বিজিবি-গ্রামবাসী সংঘর্ষে তিনজন নিহতের ছয় বছর পর মামলা

বাংদেশের সর্ব-উত্তরের সীমান্তঘেঁষা ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার বহরমপুর গ্রামে গরু জব্দ করা নিয়ে সংঘর্ষে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের সময় গুলিতে তিনজন নিহত ও ১৮ জন আহতের ঘটনার সাড়ে ছয় বছর পর আদালতে মামলা করেছেন এক কলেজছাত্র।
সোমবার (২৮ জুলাই) দুপুরে ঠাকুরগাঁও সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতের বিচারক রাজিব কুমার রায় মামলাটি গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলায় বিজিবির হরিপুর উপজেলার বেতনা বিওপির নায়েক মো. হাবিবল্লাহ (৩৭), নায়েক দেলোয়ার হোসেন (৩৫), সিপাহী হাবিবুর রহমান (৩৫), সিপাহী মুরসালিন (৩৭), সিপাহী বায়রুল ইসলাম (৩৩), নায়েক সুবেদার জিয়াউর রহমানসহ (৪০) অজ্ঞাতনামা আরও দু-তিনজনকে আসামি করে আদালতে মামলা করা হয়।
মামলার বাদী আব্দুল কাশেম (২৫) হরিপুর উপজেলার রুহিয়া গ্রামের মো. আমিরুলের ছেলে এবং হরিপুর সরকারি মোসলেমউদ্দিন কলেজের ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
তবে বিজিবির দাবি, ভারতীয় গরু জব্দ করায় সশস্ত্র চোরাকারবারিরা হামলা করলে তারা গুলি চালাতে বাধ্য হয়।
আর গ্রামবাসীর দাবি, বৈধ কাগজ থাকার পরও বিজিবি সদস্যরা গরু নিয়ে যাচ্ছিলেন। তার প্রতিবাদ করায় গুলি চালানো হয়। তাদের গুলিতে হরিপুর উপজেলার বকুয়া ইউনিয়নের রুহিয়া গ্রামের নজরুলের ছেলে দিনাজপুর সরকারি কলেজের ছাত্র মো. নবাব (২৬), একই গ্রামের জহির উদ্দীনের ছেলে মো. সাদেক (৩৬) ও বহরমপুর গ্রামের নূর ইসলামের ছেলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র জয়নুলসহ (১২) নিহত হন। এ ছাড়া আরও ১৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বহরমপুর গ্রামের হুকুম হাজির ছেলে হবিবর রহমান দুটি গরু ও রুহিয়া গ্রামের নাজিম তিনটি গরু জাদুরানী হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই সময় বেতনা সীমান্ত ফাঁড়ির বিজিবি সদস্যরা গরুগুলো আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন।
বৈধ কাগজ থাকা সত্ত্বেও কেন গরুগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা জানতে চাইলে বিজিবি সদস্যরা তাদের দিকে রাইফেল তাক করেন। এ দৃশ্য দেখে গ্রামবাসী প্রতিবাদ করলে সংঘর্ষ বাধে। বিজিবির সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করেন। এতে ঘটনাস্থলেই নবাব, সাদেক ও জয়নুল মারা যান।
এই ঘটনায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) কে এম কামরুজ্জামান সেলিম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, চোরাই গরু ঢুকেছে সন্দেহে বিজিবি অভিযান চালায়। তারা বেশ কয়েকটি গরু জব্দ করে। এ সময় গ্রামবাসীর সঙ্গে বিজিবির সংঘর্ষ বাধে এবং গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় ডিসি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শীলাব্রত কর্মকারের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন।
মামলার বাদী মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘সেদিন আমি এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথে রাস্তায় দেখি বিজিবি ও গ্রামবাসীর মধ্যে গরু আটক নিয়ে বাগবিতণ্ডা হচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ করে বিজিবির ছোড়া গুলি আমার ডান চোখে এসে লাগে। ওই ঘটনায় তিনজন নিহত ও ১৮ জন আহত হন।’
আবুল কাশেম আরও বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকবার থানায় মামলা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের মামলা নেয়নি পুলিশ। উল্টো আমাদের বিরুদ্ধেই ২টা মামলা করেন বিজিবি। তাদের মামলায় আমি দুবার জেলও খেটেছি।’
গত বছরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে বর্তমানে মামলা করার পরিবেশ এসেছে জানিয়ে আবুল কাশেম বলেন, ‘আমি ন্যায়বিচারের আশায় ঠাকুরগাঁও বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আশা করি আমরা ন্যায়বিচার পাব।’
বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী বকুল বলেন, আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।’
ফজলে রাব্বী বকুল আরও বলেন, ‘এত দিন ভয়ভীতির কারণে ভুক্তভোগীরা কোথাও মামলা করতে পারেনি। আজ সেই সুযোগ বা পরিবেশ পেয়েছে।’
এ বিষয়ে হরিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জাকারিয়া মন্ডল বলেন, ‘বিজিবির গুলিতে নিহতের ঘটনাটি অনেক পুরনো। ভুক্তভোগীরা কেউ থানায় মামলা করতে আসেনি। তবে আদালতে মামলা করতে পারে। এখনো আদালতের নির্দেশনা বা কোনো কাগজ আমাদের হাতে আসেনি।’
এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানজীম আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেন তিনি বলেন, ‘হরিপুরে বিজিবির সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ঘটনা শুনেছি। তবে আবুল কাশেম যে মামলা করেছে সেটা অবগত নই।’
(ঢাকাটাইমস/২৯জুলাই/মোআ)

মন্তব্য করুন