ইতিহাসের কাঠগড়ায় মুক্তিযোদ্ধা তালিকা

অনুপম মাহমুদ
  প্রকাশিত : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০৮:১৭
অ- অ+

এক নিকট আত্নীয়ের অনুরোধে বিবাহযোগ্যা কন্যার জন্য সুপাত্রের সন্ধানে ছিলাম। একজনকে পাওয়া গেলো, তিনিও পাত্রীর খোঁজে আছেন। পাত্রীকে তিন শর্ত পূরণ করতে হবে।

প্রথম শর্ত: পাত্রীকে হতে হতে বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।

দ্বিতীয় শর্ত: পাত্রীর বাবার জেলা শহরে নিজের বাড়ি থাকতে হবে।

তৃতীয় শর্ত: পাত্রীর বাবা/দাদা হবেন একজন মুক্তিযোদ্ধা।

আমি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে ভাবলাম, এতো খুবই ভালো পাত্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে বউ পর্যন্ত চাইছেন তেমনই একটি পরিবার থেকে।

ঘটনা আসলে উল্টো। সে নিজেও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য নয়, আবার নিজের বাড়ি একটা প্রত্যন্ত গ্রামে। এখন আবার নাতি-পুতিরাও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে চাকরি পর্যন্ত পায়, তাই ভবিষ্যতের চিন্তা থেকেই এই তিন শর্ত। ঘটনাটি মোটেই কাল্পনিক নয়, শতভাগ সত্য।

প্রথিবীর কোন দেশে স্বাধীনতাকামীদের এতোবার অপদস্থ হতে হয়েছে বলে শুনিনি। স্বধীনতার পরপর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিলো। এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু পঁচাত্তরের মর্মান্তিক পট পরিবর্তনের পর পরিস্থিতি ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। স্বাধীনতাবিরোধীরা সংসদ সদস্য, মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন।

স্বাধীনতার ১৩ বছর পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ ১৯৮৪ সালে উদ্যোগ নিয়ে একটি তালিকা প্রস্তুত করেন যার সদস্য সংখ্যা এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন। সেই সময় ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নামের তালিকা সংগ্রহ করা হয়, যাতে সংখ্যা ছিলো ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন।

বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের নির্বাচন কে সামনে রেখে যে তালিকা প্রকাশ করা হয়, এতে সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৮৬ হাজার।

আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে দুই দফায় যাচাই বাছাই করে এক লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করে।

বিএনপি সরকার (২০০১-২০০৬) ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দুই লাখ ১০ হাজার।

আওয়ামী লীগ সরকার (২০০৯-২০১৪) ক্ষমতায় এলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ ১৫ হাজার। আর গেরিলা যোদ্ধাদের নাম সংযোজন নিয়ে, বিশেষ করে বামপন্থি রাজনৈতিকদের একটি মামলা মহামান্য হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।

সরকারের পালাবদলের সাথে সাথে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন, বিযোজন হচ্ছে বারবার। আওয়ামী লীগ সরকার এখন তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেছে। বলা হচ্ছে রাজনৈতিক বিবেচনায় আগের সরকার অনিয়ম করেছে, এবার আমরা শুদ্ধ করবো। ইতিমধ্যে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সংজ্ঞা ও এই তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির মানদন্ড প্রণয়ন হয়েছে ১০ বার। জামুকা (জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল), সবুজ ও লাল মুক্তিবার্তা এবং প্রজ্ঞাপন ছাড়াও ভারত থেকে আসা নামের তালিকা আর বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনী যথা সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার বাহিনীতে কর্মরত মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের নামের তালিকাই ভিত্তি ও উৎস।

তবে এর বাইরে ছিলো ছোট বড় অনেক দল ও উপদল। মুজিব বাহিনী একেবারেই ভিন্ন উপায়ে ভারতের দেরাদুন তথা ভারতীয় মিলিটারি একাডেমি থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছে, কাদেরিয়া বাহিনী দেশের অভ্যন্তরেই গড়ে তুলেছিলেন বিশাল এক বাহিনী, তেমনি সারা দেশেই এমন অনেক উপদল ছিলো, যেমন, হেমায়েত বাহিনী, বশ্যা বাহিনী ইত্যাদি।

যখন থেকে সরকারি সুযোগ সুবিধা দেয়া শুরু হলো, তখন থেকেই তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি নিয়ে শুরু হয় নানা সমালোচনা। ২০০৯ সালে সরকার সরকারি চাকরিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সসীমা বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো, মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের বীরত্বপূর্ণ অবদানকে সম্মান জানাতে। আর এই সুযোগে যারা কখনো নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেননি তারাও আবেদন করেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও এই অনৈতিক সুবিধা নিয়েছিলেন। এই সুযোগে কিছু অসাধু কর্মকর্তা তাদের বাবা, শ্বশুর এর নামেও সার্টিফিকেট বাগিয়ে নেন।

সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের জন্য মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী পাওয়া অসম্ভব, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান/নাতি/নাতনি দের জন্য কোটা বরাদ্দ আছে ৩০ শতাংশ, আর শিক্ষা ক্ষেত্রে এই কোটা আছে পাঁচ শতাংশ। এছাড়া খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক সম্মানী বাড়ানো হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা, পরীক্ষা নিরীক্ষা, পৌর/সিটি করপোরেশন ট্যাক্স মওকুফসহ বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা তো আছেই। সবশেষে মৃত্যুর পর দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত হওয়ার সম্মান।

মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের পাশাপাশি স্থান পেয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে অবদান রাখা শিল্পী, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়, বীরাঙ্গনা, চিকিৎসক, সেবাদাতাসহ আরো অনেকেই। এতে রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের প্রকৃতপক্ষে অসম্মানিত করা হয়েছে কি না তা ইতিহাস বিবেচনা করবে। সহযোগিতা তখন অনেকেই করেছেন, তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন, অস্ত্র, গোলাবারুদ বয়ে নিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, নিজে না খেয়ে তাদের খাইয়েছেন, তথ্য দিতেও এগিয়ে এসেছেন। তাদের মূল্যায়ন অবশ্যই করা উচিত, তবে মুক্তযোদ্ধা হিসেবে নয়, মুক্তিযুদ্ধের মহানুভব সহযোগী হিসেবে। বৃদ্ধ পিতা মাতা, স্ত্রী সন্তান (যাদের স্বজন যুদ্ধে ছিলেন) যাদের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে চরম অনিশ্চয়তায় তাদেরকেও মূল্যায়ন করা উচিত।

আসলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কতিপয় রাজাকার, আল বদর, আল শামস, মুজাহিদ ও এদেশীয় পাকিস্তানের দালাল ছাড়া সবাই কম বেশি সহযোগিতা ও সহমর্মিতা জানিয়েছেন। তাই ভালো হয় যদি একটা সঠিক ও পরিপূর্ণ যুদ্ধবিরোধীদের তালিকা করা যায়। প্রয়োজনে তাদের মৌলিক অধিকার ছাড়া সব অধিকার রোহিত করা যেতে পারে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোন পদে, বিশেষ করে সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীতে তাদের সন্তান, এমনকি নাতি নাতনিদেরও বিবেচনা করা ঠিক হবে না।

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি ও সুযোগ সুবিধা পাওয়ায় এখন অনেকেই প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন। উত্তরাঞ্চলে পুলিশ বাহিনীতে চাকরি নিয়ে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করার পর তদন্তে উদ্ঘাটিত হয় যে, তাদের মধ্যে অনেকেই ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দাখিল করেছেন, আর এই ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন স্বয়ং কিছু অসাধু মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, যাদের অধিকাংশ রণাঙ্গনের কমান্ডার নন বরং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার।

২০১৬ সালের বিজয় দিবসের মুক্তিযোদ্ধাদের এক সংবর্ধনা সভায় কিশোরগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জনাব আসাদুল্লা আসাদ বলছিলেন তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। কিছুদিন আগে তিনি ছিলেন একটি ভাইভা বোর্ডে, সেখানে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় প্রাথমিক বিদ্যালয়য়ের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছিলো। সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার স্বজন, সবাইকেই একটা প্রশ্ন করা হয়েছিলো বাবার মুক্তিযুদ্ধের কোন ঘটনা জানা থাকলে বলতে, একটি মেয়ে সামান্য বলতে পারলেও বাকি কেউ কিছুই বলতে পারেননি। এই যদি হয় অবস্থা, তবে কি হবে এই কোটা দিয়ে? কারা পাচ্ছেন এই সুবিধা?

তাই এটা ভীষণ জরুরি, কে বা কারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কী কী সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন, তার সমস্ত কিছুই অনলাইনে, সংশ্লিষ্ট জেলা, থানা এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের দেয়ালে প্রকাশ করা, যেন সবাই জানতে পারে। কারো কোন সংশয় থাকলে সে যেন অভিযোগ করার সুযোগ পায় অন্তত। রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা কেউ পেয়ে থাকলে তা জানার অধিকার দেশের জনগণের আছে।

৪৬ বছর আগে যুদ্ধ হয়েছে, বর্তমান মানদণ্ড অনুযায়ী ১৩ বছরের নিচে কাউকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে না, সেই অনুযায়ী সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার বয়স এখন ৫৯। বেঁচে থাকলে আমার বাবা মুজিব বাহিনীর কমান্ডার, নিকলী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান, নন্দিত জননেতা ইদ্রিস আলীর বয়স হতো ৭০ বছর। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন প্রায় ১৬ বছর আগে, এই ভাবে খুব অল্পকিছু বছরের মধ্যেই আমরা হবো জীবিত মুক্তিযোদ্ধা শূন্য।

প্রয়োজনে মহামান্য হাইকোর্ট এর অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতির নেতৃত্বে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও গ্রহনযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী কমিশন গঠন কারা হোক। এই কমিশন এমন একটি তালিকা করুক, যা হবে সবার কাছেই সমাদৃত। সময় খুব বেশি নেই, প্রয়োজন আমাদের সকলের ঐকান্তিক সহযোগিতা। তা না হলে ইতিহাসের কাঠগড়ায় একদিন আমাদের দাঁড়াতেই হবে, সেই দিন খুব বেশি দূরে নয়।

লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
দাম্পত্য কলহের জেরে যমজ ২ শিশুকে পুকুরে ফেলে হত্যা করেন মা
ইউআইইউ এলাকায় র‍্যাবের অভিযান, বিদেশি পিস্তলসহ শীর্ষ সন্ত্রাসী মোজাম্মেল গ্রেপ্তার
ভোটের মার্কা থাকছে না শাপলা, ইসির নীতিগত সিদ্ধান্ত
ফের এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সামনে ককটেল বিস্ফোরণ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা