ক্লাসে কী পড়াব, কী দেখাব, নির্দিষ্ট করে দেবেন প্লিজ?

শেখ আদনান ফাহাদ
  প্রকাশিত : ০৯ মার্চ ২০১৭, ২২:৪২| আপডেট : ০৯ মার্চ ২০১৭, ২২:৫৫
অ- অ+

জানি না আমার অনুধাবন সঠিক কিংবা নিরাপদ কি না? বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধদশকের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় একটি অনুভূতি আমার মনে কাজ করে, একজন শিক্ষকের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ, সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হচ্ছে তার ক্লাসরুম যেখানে তিনি কথা বলেন। শিক্ষক তার ছাত্র-ছাত্রীদের কিছু শেখানোর চেষ্টা করেন। সবাই কম-বেশি কিছু না কিছু শিখতে পারে। যিনি শিক্ষক, তারও শেখার শেষ থাকে না। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকরা শিক্ষন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যায়। মজার প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়। আমার অনুভূতি আজ পর্যন্ত এমন। কাল থেকে কেমন হবে জানিনা। ক্লাসরুম কি আমার জন্য নিরাপদই থাকবে? নাকি আমিও অন্যের মত কোনো ফাঁদে পড়তে যাচ্ছি! যেকোনো সাহসী শিক্ষকই চুপসে যাবেন, যদি তার পেটে লাথি পড়ে, যদি তার এতদিনের অর্জিত সুনাম নষ্ট হয়।

এই অনিশ্চয়তার আর ভয়ের অনুভূতি শিক্ষকদের মনে দিয়েছে খোদ 'বিশ্ববিদ্যালয়' নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানটিই! এখানেই মূল ভয়। একজন শিক্ষক যদি অপমানিত হওয়ার ভয়ে, চাকরি হারানোর ভয়ে, ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ার ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেন তাহলে ক্লাসের পাঠদান এবং গবেষণাকর্ম যে লাটে উঠবে। নিজের মধ্যে মগ্ন থাকলে ভাবুক হওয়া যায়, দার্শনিক হওয়া যায়, শিক্ষক হওয়া যায় না। ক্লাসে শিক্ষক যত বেশি নিজেকে প্রকাশ করবেন, ছাত্র-ছাত্রীদের ততই লাভ।

তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলাপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ রিয়াজুল হককে যেসব কারণ দেখিয়ে তড়িৎ গতিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা হলো, তা কতখানি লজিকেল হয়েছে? এ ক্ষেত্রে ভয় না পাওয়ার উপায় আছে? আমার মত অপরিণামদর্শী ব্যক্তি যদি এভাবে ভয় পেয়ে গুটিয়ে যাওয়ার ভাবনায় থাকেন তাহলে খুব সাবধানী, হিসেবী মানুষদের মনের কী অবস্থা সেটা ভাবাই যাচ্ছে না।

বড় একটা অনলাইন নিউজ পোর্টালে ঢুকে দেখলাম, রিয়াজুল হক সাহেবের 'ক্লাসরুমে অশ্লীল ছবি' বিষয়ক প্রথম দিনের একটি ১০০/২০০ শব্দের প্রতিবেদন ১০ হাজার শেয়ার হয়েছে। এরকম অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলাদেশে এখন কত আছে, বোধকরি স্বয়ং ঈশ্বরও ঠিকমত হিসাব রাখতে ক্লান্তিবোধ করবেন। প্রতিটি অফলাইন সংবাদপত্রেরও আবার এখন একটি করে অনলাইন ভার্সন আছে। নানা ব্লগতো আছেই, সাথে যোগ করুন মানুষের ফেসবুকের নানা পেইজ এবং আইডি। শিরোনামে যদি 'অশ্লীল' শব্দটি কোনোমতে জড়িয়ে দেয়া যায় তাহলে আর পায় কে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে মানুষের মনে এমনিতেই নানাবিধ চমকে উঠার মতো ধারণা আছে। ফলে দুইয়ে দুইয়ে চার। লাখ লাখ মানুষ জানল, একজন শিক্ষক ক্লাসরুমের মতো স্থানে 'অশ্লীল' ছবি প্রদর্শন করেছেন। সহমত জানিয়ে সবাই বলল, তাকে তো বরখাস্ত করাই উচিত! তিনি তো শুধু চাকরি থেকেই বরখাস্ত হননি। সুনাম খুইয়েছেন নিশ্চয়। নিন্দুকরা খুব খুশি হয়েছেন বলা যায় নির্দ্বিধায়। যারা তাঁকে হিংসা করে নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করেন তাদেরতো মনে হয় উৎসব লেগে গেছে।

এতবড় একটা ঘটনা/দুর্ঘটনা যেসব ‘অশ্লীল’ ছবি প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো কী ছিল? প্রথম কয়েকদিন তেমন আগ্রহ জন্মায়নি মনে। তবে আমিও প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। বিশ্বাস করুন আপনারা, আমারও মনে গেঁথে গিয়েছিল যে এই শিক্ষক নিশ্চয় এমন কিছু দেখিয়ে ফেলেছেন যেটা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু পরে যখন অন্যপ্রেক্ষিত থেকে কিছু লেখা পড়লাম তখন কৌতূহল থেকে ছবিগুলো দেখার চেষ্টা করলাম।

একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের এক কর্মীর ছবি দেখিয়েছেন যেখানে দেখা যাচ্ছে, ছেলেটি পেন্টের চেইন এ এক হাত, আরেক হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের দিকে ক্ষুব্ধ ভঙ্গিমায় এক্সপ্রেশন দিচ্ছে। জেন্ডার স্টাডিজে এই ছবিটি খুবই প্রাসঙ্গিক। দৈহিক ভঙ্গি বা চর্চা দিয়ে অন্যের ওপর আধিপত্য প্রকাশের স্থানীয় নানা এক্সপ্রেশন থাকতে পারে। এগুলো সমাজ বাস্তবতারই প্রকাশমাত্র। এই ছবিটা উনি নিশ্চয় পত্রিকা থেকেই নিয়েছেন। আরেকটা ছবি দেখলাম, স্বামীর হাতে নির্যাতিত এক নারীর ছবি। কাঁধের দিকে সেই নারীর জখমের চিহ্ন। কালচে হয়ে গেছে। এরকম ছবি বাংলাদেশের মানুষ আর কোথাও কখনো দেখেনি? ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’ হুমায়ূন আহমেদের একটি চলচ্চিত্র। লাখ লাখ মানুষ প্রকাশ্যে সিনেমা হলে গিয়ে এই চলচ্চিত্রটি দেখেছে। ইন্টারনেটে সার্চ দিলে এর স্তিরচিত্র পাওয়া যায়। এর একটি ছবি রিয়াজুল হক যদি ক্লাসে দেখিয়ে থাকেন তাহলে কী অন্যায় করলেন? থার্ড জেন্ডার (হিজড়া) বিষয়ক একটা ছবি দেখিয়েছেন। ‘হিজড়া’ তো বাসে, রাস্তায়, ফুটপাতে সারাদিনই দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রতিটি সিনেমা হলের সামনেই তো বড় বড় পোস্টারে নায়ক-নায়িকা, অধুনা আইটেম গার্লদের ‘অশ্লীল’ ছবি দেখতে পাওয়া যায়।

যাইহোক, এরকম কিছু ছবি যদি ক্লাসরুমে স্লাইডে, জেন্ডার স্টাডিজ পড়াতে গিয়ে কোনো শিক্ষক/শিক্ষিকা দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত হন, তাহলে অনেক কিছু নতুন করে ভাবতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি এই সামান্য বিষয় নিয়েও কথা না বলা যায়, তাহলে রাষ্ট্রকে অনুরোধ করব, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিন। অথবা বলুন যে, সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন, নৃতত্ত্ব, নাটক, চলচ্চিত্র, চারুকলা, প্রত্নতত্ত্ব সংশ্লিষ্ট পড়াশুনা বন্ধ করে দেন। ডাক্তার তৈরি করা বন্ধ করে দেন। চারুকলায় শুধু গাছপালা, লতাপাতা, মানুষের চোখ, মুখ ইত্যাদি বিষয়ে ছবি আঁকার নির্দেশ জারি করুন। সম্মানের ঝুঁকি নিয়ে, জীবিকার ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা যাবেনা। ক্লাসরুমে একজন শিক্ষক যদি মনের আনন্দ নিয়ে পড়াতে না পারেন তাহলে কী ফায়দা? যে কোর্সের রেজাল্ট হয়ে গেছে, তার কনটেন্ট নিয়ে এতদিন পর একজনকে শাস্তি দেয়ার কী মানে হতে পারে? রাষ্ট্রের প্রতি আরেকটি অনুরোধ, কোন বিষয়টা শ্লীল, কোনটা অশ্লীল, এটা নির্ধারণ করে দেন। আমাদেরকে বলে দিন, ক্লাসে কি কি বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলতে পারব? আমাদেরকে স্ক্রিপ্ট লিখে দিন। আমাদেরকে মুখস্থ করতে বলুন। আমরা গিয়ে রেকর্ড বাজিয়ে চলে আসব। এত ভয় নিয়ে কিছু সৃষ্টি করা যায়না। শুধু বেঁচে থাকা যায়।

লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
"হাতে হারিকেন ধরিয়ে জাহান্নামে পাঠানো হবে!" — চাঁদাবাজি নিয়ে পুলিশ কর্মকর্তার হুঁশিয়ারি
মিডফোর্ডের ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার পরও বিএনপিকে দায় চাপানো অপরাজনীতি: সালাহউদ্দিন
মিডফোর্টে পাথর মেরে হত্যা আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে: জামায়াত
মিটফোর্ড হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি বিএনপি মহাসচিবের
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা