এয়ারপোর্টে ১৮ বছর আটকে থাকলেন মেহরান কারিমি নাসেরি, অদ্ভুত জীবন

যাত্রীরা সাধারণত কয়েক ঘণ্টার জন্য বিমানবন্দরে অবস্থান করে। কিন্তু একজন মানুষ তার জীবনের ১৮ বছর কাটিয়ে দিলেন একটি এয়ারপোর্টে! এটা কোনো গল্প নয়, বরং বাস্তব ঘটনা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ইরানি নাগরিক মেহরান কারিমি নাসেরিকে শার্ল দ্য গল বিমানবন্দরে আটকা পড়তে হয়। ঘটনাটি ১৯৮৮ সালের ৮ আগস্টের।
মেহেরান করিমী নাসেরি একজন ইরানি শরণার্থী, যিনি ৮ আগস্ট ১৯৮৮ থেকে জুলাই ২০০৬ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৮ বছর ফ্রান্সের “চার্লেস ডি গুলি” বিমানবন্দরের ডিপার্টচার লাউঞ্জে কাটিয়েছেন।
মেহেরান করিমী নাসেরি ইরানের মসজিদ সোলায়মান নামক স্থানে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা পেশায় একজন ডাক্তার ও মা একজন সেবিকা ছিলেন। তিনি সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ডের বেডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান তিন বৎসরের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে।
১৯৭৭ সালে ইরানে শিয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তাকে স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তিনি বিভিন্ন দেশে বসবাসের জন্য আবেদন করতে থাকেন। অতঃপর ইউনাটেড ন্যাশন হাই কমিশন ফর রিফিউজিস বেলজিয়ামের মাধ্যমে ইউরোপের যে কোন দেশে বসবাদের জন্য অনুমতি পান।
তার মা ইংল্যান্ডের নাগরিক থাকায় তিনি ইংল্যান্ডে নতুন আবাস গড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। পথে মধ্যে ফ্রান্সের বিমানবন্দরে বিমান পরিবর্তনের সময় তার পাসপোর্ট সহ অন্যান্য কাগজপত্র ভর্তি ব্রিফকেস চুরি হয়ে যায়। ফ্রান্স থেকে বিমানে তাকে ইংল্যান্ড নিয়ে গেলেও সেখানে ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট জমা দিতে না পারায় তাকে আবার ফ্রান্সে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ফ্রান্সে পৌছানোর সাথে সাথে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং পরে যেহেতু আইন সিদ্ধ ভাবে তিনি ফ্রান্স বিমান বন্দরে পৌছেন সেহেতু ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু পাসপোর্ট না থাকায় তাকে কোন দেশের নাগরিকের মর্যাদা দিয়ে সেখানে পাঠাতেও পারছিল না ফ্রান্সের কর্তৃপক্ষ। অবশেষে বিমান বন্দরের এক নম্বর টারমিনালের বাসিন্দা হিসাবে বসবাস আরম্ভ করেন।
১৯৯২ সালে ফ্রান্সের হিউম্যান রাইটসের পক্ষ থেকে তার পক্ষে আইনি লড়াই লড়লেও ফ্রান্স ঢোকার অনুমতি পাননি।
১৯৯৫ সালে অনেক প্রচেষ্টার পর বেলজিয়ামে শর্ত সাপেক্ষে যাবার অনুমতি পেলেও নাসেরী তা গ্রহণ করেননি শুধু মাত্র তার ইংল্যান্ডে যাবার মূল উদ্দেশ্য থাকায় ।
নাসেরির দীর্ঘ ১৮ বছরের বিমানবন্দরের জীবনে ১নং টারমিনালে দেখা যেত, পাশে তার ব্যাগ রেখে পড়তে, লিখতে। উক্ত সময়ে বিমানবন্দরের কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা তার খাবার ও পত্রিকার ব্যবস্থা করতো।
বিমানবন্দরের কর্মচারীরা তাকে খাবারের জন্য মিল ভাউচার দিতেন, যা দিয়ে তিনি প্রতিদিনের খাবার কিনতেন। বাকি সময় তিনি ডায়েরি লিখতেন— প্রতিদিন কী খেলেন, কার সঙ্গে কথা বললেন, এমনকি সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলিও সেখানে লিখে রাখতেন।
এয়ারপোর্টের ডাক্তার আলফ্রেডকে বেশ কিছু এ-ফোর সাইজের কাগজ দিয়েছিলেন। আলফ্রেড তার দিনলিপি লেখার কাজে এসব কাগজ ব্যবহার করেছিলেন। প্রতিদিন সম্ভবত তিনি ২০ পাতার মতো লিখতেন। এসব করতে করতেই তার অনেক সময় চলে যেত। বাকি সময় তিনি বই পড়ে কাটাতেন। ইতিহাস ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ব্যাপারে তার অনেক আগ্রহ ছিল।
মেহরান কারিমি নাসেরি ১৯৯৪ সালে বিবিসিকে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, এয়ারপোর্টে বাস করার মধ্যে ভালো এবং খারাপ দুটো দিকই আছে।
ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘শার্ল দ্য গল বিমানবন্দরে আমার অভিজ্ঞতা খুব একটা খারাপ নয়। প্রতিদিনই আমি খুব সুন্দর সময় কাটানোর চেষ্টা করেছি। অল্প কিছু জায়গার মধ্যে আমি একাই ছিলাম। সুখী হওয়ার মতো খুব বেশি কিছু ছিল না। তবে আমি আশা করি যে সবকিছুই সুন্দরভাবে শেষ হবে।’
কিংবদন্তী চিত্রপরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গ নাসেরির গল্প শুনে তার গল্পটি নিয়ে একটি সিনেমা বানানোর চিন্তা করেন। তিনি নাসেরিকে ২-৩ লাখ মার্কিন ডলার (সঠিক পরিমাণটি অজানা) দিয়ে তার জীবনের গল্পটির চলচ্চিত্র সত্ত্ব কিনে নেন। এ ঘটনায় নাসেরি রীতিমত ধনী বনে যান, কিন্তু সেই সম্পদের প্রতি কোনো আকর্ষণ তার মাঝে দেখা যায় না।
পরে এই গল্পের মতো একটি গল্প নিয়েই তৈরি হয় টম হ্যাংক্স অভিনিত ‘দ্য টার্মিনাল’ সিনেমাটি। ছবিটি বিশ্বব্যাপী খুবই খ্যাতি অর্জন করে, তবে নাসেরির গল্পের সাথে সিনেমাটির গল্পের পার্থক্যও কম ছিল না। কিংবদন্তী চিত্রপরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গ নাসেরির গল্প শুনে তার গল্পটি নিয়ে একটি সিনেমা বানানোর চিন্তা করেন। তিনি নাসেরিকে ২-৩ লাখ মার্কিন ডলার (সঠিক পরিমাণটি অজানা) দিয়ে তার জীবনের গল্পটির চলচ্চিত্র সত্ত্ব কিনে নেন। এ ঘটনায় নাসেরি রীতিমত ধনী বনে যান, কিন্তু সেই সম্পদের প্রতি কোনো আকর্ষণ তার মাঝে দেখা যায় না।
পরে এই গল্পের মতো একটি গল্প নিয়েই তৈরি হয় টম হ্যাংক্স অভিনিত ‘দ্য টার্মিনাল’ সিনেমাটি। ছবিটি বিশ্বব্যাপী খুবই খ্যাতি অর্জন করে, তবে নাসেরির গল্পের সাথে সিনেমাটির গল্পের পার্থক্যও কম ছিল না।
২০০৬ সালে তিনি বিমানবন্দর ছেড়ে যান। এরপর ফুসফুসের সংক্রমণের কারণে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার জিনিসপত্র প্যারিসের গৃহহীনদের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হয়। তবে তিনি বিমানবন্দরকে এতটাই আপন করে ফেলেছিলেন যে, ২০২২ সালে আবার ফিরে আসেন শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্টে। কিন্তু ফিরেও খুব বেশিদিন বাঁচেননি। ১২ নভেম্বর, ২০২২ সালে সেখানেই মারা যান। তখন তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তার জীবন একটি বিমানবন্দরের বেঞ্চে আটকে ছিল।
(ঢাকাটাইমস/৬ এপ্রিল/আরজেড)

মন্তব্য করুন