জাহাজে সাত খুন: ধর্ম পাল্টে নাম গোপন করে চাকরি নেন ইরফান

চাঁদপুর প্রতিনিধি, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:২১
অ- অ+

নাম গোপন রেখে জাহাজে চাকরি নিয়েছিলেন এমভি আল-বাখেরা জাহাজে চাকরি নিয়েছিলেন সাত খুনে স্বীকারোক্তি দেওয়া আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফান। নৌপুলিশকে সেই কারণ জানালেন তিনি। এরইমধ্যে তদন্তে এলাকায় তার পেছনের জীবনের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে উঠে এসেছে।

বৃহস্পতিবার রাতে এসব তথ্য জানিয়েছেন চাঁদপুর নৌপুলিশ সুপার কার্যালয়ের উপ-পরিদর্শক শেখ আব্দুস সবুর।

তিনি বলেন, রিমান্ডে ইরফান জানিয়েছে সে ভৌরবে নৌযানে কাজ করাকালীন কলেমা পড়ে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। মূলত তার পেছনের জীবনের ছোটোখাটো অপরাধ আড়াল করে ভালো ছেলে হিসেবে জীবন কাটাতে ইরফান নাম দিয়ে জাহাজে খালাসি পদে চাকরি নেয়। তবে তার আইডি কার্ডে এখনো আকাশ মন্ডল নামটিই রয়েছে।

বুধবার রাতে বাগেরহাটের চিলমারী থেকে গ্রেপ্তার হন ইরফান। সেখানে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। তার দাবি, বেতন ভাতা নিয়ে অসন্তোষ এবং দুর্ব্যবহারের ক্ষোভ থেকে জাহাজের মাস্টারসহ সাতজনকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তারপর কুপিয়ে হত্যা করেন।

তবে কার্গো জাহাজ এম ভি আল বাখেরার মালিক মাহবুব মোর্শেদ ডাবলু বলেন, ‘ইরফান নাম দিয়ে আমার জাহাজে সে খালাসির পদে চাকরি নিয়েছিলে। তাকে বেতন-ভাতাসহ অন্য সুবিধা দেওয়া হতো না- এমন অভিযোগ বানোয়াট। আমি ৭ খুনের ঘটনায় ৮-১০জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে ইতোমধ্যে হাইমচর থানায় মামলা করেছি।’

থানা পুলিশ ও স্থানীয়দের থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে জানা যায়, ইরফান তার নিজ এলাকা বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামেও আকাশ মন্ডল নামেই পরিচিত। তার পিতা জগদীশ মণ্ডল মারা যাওয়ার পরই তার এবং পুরো পরিবারের অধপতন শুরু হয়। তার মা অভাব অনটন সহ্য করতে না পেরে তাদের দুই ভাইকে ফেলে মুসলিম যুবকের সঙ্গে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে বিয়ে করে চলে যান। পরে নানা নানির কাছে সে থাকা শুরু করার এক পর্যায়ে কিছুদিনের ব্যবধানে তারাও মারা যান। এরপর তার একমাত্র আপন বড় ভাই বিধান মন্ডলও মুসলিম মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে ইসলাম ধর্মে গ্রহণ করে আবির হোসেন নাম নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করেন। ইরফানদের প্রতিবেশী জিহাদুল ইসলাম ও মো. জুয়েল বলেন, আকাশ নামে ছেলেটি ২০১৮ সালের দিকে একটি মুসলিম মেয়ের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে এলাকা ছাড়া হয়। এরপর ২০২২ সালের দিকে পুনরায় এলাকায় এসে তার ভাইয়ের সঙ্গে বাক-বিতন্ডা হওয়ায় আবার নিরুদ্দেশ হয়। এখন ফেসবুকে দেখে জানলাম সে জাহাজে ৭ জনকে খুন করেছে। আকাশ অভাবের তাড়নায় এলাকায় মানুষের ক্ষেত ও পুকুরে শাক ও মাছ চুরির অপরাধে জড়িয়েছিলে। তবে কাউকে মারধর করা কিংবা আঘাত করার মতো দুঃসাহস কখনো দেখায়নি।

আকাশের বড় ভাই আবির হোসেন বলেন, আমার নানা-নানি থাকতো সরকারি জায়গায় ঝুপড়ি ঘরে। তাদের মৃত্যুর পর আমিও সেখানেই থাকি। আমাদের পৈতৃক নিবাস মোল্লাহাট উপজেলার কোদালিয়া গ্রামে হলেও ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর মা ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় আমরা দুই ভাই নানা-নানির কাছেই বেড়ে উঠি। আমি ফলতিতা বাজারে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রির একটা ছোট দোকান দিয়েছিলাম। সেখানে কাজের সময় আকাশ এক নারীর সঙ্গে প্রেমঘটিত ঘটনায় এলাকা ছাড়ে। এরপর আর ওই দোকান সেখানে বেশি দিন টেকেনি। গেল শীতে এক দিনের জন্য সে বাড়িতে আসলে তাকে বকাঝকা করে তাড়িয়ে দেই। এরপর থেকেই সে জাহাজে জাহাজে কাজ করে এবং আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ নেই। তবে এলাকায় থাকাকালীন সে বিয়ে করেনি। মাছ ধরা ও দিনমজুরির কাজ করতো।

এদিকে চিকিৎসাধীন জুয়েল নৌপুলিশকে জানিয়েছে, এই ছেলেই সেই ঘাতক। সেই জাহাজের নিখোঁজ নবম ব্যক্তি।

বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসকের ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্য চাঁদপুর নৌ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন।

তিনি বলেন, গলা কেটে যাওয়ায় কথা বলতে না পারায় কাগজে ৯ জনের নাম লিখেছিল জুয়েল। সেখানে হতাহতের ৮ জন বাদে অন্য নামটি ছিল ‘নিঃস্বার্থ’। তবে জুয়েল এখন জানিয়েছে মানসিক স্মৃতি ও শক্তি দুর্বল থাকায় ওই সময় ইরফানের স্থলে ওই নামটি অস্পষ্টভাবে লিখে ফেলেছিল। মূলত ইরফানই ছিল ওই ব্যক্তি, যে তাকে গলায় জখম চালিয়েছে আর তার নামটিই লিখতে গিয়েই ‘নিঃস্বার্থ’ চলে আসে। তাই নাম নিয়ে যে চাঞ্চল্যটি ছিল সেটির অবসান হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ইরফান নেশাগ্রস্থ ছিল কিনা সে বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। এছাড়া তার মানসিক অন্য কোনো সমস্যা ছিল কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে জানান, জাহাজটিতে কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না। সবাই ঘুমিয়ে ছিল এবং ওইদিন সবাই কক্ষের দরজা খোলা রেখেছিল অর্থাৎ দরজা টানা ছিল। তবে ছিটকিনি আটকানো ছিল না। দরজা ভাঙা না থাকায় বিষয়টি সহজভাবে বোঝা গেছে এবং জুয়েলের থেকে তথ্যেও এটি নিশ্চিত হয়েছি। তবে জুয়েল ভেতর থেকে দরজা লক করায় মূলত প্রাণে বেঁচে ছিল। দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কাজ এগিয়ে নিচ্ছি আমরা।

চাঁদপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আর এম ও ডা. আসিবুল ইসলাম বলেন, জাহাজে ৭ খুনের প্রত্যেকটা মরদেহের ময়নাতদন্ত আমি করেছি। প্রত্যেককেই কানের একটু উপরে মাথায় কোপ দিয়ে মারা হয়েছে। যে একজনকে ধরা হয়েছে সে নেশাগ্রস্থ ছিল কিনা সন্দেহ। তার উগ্র আচরণের বহিঃপ্রকাশেই এমন কান্ড হতে পারে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হরিণা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মো. কালাম খান বলেন, ইরফান আমাদের কাছেই রয়েছে। ৭ দিনের রিমান্ডের প্রথম দিনে তার থেকে অনেক তথ্যই পেয়েছি। বাকি দিনগুলোতে পূর্ণাঙ্গ তথ্য বের করব। আহত জুয়েলের সাথেও আমার যোগাযোগ রয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/২৭ডিসেম্বর/এজে)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিতে বৈষম্যের অভিযোগ: মেধা তালিকায় নাম থাকলেও পদবঞ্চিত অনেকেই
ইসি পুনর্গঠনের দাবিতে বুধবার নির্বাচন ভবনের সামনে বিক্ষোভের ডাক এনসিপির
সাম্য হত্যার বিচার না হলে সারা দেশ অচল করে দেওয়া হবে, হুঁশিয়ারি ছাত্রদলের 
ঝালকাঠিতে সার্ভেয়ারকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ চাচাতো ভা্ইয়ের বিরুদ্ধে
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা