আর্টিজান হামলা: তিন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ‘জঙ্গি’র খোঁজে পুলিশ

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা মামলায় জড়িত হিসেবে যাদের নাম এসেছে, তাদের আটজন পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বা জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছে। হলি আর্টিজানে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান শেষে উদ্ধার একজন এবং পরে বিভিন্ন এলাকা থেকে আরও তিনজনকে আটক করে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তবে আরও পাঁচজন সন্দেহভাজন রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পুলিশ বলছে, এই মামলার তদন্ত অনেকটাই গুটিয়ে আনা হয়েছে। যে পাঁচজনকে খোঁজা হচ্ছে তাদের মধ্যে তিনজনকে ধরতে পারলেই অভিযোগপত্র দেয়া হবে আদালতে।
কিন্তু এদের যদি গ্রেপ্তারে বিলম্ব হয় তাহলে কী হবে? তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেররিজম ইউটিনের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এই পাঁচজনের সবাইকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও এই বছরের মধ্যেই এই মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হবে।’
মামলাটির তদন্ত সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট এই মামলায় যে চারজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে, তাদের মধ্যে তিনজন নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
গত বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, এই মামলায় নির্ভুল অভিযোগপত্র দিতে চায় পুলিশ। আর শিগগির তা জমা দেয়া হবে।
গত বছরের ১ জুলাই শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার সর্ববৃহৎ এ ঘটনাটি ঘটে। রাজধানীর গুলশানের ৭৯ নম্বর রোডের এ রেস্তোরাঁয় সে সময় পাঁচ জঙ্গির একটি দুর্ধর্ষ দল অতর্কিত হামলা চালিয়ে ২০ জন বিদেশি নাগরিকসহ ৩০ থেকে ৩৫ জনকে জিম্মি করে রাখে এবং রাতভর চালায় হত্যাযজ্ঞ।
পরদিন শনিবার সকালে রেস্তোরাঁয় জিম্মিদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ শুরু করে যৌথ বাহিনী। তবে এর আগে শুক্রবার রাতেই জঙ্গিদের সঙ্গে গোলাগুলিতে ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন খান নিহত হন।
অভিযান শেষে যৌথ বাহিনী বিদেশি নাগরিকসহ মোট ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করে। ভেতরে পাওয়া যায় ২০ জনের মরদেহ। তাদের মধ্যে দুজন বাংলাদেশি, একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান, নয়জন ইতালিয়ান, সাতজন জাপানি ও একজন ভারতীয় নাগরিক ছিলেন।
এক বছর ধরে চলমান তদন্তের শেষ সম্পর্কে পুলিশ বলছে, যে পাঁচজনকে তারা খুঁজছে, তাদের মধ্যে তিনজন খুব গুরুত্বপূর্ণ আসামি, যাদের খুব বড় ধরনের ভুমিকা ছিল হামলা পরিচালনা ও বাস্তবায়নে। তারা হলেন সোহেল মাহফুজ, রাশেদুল করিম এবং বাশারুজ্জামান চকলেট। তাদের পেলে এই মামলার তদন্ত শেষ করতে পারবে পুলিশ।
এই হামলার মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত তামিম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, প্রশিক্ষক হিসেবে চিহ্নিত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম এবং অর্থদাতা হিসেবে চিহ্নিত তানভীর কাদেরী নিহত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে।
এই হামলার অন্যতম হোতা হিসেবে চিহ্নিত জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী পুলিশের হেফাজতে আছেন। এছাড়া জঙ্গিদের অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগে আবু তাহের, মিজানুর রহমান, সেলিম মিয়া ও তৌফিকুল ইসলাম নামে চারজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। আরও গ্রেপ্তার আছেন জঙ্গিদের আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে চিহ্নিত আবুল কাসেমও।
পুলিশ বলছে, এদের জীবিত অবস্থায় ধরা গেলে তারা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল কি না তা জানা যেত। এখন পুলিশের আশা উপরোক্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনজনের কাছ থেকে এই তথ্যগুলো পাওয়া যেতে পারে।
কাউন্টার টেরোরিজম শাখার প্রধান মনিরুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই ঘটনার সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিল, যারা ঘটনাস্থলে গিয়েছিল তাদের কেউই জীবিত নেই। এই ঘটনার পরিকল্পনা, সহযোগিতাসহ নানাভাবে ভূমিকা রেখেছিল আটজন। তারাও জীবিত থাকলে এই মামলায় আসামি হতো। জড়িত আরও চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের তিনজন নিজের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করে ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।’
পাঁচ জঙ্গির ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষা
হলি আর্টিজানে নিহতদের মধ্যে ২০ জনের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েছে পুলিশ। তবে হামলাকারী পাঁচ যুবকের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এখনো হাতে পায়নি তারা।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের দাবি, এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে কয়েক মাসে পরিকল্পনার পুরো ছক পেয়েছে তারা। কর্মকর্তারা জানান, ১ জুলাই হামলা হলেও এর পরিকল্পনা হয় গত বছরের এপ্রিলের শেষ দিকে।
ঢাকায় বড় ধরনের হামলা করলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিডিয়া কভারেজ পাওয়া যাবে এবং এতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে প্রমাণ করা যাবে- এটাই ছিল জঙ্গিদের মূল লক্ষ্য- দাবি তদন্ত কর্মকর্তাদের।
কর্মকর্তারা বলেন, এই পরিকল্পনাকে হাতে নিয়ে জঙ্গিরা হামলাকারীদের বাছাই করে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আক্রমণ করতে গেলে ঢাকার ছেলে লাগবে- এমন ধারণা থেকেই রাজধানীতে বড় হয়েছে এমন তিনজনকে বাছাই করা হয়। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিষ্ঠুরতা ধরে রাখতে পারবে কি না- এটাও হামলাকারী বাছাইয়ের বিবেচনায় ছিল বলেও জানান তদন্ত কর্মকর্তারা।
এই বিবেচনা থেকে ঢাকায় বড় হওয়া তিনজনের পাশাপাশি আরও দুজনকে বাছাই করা হয়। তারা এর আগেও বিভিন্ন হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। পরে এই পাঁচজনকে গাইবান্ধার একটি চরে ২৮ দিন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মিরপুরের রূপনগরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম মুরাদ এই দায়িত্ব পালন করেন।
মনিরুল ইসলাম বলছেন, প্রশিক্ষণ শেষে পাঁচ জঙ্গিকে বসুন্ধরার একটি বাসায় ভাড়া করে রাখা হয়। তবে গুলশান বা বারিধারা এলাকায় অভিযান হবে এটা বলা হলেও তখনও হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়নি।
পুলিশের ভাষ্যমতে, ঘটনার তিন থেকে চার দিন আগে হলি আর্টিজান বেকারিকে বেছে নেয়া হয়। যেখানে অনেক বিদেশির আনাগোনা রয়েছে। কারণ, সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কম ছিল।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজন হলি আর্টিজানে যায়। তারা রেস্টুরেন্টে ঢুকে সবাইকে জিম্মি করে ভিকটিমদের ছবি তুলে শেওড়াপাড়ায় বসবাসকারী তামীম চৌধুরীর এবং নূরুল ইসলাম মারজানের কাছে পাঠায়। এই ছবি পাঠানো হয় ভুক্তভোগীদের মোবাইল ফোন দিয়েই।
পুলিশ বলছে, হামলাকারীরা বসুন্ধরার বাসা থেকে প্রথমে রিকশায় ও পরে পায়ে হেঁটেই ঘটনাস্থলে আসে। সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে সব স্পষ্ট।
‘টাকার জোগান দিয়েছিলেন তানভীর কাদেরী’
মামলার তদন্তে দেখা যায়, হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছাড়াও অপারেশনের আগে টিশার্ট, কেডস, ব্যাগ কিনেছিল জঙ্গিরা। এতে খরচ হয়েছিল আট থেকে নয় লাখ টাকার মতো।
এই খরচ দিয়েছিল পুলিশের অভিযানে আজিমপুরে নিহত তানভীর কাদেরী। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করতেন। তার স্ত্রী একটি বহুজাতিক এনজিওতে চাকরি করতেন। তারা জঙ্গিবাদে জড়ানোর আগে তাদের অ্যাপাটমেন্টটি ও গাড়িটিও বিক্রি করে সব টাকা তহবিলে জমা দিয়েছিলেন।
মনিরুল ইসলাম জানান, অস্ত্র ও বিস্ফোরকগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং যশোর থেকে। তিনি বলেন, ‘আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জের মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে গ্রেপ্তার করেছি। তিনিও এই হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র সরবরাহ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন।’
হাসনাত করিম প্রসঙ্গ
হলি আর্টিজান থেকে বের হয়ে আসার পর হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটক নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিম কারাগারে আছেন।
গত বছরের ৩ আগস্ট হাসনাত করিমকে সন্দেহভাজন হিসেবে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের কথা জানায় পুলিশ। পরে হাসনাতকে গুলশান হামলার ঘটনায় সন্ত্রাস দমন আইনে করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বর্তমানে তিনি কাশিমপুর কারাগারে আছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ১ জুলাই গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার দিনক্ষণ নির্ধারণ করে হাসনাত করিম। ঘটনাস্থলে থাকা ও পুরো বিষয়টি মনিটরিংয়ের জন্য আগে থেকেই মেয়ের জন্মদিন পালনের নামে হলি আর্টিজানের দুটি টেবিল বুকিং দিয়েছিলেন তিনি। নিজেকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে ঘটনার কিছুক্ষণ আগে রাত ৮টার দিকে তিনি দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে হাজির হন।
হাসনাত করিমের জন্ম বাংলাদেশে। তবে কিশোর বয়সেই তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানে কুইন ম্যারি ইউনিভার্সিটি ইন লন্ডন থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। পরে লিডস ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর করার আগে ডব্লিউএস অ্যাটকিনসে কাজও করেন কিছুদিন। ১৯৯৩ সালে হাসনাত চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। পরে আবার ফিরে আসেন ব্রিটেনে। গত দশকের শুরুর দিকে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন।
দেশে ফিরে হাসনাত ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তবে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগে ২০১২ সালে তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য করে নর্থ সাউথ কর্তৃপক্ষ।
হাসনাত করিম সম্পর্কে মনিরুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই মামলায় হাসনাত করিম সাসপেকটেড আসামি। সেই কারণেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্ত শেষে তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।’
(ঢাকাটাইমস/০১জুলাই/এএ/ডব্লিউবি/জেবি)

মন্তব্য করুন