ইন্টারপোলের রেড নোটিশে শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা কতটা সম্ভব?

ঢাকা টাইমস ডেস্ক
  প্রকাশিত : ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২১| আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৯
অ- অ+

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ গণহত্যা মামলার পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হচ্ছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। রবিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পুরাতন ভবনের সংস্কারকাজ পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “পলাতক ফ্যাসিস্ট চক্র পৃথিবীর যে দেশেই থাকুক, ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।”

এর আগে গত অক্টোবরে শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের গ্রেপ্তার করে ১৮ নভেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেন আদালত।

এখন প্রশ্ন, ভারতে পলাতকদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত আনা সম্ভব কি না। কিংবা ইন্টারপোলে রেড নোটিশ দিয়ে শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের কবে ফেরত চাইবে বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত যা জানা যাচ্ছে, ফরমালি ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পুলিশের সদর দপ্তরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে।

শেখ হাসিনা ভারতে আছেন, সেটা গত মাসেই দেশটির সরকার নিশ্চিত করেছে। ভারতের সঙ্গে ২০১৩ সাল থেকে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরারি আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তরের জন্য একটি চুক্তিও রয়েছে।

তাহলে বাংলাদেশ কেন সেই চুক্তির আওতায় পলাতকদের ফেরত আনার চেষ্টা না করে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চায়- সেই প্রশ্ন উঠেছে।

রেড নোটিশ জারি করে কীভাবে আসামি ফেরত আনা যায়?

গত ১৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ শুরু হয়। এরপর শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ১৮ নভেম্বরের মধ্যেই শেখ হাসিনাসহ পলাতকদের আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউর তাজুল ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশ পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনাসহ পলাতক আসামিদের ফেরত আনতে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করবে।”

এ বিষয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্টারপোল আসামিদের অবস্থান সম্পর্কে জানার পর সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে।

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বলেছেন, “রেড এলার্ট মানে অমুক লোক, এর বিরুদ্ধে আমাদের এখানে মামলা বা ওয়ারেন্ট আছে। ওই আসামি যে দেশে আছে সেই দেশের পুলিশ বিভাগকে ওই আসামির ওপর নজর রাখতে বলবে।”

তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারপোলের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ১৭ জন আসামিকে ফেরত আনতে পেরেছে বাংলাদেশ।

কিন্তু শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের কি ফেরত আনা সম্ভব- এ প্রশ্নে সন্দেহ প্রকাশ করেন নূরুল হুদা। বলেন, “ফেরত পাঠানোর বিষয়টা শুধু রেড নোটিশের মাধ্যমেই সম্ভব হয় না। সেটা সেই দেশের জুডিশিয়াল অথরিটিরও বিষয় রয়েছে।”

রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ফেরত আনা কি সম্ভব?

ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে তাদের রেড নোটিশের তালিকায় বর্তমানে ৬৪ জন বাংলাদেশির নাম রয়েছে, যাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধ ও বিভিন্ন হত্যা মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি।

এর আগে ২০১৫ সালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও রেড নোটিশ জারি করা হয়েছিল। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ বিভিন্ন মামলার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ওই বছরের ২ জুলাই তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছিল ইন্টারপোল।

পরে তারেক রহমানের আইনজীবীদের আইনি লড়াইয়ে ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ ইন্টারপোলের ৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রেড নোটিশের তালিকা থেকে নামটি প্রত্যাহারের আদেশ দেয় ইন্টারপোল কমিশন।

বর্তমানে ইন্টারপোলের তালিকায় যে ৬৪ জনের নাম রয়েছে তার মধ্যে তারেক রহমানের নাম নেই।

সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, ইন্টারপোলে কাউকে রেড এলার্ট দিলেই তাকে দেশে ফেরত আনা যাবে বিষয়টি এমন নয়।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বলেন, “যার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তাকে যে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে সেই দেশের পরিস্থিতি কেমন, কিংবা রাজনৈতিক কোনো কারণ আছে কি না সেগুলোও বিচার বিশ্লেষণ করা হয়। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক কাউকে ফৌজদারি অপরাধে আটক দেখিয়ে আনা খুব একটা সহজ নয়।”

এর আগে ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধে আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু বিচার শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যান তিনি। তাকে ফেরত আনতে রেড এলার্ট জারি করেছিল ইন্টারপোল। ইন্টারপোলের তালিকায় এখন যে ৬৪ জনের নাম আছে সেখানে আবুল কালাম আযাদের নামও দেখা গেছে। কিন্তু তাকে এখনো পর্যন্ত ফেরত আনা সম্ভব হয়নি।

ইন্টারপোল কীভাবে কাজ করে?

ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন বা ইন্টারপোল সারা বিশ্বের পুলিশ এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞদের একটি নেটওয়ার্কে সংযুক্ত। সংস্থাটির প্রধান কাজ অপরাধীদের ধরতে আন্তর্জাতিক পুলিশকে সহায়তা করা। কোনো দেশে কেউ অপরাধ করার পর অন্য দেশে পালিয়ে গেলে তাকে ধরতে ইন্টারপোলের সহায়তা লাগে। সংস্থাটি অপরাধের তদন্ত, ফরেনসিক ডেটা বিশ্লেষণ সেইসঙ্গে পলাতকদের খুঁজে করতে সহায়তা করে থাকে। এক্ষেত্রে ওই দেশকে সন্দেহভাজন অপরাধীর যাবতীয় তথ্য দিয়ে রেড নোটিশ জারির জন্য আবেদন করতে হয়।

তবে ইন্টারপোল কোনো আসামিকে ধরিয়ে দেওয়ার আবেদন পেলেই তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে পারে না।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বলেন, “যদি কোন দেশ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য ইন্টারপোল সদর দপ্তরে আবেদন জানায় তাকে ওই অভিযুক্তের অপরাধ বিষয়ক যাবতীয় কাগজপত্র, মামলা কপি ইত্যাদি সংগ্রহ করে ইন্টারপোলের কাছে দিতে হয়।”

ইন্টারপোল সেই কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে যে তার বিরুদ্ধে কোনো নোটিশ জারি করা হবে কি হবে না। এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া না হওয়া তাদের কাছে মুখ্য নয়৷

ইন্টারপোল কারও বিরুদ্ধে একবার রেড নোটিশ জারি করলে সেটি সংস্থাটির সদস্যভুক্ত ১৯৪টি দেশের কাছে পাঠানো হয়।

দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, মানব-পাচার, অস্ত্রপচার, মাদক পাচার, সাইবার ক্রাইম, মানি লন্ডারিং, শিশু সহিংসতাসহ ১৭ ক্যাটাগরির অপরাধ তদন্তে ইন্টারপোল তার সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে।

রেড নোটিশ নাকি প্রত্যর্পণ চুক্তি?

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরারি আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তরের চুক্তি অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তির নামে মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয় বা তিনি দোষী সাব্যস্ত হন অথবা দেশের আদালত কর্তৃক প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ করার জন্য তাকে ফেরত চাওয়া হয় তাহলে তাকে ফেরত দেবে বাংলাদেশ ও ভারত। অপরাধটি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ হলে যে কোনো দেশ প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে।

তবে চুক্তি অনুযায়ী হত্যা, নরহত্যা বা অপরাধমূলক হত্যা, আক্রমণ, বিস্ফোরণের কারণ, জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক পদার্থ বা অস্ত্র তৈরি বা নিজের কাছে রাখাসহ বেশ কিছু অপরাধকে রাজনৈতিক বলার সুযোগ নেই।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিটি ২০১৩ সালে করা হলেও ২০১৬ সালে মূল চুক্তিটি সংশোধন করা হয়। সংশোধনের সময় এমন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছিল সেটি হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বেশ সহজ করে তুলেছিল।

সংশোধিত চুক্তির ১০ এর (৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেই সব অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ না করলেও চলবে। শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে।

গত মাসেই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাসহ ৪৫ বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

ভারতের সঙ্গে বন্দি বিনিময় চুক্তি থাকার পরও শেখ হাসিনাকে সেই চুক্তি অনুযায়ী না চেয়ে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে কেন- এমন প্রশ্নে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “প্রত্যর্পণ চুক্তি অনেক বড় ব্যাপার। আর ইন্টারপোলের মাধ্যমে দ্রুত কাউকে ফেরত পাওয়া সম্ভব।”

তবে শেখ হাসিনাকে ফেরানোর জন্য যত প্রক্রিয়া আছে সব প্রক্রিয়াই সরকার অনুসরণ করবে বলে জানান তিনি।

এদিকে রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় কোনো দেশ আসামি ফেরত দিতে না চাইলে যে কোনো কারণ দেখিয়ে আবেদন নাকচ করে দিতে পারে বলে মনে করেন কূটনীতিক বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বলছেন, “বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমান সম্পর্কের জায়গা থেকে শেখ হাসিনাকে চুক্তি কিংবা ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা জটিল।”

(ঢাকাটাইমস/১২নভেম্বর/এফএ)

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
কেনাকাটার জন্য বেরোনোর আগে জানুন ঢাকার কোন কোন মার্কেট বন্ধ
গাজীপুরে ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের চাপায় অটোরিকশার ৪ যাত্রী নিহত
ঢাকার বাতাস আজ খুব অস্বাস্থ্যকর
মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়, কনকনে ঠান্ডায় বিপর্যস্ত জনজীবন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা