ভ্যাট যখন ভোটের ইস্যু!

কাওসার রহমান
  প্রকাশিত : ১১ জুলাই ২০১৭, ১৭:০৫
অ- অ+

আমাদের গ্রামদেশে একটি প্রবাদ বাক্য আছে, সেটি হলোÑ ‘সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি।’ শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে অর্থমন্ত্রী ভ্যাট আইন প্রত্যাহার করে নিলেন। আবগারি শুল্কও কমালেন। তবে সেটা অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর। আবগারি শুল্কের কথা না হয় বাদই দিলাম। এর সমালোচনা শুরু হয়েছে বাজেট ঘোষণার পর। কিন্তু এখানেও বিচক্ষণতার অভাব ছিল। আমাদের বর্তমান অর্থমন্ত্রী আমলা থেকে এরশাদের উপদেষ্টা হয়েছেন। উপদেষ্টা হয়ে দুটি বাজেটও দিয়েছেন। তারপর পরিবেশবাদী ও বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় অনেক সময় ব্যয় করেছেন।

তারপর রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সেটাও তো কম দিন হয়নি। আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তাও প্রায় এক দশক হতে চলল। এদেশের মাটি ও মানুষের এ রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে থেকে অন্তত কিছুটা তো সাধারণ মানুষের ‘পালস’ বুঝার কথা। কিন্তু সেটা না বুঝে আপনি ‘পালস’ বুঝলেন দাতাগোষ্ঠীর। অথচ আওয়ামী লীগ অর্থনীতি নিয়ে ‘খবরদারি করা’ এই দাতাগোষ্ঠীর ঘোর বিরোধী। অথচ এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী সেই দাতাগোষ্ঠীর সব ‘আবদার’ই রক্ষা করলেন, কেবল রক্ষা করলেন না এদেশের সাধারণ মানুষের আবদার। দাতাগোষ্ঠী আবদার জানিয়ে আসছে, ১৫ শতাংশের মূল্য সংযোজন কর আইন চালু কর, সঞ্চয়পত্রের সুদ কমাও এবং ভর্তুকি কমাও। এই তিন আবদারই অর্থমন্ত্রী খুব সুন্দরভাবে এবারের বাজেটে রক্ষা করেছেন। আর এর বিনিময়ে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর চালিয়েছেন করের খড়গ।

আবগারি শুল্কের কথা বাদ দিতে চেয়েছিলাম এ কারণে যে, এটা তো জানা গেল বাজেট ঘোষণার পর। কিন্তু মূল্য সংযোজন কর আইন! এ নিয়ে তো গত এক বছর ধরেই সমালোচনার ঝড় বইছে। অনেক তর্ক-বিতর্কও হয়েছে। এটা যে ভোক্তাদের ওপর মূল্য সন্ত্রাস চালাবে তার আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপরও সব আলোচনা-সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করে ১৫ শতাংশ হার বিদ্যমান রেখে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকরের ঘোষণা দিলেন বাজেটে। তাও সেটা এই নির্বাচনের বছরে। আর এক বছর পর দেশে জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে মানুষকে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তোলার জন্য কি চমৎকার কৌশল! ঠিক বেছে বেছে নির্বাচনের বছরে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করার সিদ্ধান্ত। এমনিতেই বাজারে সব পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনিÑ এসব নিত্যপণ্যের মধ্যে কোন পণ্যটা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আছে? তার ওপর ভ্যাট চালুর কথা বলে এই মূল্যকে আরও এক ধাপ উস্কে দেওয়ার পাঁয়তারা। যার সমালোচনা রান্নাঘরে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এই যে সাধারণ ভোটারদের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হলো, এই ক্ষুব্ধ মানুষেরা কি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে। তারা এখন মনে করবে, তাদের দাবির মুখে সরকার বাধ্য হয়ে ভ্যাট আইন প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু সেই ভ্যাট আইন প্রত্যাহার করতে গিয়েও আবার একটি নখতা লাগিয়ে দিয়েছে। সেটি হলো প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে দুই বছরের জন্য ভ্যাট আইন স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বুঝলাম, প্রধানমন্ত্রী দুই বছরের জন্য স্থগিত করতে বলেছেন। কিন্তু একবারও আপনারা ভেবে দেখলেন না এই ‘দুই বছর’ শব্দটা আপনাদের রাজনীতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।

দেড় বছর আছে আগামী সংসদ নির্বাচনের। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে ধারণা দিয়েছেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে নৌকার জন্য মানুষের কাছে ভোট চাইছেন। বিএনপি এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে নানা নাটক করলেও তাদের নেত্রী তথা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও ধানের শীষে ভোট চাইতে শুরু করেছেন। সেই সঙ্গে শুরু করেছেন নির্বাচনের প্রস্তুতি। ফলে এই দেড় বছরে যে মানুষ ভ্যাট আইনের উত্তাপ ভুলে যাবে তারও জো নেই। কারণ দুই বছরের ছয় মাস আগেই অর্থাৎ ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেই সেটিকে ইস্যু হিসেবে নির্বাচনের মাঠে নিয়ে আসবে বিএনপি। এই ভ্যাট ইস্যুটি যে তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে পর্যন্ত চলে আসবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা সরাসরি ঘোষণা দেবে, ক্ষমতায় গেলে নতুন ভ্যাট আইন বাতিল করবে। তারা তাদের প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের ভ্যাট আইন দিয়েই রাজস্ব আহরণ কার্যক্রম চালাবে। তখন আওয়ামী লীগ কি করবে? তখন তো তাদেরও ঘোষণা দিতে হবে, ক্ষমতায় গেলে নতুন ভ্যাট আইন তারাও বাস্তবায়ন করবে না। তাই এই দুই বছর শব্দ উচ্চারণ করে কি দরকার ছিল বিএনপির হাতে একটি নির্বাচনি ইস্যু তুলে দেওয়ার। বাজেটে ভ্যাট ও আবগারি শুল্ক বিষয়ক দুটি প্রস্তাব নিয়ে বিস্তর সমালোচনার পর এ দুটি ইস্যুতে সরকারের পুরো ইউটার্ন কারও আর বুঝতে বাকি নেই যে, সামনে নির্বাচন।

কথা থাকলেও বাংলাদেশে ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু না হলেও ভারতে কিন্তু জিএসটি নামে ভ্যাট ব্যবস্থা চালু হয়েছে। অবশ্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার অনেক সতর্কতার সঙ্গে চার স্তরে এই ভ্যাট আইন চালু করেছে। মধ্যবিত্তকে এত ছাড় দেওয়া এবং ব্যবসায়ীদের নানা সুবিধা দেওয়ার পরও ভারতজুড়ে গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (জিএসটি) এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। সেদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বিশেষ করে সিনেমা হল মালিকরা, আতশবাজি, দিয়াশলাই ও গার্মেন্ট কারখানাগুলো তাদের ব্যবসা বন্ধ রেখে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সে তুলনায় বাংলাদেশের নতুন ভ্যাট আইন অনেক কঠিন। সর্বত্র ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট চালু হলে এর ভয়ংকর প্রভাব পড়ত। এ যাত্রায় দেশের মানুষ বেঁচে গেলেও দেড় বছর পর নির্বাচনের আগে এই ভ্যাটের দুর্ভাবনা তুষের আগুনের মতো জ্বলে উঠতে পারে। ফলে ভ্যাট আবার অর্থনীতির মানি মেশিনের ভূমিকা থেকে রাজনীতির মাঠে ভোটের হাতিয়ার হয়ে ফিরে আসতে পারে।

বাজেট পাসের আগে অর্থমন্ত্রী অনেক ছাড় দিয়ে আবগারি শুল্কও পুনর্বিন্যাস করেছেন। এক লাখ টাকা থেকে এখন পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক আমানতের ওপর মাত্র ১৫০ টাকা আবগারি শুল্ক আরোপ করেছেন। এখানে অনেক ছাড় পেয়ে মধ্যবিত্ত স্বস্তি বোধ করছেন। এখন বাকি আছে সঞ্চয়পত্র। বাজেট পাস হয়েছে এখন সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে কি পদক্ষেপ নেন তার ওপর নির্ভর করছে পেনশনভোগী ও সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল মানুষের ভোটের স্রোত।

তবে আশার বিষয় হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ সুদৃঢ় করতে সরকার সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর পরিকল্পনা থেকেও সরে আসছে। ফলে সরকারের চলতি মেয়াদে সঞ্চয়পত্রের সুদ আর কমছে না। বরং বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক এবং অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পারিবারিক ও পেনশনের সঞ্চয়পত্রের সুদ কিছুটা বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আরও অতিরিক্ত ১৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হতে পারে সঞ্চয়পত্র থেকে। এ লক্ষ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ানোর কথা নতুন করে ভাবছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিশেষ করে দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, শারীরিক প্রতিবন্ধী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, প্রবাসী বাংলাদেশি এবং মহিলাদের সঞ্চয়পত্র কিনতে উৎসাহিত করা হবে।

এর কারণ হচ্ছে, নতুন ভ্যাট আইন প্রত্যাহারের ফলে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি দেখা দেবে। ওই ঘাটতি এখন সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমেই পূরণের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। তবে এভাবে আইএমএফের নীতি থেকে সরকার সরে আসবে তা হয়তো চিন্তাই করতে পারেনি আন্তর্জাতিক এ দাতা সংস্থাটি।

কাওসার রহমান: নগর সম্পাদক, জনকণ্ঠ

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
মানিকগঞ্জের সাবেক এমপি মমতাজ গ্রেপ্তার
কুষ্টিয়া-মেহেরপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে অনিয়মের প্রমাণ পেল দুদক
কোতয়ালী এলাকায় বিশেষ অভিযান, মাদক কারবারিসহ গ্রেপ্তার ১৫
ফরিদপুরে মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা