নিঃস্বার্থ মায়া মহব্বতের সিলসিলা

রেজাউল মাসুদ
  প্রকাশিত : ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৮
অ- অ+

দাদা, জন্মদাতা বাবার বাবা। আমি যখন সদ্য কৈশোরে সে বছর ইন্তেকাল করেন আমাদের প্রাণপ্রিয় দাদা আলহাজ্ব জাবেদ আলী সরকার। সালটা ছিলো ১৯৮৮ সময় সকাল দশটার দিকে হবে সম্ভবত।বন্ধরৌহা আমাদের গ্রামের বাড়িতে।

আমার বয়স যখন দুই বছর, আমি তখন ভালোই হাটতে পারি, কথাও বলতে পারি আম্মা বলে আমি দাদির অনেক প্রিয় নাতনি ছিলাম। আমার মহিয়ষী দাদী তখন মারা যান। দাদী আমাদের পুরো এলাকায় পীরের মতো ছিলেন। দাদির অনেক ভক্ত আমাদের বাড়িতে সব সময় ভিড় করে থাকত। ইসলামিক নানা বিষয় ছাড়াও অন্যান্য অনেক বিষয়ে পরামর্শ নিতো । অসম্ভব মেহমানদারী এবং যেকোনো মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতে দাদির নামডাক ছিল সর্বত্র।

তুলনাহীন মেহমানদারী দেখেছি দাদার বৃদ্ধ জীবনেও। শীত কিংবা গ্রীষ্মে প্রাতঃভ্রমণ শেষে গ্রামের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ দাদার আতিথেয়তা গ্রহন করতেন নিঃসঙ্কো চিত্তে। হাটের দিন বাজারে যাবার উৎসবে দাদার সে কী আনন্দ। সপ্তাহের কোন বারে কোথায় হাট বসে, কোন হাটের মুখরোচক খাবার আইটেম খেতে কেমন? তা যেন হৃদয়ঙ্গম অহর্নিশ।

আমাদের ঘরে ঢুকতে হাতের বাম পাশে প্রথমেই দাদার রুম। বিকেলে হঠাৎ কিছু খেতে ইচ্ছে করলে দাদাকে গিয়ে বলতাম। চলে আসত সঙ্গে সঙ্গে। কিছু দরকার হলেই দৌড়ে গিয়ে দাদাকে বলে আসতাম। ব্যস পেয়ে যেতাম। আমার ফাইভে বৃত্তি পাওয়া কিংবা আপার এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করা দাদার সেকি আনন্দ উল্লাস উচ্ছ্বাস! এই অনুভূতিগুলো আগে ঠাহর করতে পারিনি। কিন্তু এখন পারি। হাড়ে হাড়ে বুঝি দাদা আমার জীবনে কি ছিলেন?

কৃষিবিদ জ্যাঠা শহরে থাকেন। গ্রামের বাজারে দাদার জন্য একটা রেস্টুরেন্ট 'খান সাহেবের হোটেল' ঠিক করে রেখেছিলেন। দাদা যখন যা ইচ্ছা ওখান থেকে খাবেন। প্রতিবারই দাদা আমাকে হাত ধরে খান সাহেবের হোটেলে নিয়ে যেতেন। স্কুলের টিফিনে আম্মার যখন এক টাকা দুই টাকা বরাদ্দ ছিল তখন রেস্টুরেন্টের সেরা সেরা খাবার আইটেমগুলো দাদা আমাকে প্লেট ভরে দিতেন। নিজেকে তখন অনেক ধনী মনের মত আমার।

আমাদের জমা-জমি তখন বর্গা চাষিরা চাষ করে। শীতকালে সবজির জন্য আমাদের কোন জমি খালি নেই। আমাদের বাড়ি থেকে দুই তিন কিলোমিটার দূরে ফুপুর বাড়িতে সবজি চাষের জন্য দাদা এক খন্ড জমি ঠিক করে নেন। সেখানে টমেটো কাঁচা মরিচ আলু চাষ করেন। এমন এক শীতের সকালবেলা আমি আর দাদা সবজি ক্ষেতে বসে আলু তুলছি, শরীরের রোদ লাগছে, কি যে সেই মধুর স্মৃতি মনে হলে চোখে জল ভরে যায় এখনো।

ইতিহাসের অস্তাচলে হারিয়ে গেলেন আমার দাদা, যিনি আমার চেতনার বাতিঘর, যার কাছে শিখেছি মেহমানদারী-আতিথেয়তা। কেমন করে মানুষকে আপন করে নিতে হয়, কেমন করে মানুষকে ভালোবাসতে হয়, কেমন করে সরল জীবন যাপন করতে হয়। ভালো মানুষ হবার শিক্ষা, মানবিক মানুষ হবার দীক্ষা। কতটুকো মাটির মানুষ হতে পেরেছি জানিনা, তবে কন্টকময় মুহুর্তে দাদার চারিত্রিক মাধুর্য হৃদয়ের স্ক্রীনে দোলা দেয় বারংবার, বহুবার।

দাদাকে ঘিরে এরকম আরো কিছু টুকরো-টুকরো স্মৃতি আমার জমা আছে। প্রিয় মানুষকে নিয়ে কিছু লিখার অনুভূতিটা যে এতটা আনন্দের হয় তা এর আগে এমনভাবে কখনো ফিল করিনি।কিছু অনুভূতি কখনোই হারানোর নয়, কিছু ভালোবাসা কখনোই হারানোর নয়।

আমি নামাজ শিখেছি দাদা থেকে। স্পষ্ট মনে আছে অনেক ছোটবেলা দাদা নামাজে গেলে আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত। আমার দাদি ছিল মুত্তাকী পরহেজগার এবং জ্ঞানী ব্যক্তি। দাদীর কাছ থেকে দাদা কোরআন পড়া শিখেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন দাদা। ভোর বেলায় ফজর নামাজের পর দাদার জিকির-আজগার, দোয়া দরুদ আর আয়াতুল কুরসির তেলাওয়াতটা এখনো যেন কানে বাজে আমার।

দাদার ছয় সন্তানের মধ্যে আব্বা ছিল চতুর্থ। দাদা দাদি সব সময় আমাদের সাথে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ ফিল করতেন। আম্মার সাথে দাদীর মিষ্টি মধুর দারুন সম্পর্ক ছিল। দাদাকে নিয়ে আম্মা বলতেন আমি অনেক ছোট বয়সে বাবাকে হারিয়েছি, ওনাকে আমি শ্বশুর হিসাবে মনে করিনা উনিই আমার বাবা। আমার আব্বাও মা-বাবার জন্য এক কথায় পাগল ছিলেন। মা-বাবাকে ছেড়ে বাইরে থাকতে হবে বিধায় সেজন্য শহরে ভালো চাকরি পেয়েও আব্বা গ্রামেই থেকে যান। এরপরও আম্মাকে দেখতাম দেবর ভাসুরদের ব্যস্ততার কথা মনে করিয়ে আব্বাকে সবসময় দাদা দাদির প্রতি মহানুভব এবং দায়িত্বশীল হতে বলতেন। কেবলমাত্র এই একটি বিষয়ের জন্যই আমাদের পারিবারিক জীবন সব সময় অনেক প্রশান্তিময় ছিল। আমার মা অনুধাবন করতেন একটা মজবুত সম্পর্কের শক্তি অনুধাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন দাদা-দাদিরা। একই সঙ্গে মানসিকভাবে ভালো থাকা, একাকিত্ব ঘোচানো, শারীরিকভাবে তৎপর ও ইতিবাচক থাকতেও গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন দাদা–দাদিরাই। সেজন্য দাদার শেষ দিন পর্যন্ত আমার মা পরম যত্নে সব সময় ভালোবাসার মায়ায় বেধে রাখেন।

আমার বয়স তখন ছয় কিংবা সাত, আশির দশক স্পষ্ট মনে পড়ে দাদা তখন পাইন্যা জাহাজ করে হজ করতে যান। হজ করতে যাওয়া তখন অনেক বড় ঘটনা। পুরো এলাকায় সাজ-সাজ রব। লাল নীল নিশান, পতাকা আর ব্যানার বানিয়ে আমরা মিছিল করে বাড়ি থেকে তিন চার কিলোমিটার দূরের রেল স্টেশনে দাদাকে গভীর রাতে পৌঁছে দিয়ে আসি। হজ শেষ করে দাদা যখন ফিরে আসে, তখন আমাদের বাড়িতে আশেপাশের গ্রামের হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল। আব্বার জন্য দাদা সৌদি আরব থেকে একটা সিকো ফাইভ ঘড়ি নিয়ে এসেছিল। বাড়িতে ঢুকেই দাদা প্রথমেই আম্মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দেন। “আমি হজে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম, এক আফ্রিকান আমায় ব্যাথা দিয়েছিল, ওই সময় অনেক কেঁদেছি আর তোমার কথা মনে পড়েছে। শুধুমাত্র আল্লাহর দয়া আর তোমার অনুপ্রেরণাতেই আমি কেবল হজ করতে পেরেছি। শুধু এই দোয়াই করেছি আল্লাহ যেন তোমাকেও হজ করান এবং সব সময় ভাল রাখেন।"

মা-বাবার শাসন থেকে আমাদের আগলে রাখেন দাদারাই। আমাদের রক্ষা করতে তারা মিথ্যা বলতেও পিছপা হন না। এমন মানুষদের প্রতিদিনই ভালোবাসা যায়, প্রতি মুহূর্তে সম্মান জানানো যায়। কিন্তু, বর্তমানে আমাদের সবার ব্যস্ততা বেড়েছে। এজন্য ইচ্ছা থাকেও সত্ত্বেও অনেক সময় তাদের খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয় না।

দাদা দাদি আমাদের দিয়ে গেছেন অনেককিছু।আমাদের পারিবারিক ক্ষেত্রে দাদা দাদির অবদান অসামান্য। আমাদের মানুষ হয়ে ওঠার দীক্ষাটা উনারা যেভাবে দেখভাল করে রেখেছিলেন তা ভেবে আজকালও আমি অবাক হই। আমরা হয়তোবা তার বিনিময় কোনকিছুই দিতে পারি নাই।

আমাদের অনেকের ঘরেই আছেন বয়োবৃদ্ধ বাবা-মা, দাদা-দাদির মতো প্রবীণ মানুষ। তারা সারাটি জীবন নিজ পরিবারের জন্য বিলিয়ে দিয়ে এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছেন। এ পরিজনদের আমরা হয়তো অনেকেই অবহেলা করি বৃদ্ধ বলে। তাদের নিয়মিত খোঁজখবর নিই। তাদের সঙ্গে সবাই ভালো ব্যবহার করি একসঙ্গে আনন্দ উপভোগ করি। তাদের যথার্থ সম্মান সহকারে সেবাযত্ন করি। তাহলে অন্তত তাদের শেষ সময়টা ভালোভাবে কাটবে, তারা উপভোগ করবেন বাকি জীবনটা।

বয়স্ক আপনজন তথা দাদা দাদি নানা-নানীদের প্রতি ভালোবাসা শুধু লোক দেখানো নয়, তাদের ঠিকানা হোক অন্তরে। যারা নিঃস্বার্থ মায়া মহব্বতের সিলসিলা মনের গভীরে দাগ কেটে রাখে যুগের পর যুগ। তাদেরকে কখনোই ভোলা উচিত না।

লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
ভুয়া তথ্য ছড়ানো বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ফেসবুককে আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
তরুণ প্রজন্মের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম :আমিনুল হক 
গণতন্ত্রের লড়াই এখনো শেষ হয়ে যায়নি: মজনু 
বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে ৩০ মিলিয়ন ডলার দেবে বিশ্বব্যাংক
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা