কোন কোন নিয়ম মানলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে

নীরব ঘাতক রোগ ডায়াবেটিস। বর্তমানে নগরায়ণের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাপনের কারণে সারা বিশ্বেই ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে এই বৃদ্ধির হার উন্নত দেশের তুলনায় অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশে বেশি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ডায়াবেটিসের কোনও স্থায়ী নিরাময় নেই। সে কারণেই এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই জরুরি। ডায়াবেটিসের মারাত্মক রূপ শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্তও হতে পারে। ডায়াবেটিস এক ধরনের মেটাবলিক ডিজঅর্ডার। মানুষ যখন খাবার গ্রহণ করে, তখন শরীরের প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন নিঃসৃত হয়। ইনসুলিনের কাজ হলো যে খাবার খাওয়া হচ্ছে সেটির অতিরিক্ত গ্লুকোজ কমিয়ে দেওয়া। যখন ইনসুলিনের উৎপাদন কমে যায় বা ইনসুলিন উৎপাদন হওয়ার পরও যখন কাজ করতে পারে না, তখন শরীরে অতিরিক্ত গ্লুকোজ থাকে। সেই অবস্থাকেই বলা হয় ডায়াবেটিস।
ডায়াবেটিস সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস ও টাইপ টু ডায়াবেটিস।
টাইপ ১ ডায়াবেটিসের চেয়ে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা নিয়ম মেনে চললেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন। তাদের ইনসুলিনের প্রয়োজন হয় না।
টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তখন রক্তের প্রবাহে গ্লুকোজ জমা হতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা এখনও বের করতে পারেনি কী কারণে এরকমটা হয়। তবে তারা বিশ্বাস করেন যে এর পেছনে জিনগত কারণ থাকতে পারে। অথবা অগ্ন্যাশয়ে ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো নষ্ট হয়ে গেলেও এমন হতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ১০ শতাংশ এই টাইপ ওয়ানে আক্রান্ত।
টাইপ ২ ডায়াবেটিস হলো জীবনধারার রোগ। এর জন্য দায়ী হলো ওজন বৃদ্ধি, অস্বাস্থ্যকর খাবার ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা। প্রাথমিক অবস্থায় যদি এটি চিকিৎসা করা না হয় তাহলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে।
টাইপ টু ডায়াবেটিসে যারা আক্রান্ত তাদের অগ্ন্যাশয়ে যথেষ্ট ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না অথবা এই হরমোনটি ঠিক মতো কাজ করে না। সাধারণত মধ্যবয়সী বা বৃদ্ধ ব্যক্তিরা টাইপ টু ধরনের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও যাদের ওজন বেশি এবং যাদেরকে বেশিরভাগ সময় বসে বসে কাজ করতে হয় তাদেরও এই ধরনের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বয়স বেশি হোক বা কম, রক্তে শর্করা এক বার বাড়তে শুরু করলে, তা আটকানো সহজ নয়। নিয়ম করে ওষুধ খেয়ে, চিকিৎসকের পরামর্শে চলেও ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। তখন এমন কিছু রক্ষাকবচ খুঁজে বের করতে হয়, যা সত্যিই ডায়াবেটিসের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম। দৈনন্দিন জীবনের কিছু নিয়ম ডায়াবেটিসের মোক্ষম দাওয়াই। জেনে নিন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানোর টিপস-
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
চিকিৎসকরা জানান, অতিরিক্ত ওজন টাইপ টু ডায়াবেটিসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। স্থূলতা এই রোগকে আরও বৃদ্ধি করে। তাই আপনার শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করা এবং আপনার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
খাদ্যতালিকায় কিছু পরিবর্তন করুন
ডায়াবেটিকদের জন্য মিষ্টি হল বিষের সমান। আপনার খাদ্যতালিকায় প্রথম এবং প্রধান পরিবর্তনগুলির মধ্যে একটি হল চিনি খাওয়া। সাদা প্রক্রিয়াজাত চিনির পণ্যগুলি ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। আপনার ডায়েটে প্রোটিন রাখুন কার্বোহাইড্রেট কমিয়ে অন্তর্ভুক্ত করা। প্যাকেটজাত খাবার এড়িয়ে চলাই ভাল।
দুপুর আর রাতের খাবারে মাছ, মাংস, শাকসব্জি রাখলেই চলে যায়। কিন্তু সবচেয়ে মুশকিল হয় সকালের জলখাবার নিয়ে। সকালের জলখাবারে খাওয়া যায় এমন বহু খাবার ডায়াবেটিকরা খেতে পারেন না। তবে ডায়াবিটিস থাকলে সকালে কী কী খাওয়া যায়, এমন কিছু খাবারের খোঁজ রইল।
অনেকেই সকালে দুধ আর কর্নফ্লেক্স খান, ডায়াবেটিক রোগীদের এটা না খাওয়াই ভাল। কর্নফ্লেক্সের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেকটাই বেশি। তার চেয়ে বরং দুটো হাতে গড়া রুটি কিংবা ব্রাউন ব্রেড খেতে পারেন। ময়দা বা আটার রুটির বদলে রাগি বা বাজরার রুটি খেতে পারেন। এতে ফাইবারও পাবেন বেশি।
ডিমের সাদা অংশ দিয়ে অমলেটও তৈরি করা যায়। তার মধ্যে একটু পালং শাক কুচিয়ে দিয়ে দিন, স্বাদ বাড়বে। সঙ্গে একটি ব্রাউন ব্রেড টোস্ট আর শসার কয়েকটি টুকরো। এতে পেট অনেক ক্ষণ ভরা থাকবে।
সকালে একটু ছাতু খেতে পারেন, পেট অনেক ক্ষণ ভরা থাকবে। ডায়বেটিক রোগীদের জন্য খুব ভাল টিফিন হল স্প্রাউট স্যালাড। ছোলা ভিজে কাপড়ে মুড়ে রেখে দিন। অঙ্কুরোদ্গম হলে পরের দিন শশা, পেঁয়াজ, টম্যাটো, লেবু ও লঙ্কাকুচি ছড়িয়ে খান।
পুষ্টিবিদদের মতে, সুজি, ডালিয়া, ওট্স জাতীয় খাবার ডায়াবেটিস থাকলে খাওয়া যেতে পারে। ডালিয়া দিয়ে খিচুড়ি, ডালিয়ার রুটি খাওয়া যায়। ওট্স পরিজ, ওট্সের প্যানকেক, সুজির দোসা বা উপমা খেতে পারেন।
খেতে হবে তাজা সবজি ও ফল। তাই বলে ফলের জুস খেতে যাবেন না যেন! তার চেয়ে বরং ফল চিবিয়ে খান। চিবিয়ে খেলে ফলে থাকা কার্বোহাইড্রেট রক্তের সঙ্গে মেশে সহজে। এ ছাড়া চিবিয়ে খেলে দাঁত ও মুখের পেশিও কাজ করার সুযোগ পায়। এমন প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ফলের যে রস শরীর পায়, সেটি সহজে পরিপাক হয়।
বেশি ভাজাপোড়া বা বেশি চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। লবণ বুঝে খেতে হবে। যত কম খাওয়া যায়, ততই মঙ্গল।
খাবার খেতে হবে ক্যালরি মেপে। কতটুকু খাবারে কতটুকু ক্যালরি ঢুকছে শরীরে, তা মাথায় রাখতে হবে। বুঝেশুনে খেলেই আর বিপদের সম্ভাবনা নেই।
শরীরচর্চা
ডায়াবেটিকদের সুস্থ থাকার একটি অন্যতম পথ হল শরীরচর্চা। নিয়ম করে যদি শরীরচর্চা করা যায়, তাহলে সুস্থ থাকা সম্ভব। শরীরচর্চা মানেই অনেকের কাছে জিমে গিয়ে ঘাম ঝরানো। সেটা যদি করা যায়, তার চেয়ে ভাল আর কিছু হয় না। কিন্তু ডায়াবিটিস ধরা পড়লে জিমে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু নিয়ম করে হাঁটা জরুরি। হাঁটাহাঁটির সুফল অনেক। ডায়াবিটিসের ক্ষেত্রে যদি নিয়ম করে হাঁটাচলা করা যায়, তা হলে অচিরেই শর্করার মাত্রা কমবে। আপনার শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে, আপনাকে একটি রুটিন শুরু করতে হবে যাতে আপনি প্রতিদিন কমপক্ষে ৪৫ মিনিট ব্যায়াম করতে পারেন। শরীরচর্চা শরীরের ইনসুলিন (ডায়াবেটিসের সঙ্গে যুক্ত একটি হরমোন) ব্যবহার করার এবং গ্লুকোজ শোষণ করার ক্ষমতাকে উন্নত করে।
উপকারি গাছের পাতার রস
ডায়াবেটিস রোগীদের ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অনেক ঘরোয়া উপায় রয়েছে, যেগুলো নিয়ম মেনে খাওয়া হলে টাকা খরচ করে ট্যাবলেট কেনার প্রয়োজন হবে না। ঘরোয়া উপায় মানেই টোটকা এমনটা নয়। আয়ুর্বেদ মতে, আমাদের চারপাশেই রয়েছে বিভিন্ন ধরনের উপকারী গাছ, যার পাতার রস ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার মোক্ষম দাওয়াই।
ইনসুলিন প্ল্যান্ট: ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ইনসুলিন প্ল্যান্ট ওষুধের চেয়ে কম নয়। ইনসুলিন প্ল্যান্ট বা কোস্টাস ইগনাস গাছটি কোস্টাসিয়া গোষ্ঠীর। আর এই গাছ আপনার সুগার কমাতে পারে বলেই বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। এই গাছ এশিয়া মহাদেশে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। এর মধ্যে ভালো পরিমাণে প্রোটিন, আয়রন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এই সব মিলিয়ে রক্তে সুগার কমাতে পারে এই গাছ। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই গাছের পাতা খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা কমতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই গাছের পাতা চিবিয়ে বা ফুটিয়ে রস করে খেলে ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যায়।
তুলসী পাতা: তুলসী গাছ আয়ুর্বেদের সবচেয়ে শক্তিশালী ওষুধ হিসেবে পরিচিত। অনেক মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা রয়েছে তুলসী পাতার। যদি প্রাকৃতিকভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে চান তাহলে প্রতিদিন পানির মধ্যে তুলসী ফুটিয়ে সেই পানি খেতে পারেন। তুলসী পাতার রস রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে অনেক সাহায্য করে।
পেয়ারা পাতা: গবেষণায় দেখা গেছে, পেয়ারা পাতার রস রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পেয়ারা পাতার রস আলফা-গ্লুকোসিডেসের ক্রিয়াকে বাধা সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। পেয়ারা পাতা গরম পানিতে সেদ্ধ করে চায়ের মতো পান করতে পারেন।
কারি পাতা: কারি পাতা খাবারে স্বাদ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হয়। তবে ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে কারি পাতা খাওয়া রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, যা হজমশক্তিকে ধীরে ধীরে উন্নত করে ও দ্রুত বিপাক প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। তাতে রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। কারি পাতা ইনসুলিন বাড়াতেও দারুণ কাজ করে।
আম পাতা: আমের পাতায় রয়েছে এনজাইম ম্যাঙ্গিফেরিন, যা আলফা গ্লুকোসিডেসকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। অন্ত্রে কার্বোহাইড্রেট বিপাক কমাতে সাহায্য করে এবং রক্তে শর্করার বৃদ্ধি রোধ করে। ইনসুলিন বৃদ্ধি ও গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সঠিক ওষুধ হল আম পাতা। আমের পাতায় পেকটিন, ভিটামিন সি এবং ফাইবারও থাকে। এই দুটি একসঙ্গে ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল উভয়ের জন্যই উপকারী।
(ঢাকাটাইমস/২০ অক্টোবর/আরজেড)

মন্তব্য করুন