবে। চাকরিতে একটি অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। তাই সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩০ রাখা উচিত।

তবে, চাকরিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করা যায়। শুধু বয়সের ওপর নির্ভর করে নয়, বরং যোগ্যতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচন করা যেতে পারে। বিভিন্ন পদের জন্য বিভিন্ন বয়সসীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণা বা বিশেষজ্ঞ পদের জন্য বয়সসীমা কিছুটা বেশি রাখা যেতে পারে।

(ঢাকাটাইমস/১৪অক্টোবর/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আমাদের মধ্যে মতানৈক্য দেশটাকে খেয়ে ফেলবে: মির্জা আব্বাস 
নৌপথে অসুস্থ শিশুকে দ্রুত চিকিৎসা সহায়তা কোস্টগার্ডের
পরকীয়ার জেরে পুলিশ সদস্য স্বামীকে হত্যা: স্ত্রীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করল যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ
প্রাণঘাতী গুলি না ব্যবহারের অনুরোধ সায়ানের, পুলিশের কাউন্সিলিংয়ের পরামর্শ নিপুনের
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা